ধীরেন্দ্র এস জাফা ভারতীয় বায়ু সেনার ফাইটার পাইলট এবং উইং কমান্ডার ছিলেন ।
১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানের
হাতে যুদ্ধবন্দী হন । পরে মুক্তি পাবার পর তাঁকে বীর চক্র পুরস্কার দেওয়া হয় ।
বন্দীদশার সেই কাহিনি তিনি লিখছেন তাঁর Death Wasn’t Painful বইটিতে । এই বইটির ১৯ নম্বর পরিচ্ছেদ টির নাম
” আয়েশা” ।
” আয়েশা” ।
তাঁর পরিবারের সম্মতি নিয়ে সেই পরিচ্ছেদটির কিছু অংশ অনুবাদ করা হল ।
কয়েকমাস পরের কথা । খুব গরম ছিল সেদিন । একেবারে ভোরবেলায় ধীরেন্দ্রর জেলকুঠরির লোহার গ্রিল দরজাটা গার্ড এসে খু লে দিল । অথচ এমনটা হবার কথা নয় । শুধুমাত্র বাথরুমে যাবার দরকার হলেই
দরজাটা খোলা হয় । ধী রেন্দ্র
তাই একটু সতর্ক হয়ে বসলো । ভোরবেলার আলো আঁধারির মধ্যে ভুতুড়ে
একটা চেহারা কুঠরির মধ্যে সেঁধিয়ে এলো । কে এটা ? ওহ সেই অফিসার ,মুমতাজ ।
“দূর ছাই,যাচ্ছেতাই একেবারে ”, রাগে গরগর করতে করতে নিজের মনেই বলতে থাকে মুমতাজ , এদিকে গলা
চড়িয়ে হাঁক ছাড়ে , “সুপ্রভাত” । ও পাশ থেকে কোনও উত্তরই এলো না । এক মিনিট ধী রেন্দ্রর চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে থাকে , তারপর হিসহিসিয়ে
বলে ওঠে “আমি তোমার নাড়ি নক্ষত্র জানি ”।
খুব মৃদু গলায় ধী রেন্দ্র বলে “এ কথা তো আগেও বলেছেন “।
“হ্যাঁ , আমাদের বড়কর্তারা জানেন না বটে , কিন্তু আমি
জানি , সব জানি । “ ক্ষোভ গলায় ঝরে পড়ছে মুমতাজের । “
তোমরা আমাদের বিরুদ্ধে গেছিলে । যখন
কয়েদ এ আজম , ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে র ডাক দিলেন তোমরা সবাই বিরুদ্ধে ছিলে, আমাদের
জমি বাড়ি
বেচা , আমাদের সব কিছুতে বাধা দিয়েছিলে । কিন্তু বন্ধ করতে পেরেছ কিছু ? দেখো
, ভালো করে দেখো , আমরা কত ভালো আছি। বাড়ি
আর জমি বেচে ভালো দাম পেয়েছি আর নিজেদের মুলুকে চলে আসতে পেরেছি। তোমরা কিসসু করতে পারো নি । ইনশা আল্লাহ্ “।
ধী রেন্দ্র মনের গভীরে তলিয়ে ভাবতে থাকে । এ কে ? এ কে হতে পারে? তার শহরের ওপর
তলার মুসলমানেরা বেশির ভাগই পাকিস্তানে চলে গেছিল । ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে , লুঠ তরাজ ,
মারামারি দাঙ্গা , দুই ধর্ম গোষ্ঠীর বিরোধ শুরু হয়েছিল । সম্ভ্রান্ত লোকেরা সম্পত্তি জমি বেচে ভালোরকম
পয়সা নিয়ে নতুন দেশে চলে গিয়ে বেশ জমিয়ে বসেছিল । এরা সবাই প্রায় সমাজের উঁচু তলার
লোক , আর এইসব দাঙ্গা হাঙ্গামায় লুঠপাটে যাদের ব্যাবহার করা হয়েছিল সেই
নিচুতলার লোকগুলো তাদের পুরনো মহল্লাতেই রয়ে গেছিল । মুমতাজ ওইরকমই বড়লোক বাড়ির কেউ হবে
হয়তো । ধী রেন্দ্র খুব করে ভাবতে থাকে , যদি
কোনও সূত্র পাওয়া যায় , যদি সেও একদিন তার চোখে চোখ রেখে বলতে পারে ,” আমি তোমার
নাড়ি নক্ষত্র সব জানি “।
জল যেমন তার স্তর সমান রাখে , সমাজটাও তেমনি । মেলামেশা সব সমানে সমানে । হিন্দু জমিদার আর মুসলমান জমিদার ,
দুই ধর্মের কবি লেখক শিল্পী ,আবার দুই গোষ্ঠীর আমুদে আয়েসি শৌখিন।
আবার খেটে খাওয়া বিড়ি ফোঁকার দল একসঙ্গে
বসে মহাজনের চড় থাপ্পড় , ফসল , জল বৃষ্টি নিয়ে গুলতানি করত । পণ্ডিত আর মোল্লার দল গোল হয়ে বসে
লোকজন সব উচ্ছন্নে গেল , কারুর কিছু বিশ্বাস , ধম্ম কম্ম নেই ,এই নিয়েই আলোচনা করে
চলত । এইসব মিলেজুলে থাকতে থাকতেই
সাম্প্রদায়িক উষ্মা বা মন কষাকষি খুব মাথা চাড়া দিতে পারত না । কিন্তু সব ধীরে ধীরে বদলে যেতে শুরু
করল ,ভিন্ন দেশের প্রস্তাব এলো , একটা সন্দেহ আর অবিশ্বাসের হাওয়া যেন সব কিছুকে
ঘিরে ফেলতে লাগল ।
ছোটবেলায় ,ধীরেন্দ্রর বেশ মনে আছে ,তারা প্রতিবেশী মুসলিম ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মিশত । মাসুদদের বাড়িতে ভালোই যাতায়াত ছিল । নানান ছলছুতোর মধ্যে একটা ছিল দূর
থেকে ঘারারার ঢেউ তোলা সেই মেয়েটিকে একবার শুধু একবারের জন্য দেখা ।
তারপরে আচমকা সেই খবরটা এলো ।
মাসুদরা রাতের অন্ধকারে শহর ছেড়ে চলে গেছে । কেউ বলল আলি গড় কেউ বলল পাকিস্তান । কিছুদিন পরে ওদের আত্মীয়দের, যাদের খুব বেশি পয়সার জোর ছিল না তাদের কাছ থেকে জানা গেল ওরা করাচি চলে গেছে । এরপর
থেকে ধীরেন্দ্র ওদের প্রতিটি খবর জানবার জন্য একরকম মুখিয়ে থাকত , বিশেষ করে একজনের খবর । বছর
ঘুরতে খবর পেল মাসুদদের বড় মেয়ের পাকিস্তান এয়ার ফোরসের কোন এক অফিসারের সঙ্গে
নিকাহ হয়ে গেছে । তারপর থেকে ওদের কোন খবর আর রাখত না সে
।
মুমতাজ কিছুই না বলে ঘর থেকে বেরিয়ে গেল ।
আয়েশা ,
ঘারারার ঢেউ তোলা সেই মেয়ে ,কালো মিশমিশে চুলে হালকা করে বাঁধা মোটা বিনুনি ,মাখন আর পিচ রঙা সেই মেয়ে মিশন
স্কুল আলো করে থাকত ।
সবাই হাঁ করে সেই সুন্দর মুখ খানার দিকে তাকিয়ে থাকত ,
বড় বড় কাজল টানা চোখ কখনো সখনো ধীরেন্দ্রর ওপর এসে পড়ত ,আবার অনেকটাই ধী রেন্দ্র নিজে
থেকে ভেবে নিতেও ভালোবাসতো ।
মিশন স্কুলে নানা রকমের ফাংশান হত । কবিতা নাটক গান । কিন্তু সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল
ছেলেমেয়েদের বিতর্ক । সেবারে
বিষয় ছিল “মেয়েদের স্থান গৃহকোণে “।
ডায়াসের ওপর ছেলেমেয়েদের আলাদা আলাদা
লাইন করে দাঁড়াতে হত । সেই দিন কয়েকজনের পরে এলো আয়েশার ডাক । আলো
ছড়িয়ে এসে দাঁড়ালো সেই মাখন পিচ ফল রঙা মেয়ে । সবাই তাকিয়ে আছে হাঁ করে । হাঁটু থেকে কপাল পর্যন্ত হাত তুলে
অভিজাত ভঙ্গিতে কোমর ঝুঁকিয়ে লম্বা বিনুনি দুলিয়ে কোহল মাখা দুটি চোখ তুলে দর্শকদের বলল “আ-দা- ব “। তারপর তার ঝঙ্কারময় সুন্দর গলায় তার বক্তব্য
রাখল , শুনেই মনে হল খুব যত্ন করে অনেক
খেটে নিজেকে এই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করেছে । কে জিতবে তার ফয়সালা যেন হয়েই আছে ,
শুধু নাম ঘোষণার অপেক্ষায় । ধীরেন্দ্র চোখ ফেরাতে পারছিল না । যেন তার ঘোর লেগেছে , জাদু করেছে কেউ
তাকে ।
এবারে ধীরেন্দ্রর
পালা আসে । ডায়াসে উঠে সে বলতে শুরু করে “ মাননীয় বিচারপতিগণ , অভিভাবক “এবং ,” বলতে বলতে ডানদিকে চোরা চাউনি দেয় আর কোহল চোখ তার সব শক্তি শুষে নেয় । গলা শুকিয়ে কাঠ । দর্শকদের মধ্যে ততক্ষণে গুনগুনানি
শুরু হয়ে গেছে , টিচাররা কঠিন ভাবে তাকিয়ে আছে , লজ্জায় লাল হয়ে তোতলাতে তোতলাতে ধীরেন্দ্র
বলে “আমার ,আমার আর কিছু
মনে পড়ছে না “। ধুপধাপ
করে স্টেজ থেকে নেমে অন্ধকারে একটা থামের আড়ালে লুকিয়ে পড়ে । লজ্জায় ধিক্কারে নাস্তানাবুদ । অল্প কিছুক্ষণ পর অন্ধকারে লুকিয়ে
থাকা ধীরেন্দ্রর পাশ দিয়ে হেঁটে গেল সেই
রানি সাহিবা , হাতে ঝকঝক করছে বিজেতার পুরস্কার । মস্ত বড় একটা কাপ ।
এর পর থেকে আয়েশার ভাই এর সঙ্গে ভাব পাতায় ধী রেন্দ্র । নানান ছলছুতোয় ও বাড়িতে যায় , হোলি
আর ঈদ এর জন্য অধীর অপেক্ষা । কারণ
এই দুটো পার্বণে খুব মেলামেশা হত । আর ছিল
তিজ । হিন্দু মুসলিম মেয়েরা নিজেদের বাড়ির
বাগানে আমগাছে ঝুলায় দোল খেতো । আর
ছেলেদের কাজ ছিল গাছে দড়ি বাঁধা , আর পেছন থেকে দোলনা ঠেলে দোল দেওয়া ।
তারপর যে কথা থেকে কি হয়ে হেল । একটা উদ্ভ্রান্ত সময় গিলে নিলো সব
কিছু ।এলো নতুন দেশের দাবি, দেশ ভাগ । জীবন যাপন , সংস্কৃতি, সমাজ জীবনে
সম্ভ্রমবোধের যে একটা পারস্পরিক মেলবন্ধন ছিল সে টা কেমন যেন ঘোঁট পাকিয়ে গেল। আর মানবিকতার ঘোরতর পচনের মধ্যে একদিন হঠাৎ মাসুদরা চলে গেল ।
৪
কিছুদিন বাদে মুমতাজ জেলখানায় এলো । বেশ অস্থির এবং বিরক্ত । এসেই ধীরেন্দ্রর
দিকে সেই নিয়ম মাফিক চোখ সরু করে তাকিয়ে থাকল । তারপর শুরু করল একটা বিরাট
স্বগতোক্তি “মগজ বুদ্ধি কল্পনা সবই আমাদের আছে
, পাটনা থেকে লখনউ , ইলাহাবাদ থেকে আলিগড় , বেরিলি থেকে ভোপাল সর্বত্র ,।
ইত্যাদি ইত্যাদি ।
ধীরেন্দ্র বিমর্ষ ভাবে বলে ওঠে “ আপনি এভাবে বলছেন কেন?
এভাবে ভাবছেনই বা কেন? আপনারা তো দেশ পেয়েছেন , সবকিছুই পেয়েছেন। তাহলে আর সমস্যা কোথায়? “
“তুমি বুঝবে না “, দুম করে উঠে দাঁড়ালো মুমতাজ । ধী রেন্দ্র তার পথ আটকে দাঁড়াল
,জিজ্ঞেস করল ,”আয়েশা কেমন আছে?”
ধীরেন্দ্রকে আর কিচ্ছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাঁধ ঝাঁকিয়ে
ঘর থেকে বেরিয়ে গেল মুমতাজ ।
পরের দিন এসে ধীরেন্দ্রকে হতবাক করে দিয়ে জিজ্ঞেস করল
,”আমির চাঁদ রা এখনো আছে ? আর সেই জজ সাহেব , ব্রিজ নারায়ণ ?”
ধীরেন্দ্রর কাছে ব্যাপারটা এবারে পরিষ্কার হল । এতদিনের এই রাগ টা মুমতাজ বেশ মাথা
খাটিয়ে ভেবেচিন্তে দেখিয়ে এসেছে ,তাতে হৃদয়ের সমর্থন ছিল না হয়তো । সেই ভেজা শৈশব , নরম কৈশোর , সেই সব বড় হওয়ার দিনের মন
ভালো করা স্মৃতির ঝাঁপি , তার ফেলে আসা
দিন তাকে বীরেন্দ্রর কাছে টেনে এনেছিল , ভালবাসা এবং তাচ্ছিল্য দুটোই মেশানো ছিল
তাতে । কিন্তু মুহূর্তেই নিজেকে সামলে নিলো
মুমতাজ । আবার শুরু করে দিল তার রাগ ঝাঁঝ
মেশানো কথাগুলো । ধী রেন্দ্রর মন আর এসবের মধ্যে ছিল না
। এই সব অর্থহীন এবং অন্তহীন তর্ক বিতর্কে
তার আর কোন সায় নেই । এতদিন
ধরে যে কথাটা বলি বলি করে বলা হয়ে ওঠেনি এবারে সে বলেই ফেলল ,” আমি আয়েশার সঙ্গে
দেখা করতে পারি? একবার মাত্র একবারের
জন্য?”
মুমতাজ তাকিয়ে রইল । তারপর কি যেন ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে
বেরিয়ে গেল । ধী রেন্দ্রর মন তোলপাড় । মুমতাজ কি রেগে গেল? তার অনুরোধটা কি
ও ভালো মনে নিতে পারল? কি জানি? হয়তো হ্যাঁ , হয়তো বা ,না ।
৫
মুমতাজ তার রুটিন ভাঙল । একদিন এলো বিকেলবেলা । শুধু তাই নয় , জেলকুঠরির বাইরে
অফিসঘরে তাকে ডেকে পাঠাল । মুমতাজ
চেয়ারে বসে । ধী রেন্দ্রকে একটা চেয়ার দেখিয়ে ইশারায় বসতে
বলল। মুমতাজ কিছু একটা বলতে যাবে এমন সময়ে
একটা পুলিশ দুমদাম করে ঘরে ঢুকে মুমতাজের কানে কানে কি সব ফিসফিস করে বলতে শুরু
করল । মুমতাজ ব্যাস্তভাবে উঠে দাঁড়াল, যেন
এখখুনি বেরিয়ে যাবে ।
“একজন সিনিয়র অফিসর এসেছেন এখানকার আরেঞ্জমেন্ট দেখতে
,আমি আর এক মিনিট ও এখানে থাকতে পারব না “। মুমতাজ
দৌড়ে বেরিয়ে গেল । পুলিশটা ধীরেন্দ্রকে কুঠরিতে ফিরে
যেতে বলল। ঘর থেকে বেরিয়েই সে শুনতে পেল একটা গাড়ির স্টার্ট দেবার শব্দ , একটা বাঁক নিতেই গাড়িটাকে সে পরিষ্কার দেখতে
পেল। গাড়িটা চলে যাচ্ছে ,গাড়ির জানালাটা , জানালার ওপাশে সেই মাখন পিচ রঙা মুখ , কাঁধ বেয়ে
নেমে আসা মোটা বিনুনি , কোহল কালো দুটো চোখ তার দিকে তাকিয়ে । বিভ্রান্ত , হতচকিত ,স্মৃতি মেদুর ।
হতভম্ব ধী রেন্দ্র হাত তুলে বলতে চাইল থামো থামো ,একটু
দাঁড়াও ,আমি আসছি ।
গাড়ি স্পিড নিয়ে বেরিয়ে গেল । আবার আয়েশা হারিয়ে গেল তার কাছ থেকে ।
কি যে সুন্দর করে লিখেছেন!আরো চাই ।
ReplyDeleteবেশ তাই হবে জো হুকুম । অনেক অনেক ধন্যবাদ।
ReplyDeleteখুব সুন্দর লাগল।
ReplyDeleteThank you so much
ReplyDelete