Saturday 9 July 2016

দিল্লি দাস্তান ১


শাম এ আওয়াধ
মোঘল সাম্রাজ্যের  রাজধানী দিল্লির সঙ্গে আন বান শান শওকত খানা পিনা গানা শায়েরি মুশায়েরা মহফিলে পাল্লা দিতে পারত একটি মাত্র  প্রদেশ যেখানে মুর্গাকে জাফরান আর কস্তুরীর বড়ি খাওয়ানো হত জবাই করার আগে ,যাতে খাবার সময় প্রতি পরতে পরতে মেহক ছড়িয়ে পড়ে মুখের ভেতর । এতো স্রেফ খাওয়া  নয় এ হল দস্তুর , পেশকশ ,  এ এক শিল্প । সেই প্রদেশটি হল আওয়াধ বা অযোধ্যা । আওয়াধ ছিল মোঘল সাম্রাজ্যের অধীনে একটি প্রদেশ ।  প্রদেশ শাসন করতেন একজন নবাব বা গভর্নর ।
দিল্লি শহরে বড় রাস্তা ছোট রাস্তা মহল্লার নামের মধ্যে বেঁচে আছেন অনের সুলতান সম্রাট , যারা দিল্লির মসনদে বসে ছিলেন । হয়তো ইতিউতি আছেন কিছু দিল্লির প্রভাবশালী রাজপুরুষ। সুফি সন্ত নিজামুদ্দিনের নামও বুকে আগলে রেখেছে এ শহর ।তার নামে আছে রেল স্টেশন , আছে লোকালয় । কিন্তু এদের সবাইকে ছাড়িয়ে ছাপিয়ে দিল্লির বাসিন্দা  না হয়েও আজও ভীষণ ভাবে অস্তিত্বময় আওয়াধের দ্বিতীয় নবাব সফদরজং । মাত্র ছেচল্লিশ বছরের জীবন ছিল তার । কেন্দ্র রাজনীতি ও শাসনের  শিখরে উঠেছিলেন তিনি । সুবেদার হিশেবে নানান লড়াই যুদ্ধে সাফল্যের পর তার মাথায় উঠল ‘মীর এ আতশ” এর শিরোপা। সম্রাট মুহম্মদ শাহের আমলে পুরো শাসন ভার টাই তারই কব্জায় ছিল । কিন্তু এসবের মধ্যেও আওয়াধের উন্নতি ও শান্তি শৃঙ্খলা কখনোই ভুলে জান নি । একটা কথাই মাথায় থাকত তার তিনি আওয়াধের ।   দিল্লি মসনদের টালমাটাল ঝড়ো হাওয়ায় সফদরজং হলেন ওয়াজির উল মামলুক ই হিন্দুস্তান অর্থাৎ মুঘল সাম্রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী । তার ওই স্বল্প জীবন দেখেছে প্রচুর সাফল্য ও সম্মান । কিন্তু রাজনীতির কুহেলিকা জাল থেকে তিনিও বের হতে পারেন নি শেষপর্যন্ত আওয়াধেই ফিরে মারা যান আর তার সমাধি সৌধ গড়ে তোলে দিল্লি । আজ তার নামে রাস্তা , হাসপাতাল , সফদরজং এয়ারপোর্ট । সফদরজং  এনক্লেভ ,  সফদরজং টারমিনাস , এতোটা আর কারুর ক্ষেত্রেই দেখা যায় নি । শোনা যায় আওয়াধের এই দ্বিতীয় নবাব খুব উদার ছিলেন,পন্ডিত কবি শিল্পী , গরিব অনাথদের  সাহায্য করতেন দরাজ হাতে । আজ তার  সমাধি ক্ষেত্রে খোলা প্রাঙ্গনে আকাশের নিচে পড়ন্ত বিকেলে  সফদরজঙ্গের সমাধির পাশে শুরু হল  শাম এ আওয়াধ ।
এককথায় আধুনিক কথকতা । হিন্দি উর্দু মেশানো ভাষায় কথক আমাদের নিয়ে চল্লেন আওয়াধ এবং লখনউ এর ইতিহাসে, হাভেলিতে, অলিন্দে অলিন্দে । অনুষ্ঠান শুরু হল লখনভি কেতায় । হাতে হাতে ঘসে দেওয়া হল খসখসের ইত্বর ,  তারপর এলো রুপুলি তবকে মোড়া  ভাজা ইলাইচি- নোশ ফরমাইয়ে। ঠান্ডা ভেজা মটকায় ছোট্ট ছোট্ট পানের খিলি,মুখে দিলেই মিলিয়ে যায় ,আবার –নোশ ফরমাইয়ে । খসখস মেশানো সোঁদা গন্ধ মাখা হাওয়া আর কথকের ধারা কাহিনি তে  ভেসে এল কখনো যুদ্ধের দামামা,রাজনীতির কুটিল চক্রান্ত , দেহলভি আর লখনভি কেতার মজাদার কিসসা, শের শায়েরি মুশায়েরার চমকদার লখনউ , তার জাঁক জমক , পায়রা মুরগি তিতিরের লড়াই, ঘুড়ি ওড়ানো ,দস্তরখান বা খানা পিনার তাজ্জব করা গল্প , ভিস্তি ওলা র রাস্তায়  কেওড়া, ইত্তর,  গুলাব মেশানো জল ছিটানো , মিঠি বোলি আর তমিজ ,এতোটাই কেতা দুরস্ত ছিল  সেকালের চাল চলন ।


রাফতা রাফতা হর পুলিশ ওয়ালে কো শায়ের কর  দিয়া
মেহফিল এ শের ও সুখান মে ভেজ কর সরকার নে 
এক কয়েদি সুবাহ কো ফাঁসি লগা কর মর গয়া
রাত ভর গজলে সুনাই উসকো থানেদার নে ।

সাগর খইয়ামি সাহাবের এই কবিতাই বলে দিচ্ছে কি বিপজ্জনক ছিল সেকালের আওয়াধ বা লখনউ । মুশায়েরা তে পুলিশদের ডিউটি লাগানো হত । সারারাত ধরে শের শায়েরি শুনে সকালবেলায় লাল চোখ নিয়ে কোতোয়ালিতে গিয়ে সে ব্যাটার তখন বদ হজম  হয়ে নানান কিসিমের  শায়েরি মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসছে । কাকে  সে শোনাবে ? কয়েদি গুলো ছাড়া আর তো কেউ নেই সামনে  । কানের কাছে নানান সুরে নামতা শোনায় একশ উড়ের মতো দিনের পর দিন থানেদারের গজল শুনে গলায় দড়ি ছাড়া কয়েদিদের  আর কোন গতি নেই ।   
লখনউ এর আগে আওয়াধের নয়নমণি ছিল ফইজাবাদ । গঙ্গা যমুনি তেহজিবের প্রাণকেন্দ্র । নবাব সুজাউদৌল্লার আমলে তার কী  সাজ সজাওট আর রৌনক  । শহর তো চার ক্রোশ দূর, ফটক থেকেই তার চমচমাহট শুরু হয়ে যেত । রঙ্গিলা বেফিকর জীবন । জলসা , মুজরা , মেহফিল । খেল তামাশা । এরপর ফইজাবাদের জলুস কমে গেলো কারণ ততদিনে আসফ উদ দৌলা লখনউতে রাজধানী সরিয়ে নিয়ে গেলেন । সন ১৭৭৫ । শুরু হল লখনভি  দাস্তান । মৌসিকি আর ফনকারের দলের মৌতান  শহর মাতিয়ে দিল  । দরিয়া কিনারে নবাব আর মোসাহেবের ঘুরে বেড়ান , নবাব দেখেন হায়দরি সাহেব মাথা নিচু করে হাঁটছেন । বড় ভালো গান করেন , নবাব বললেন , আমাকে গান শোনান । হায়দর সাহেব বলেন , আমি তো আপনার বাড়ি চিনি না । আমি যেতে পারি  তবে হালুয়া পুরি খাওয়াবেন তো ?প্রাসাদে ঢুকে  হায়দর  মিয়াঁ বুঝতে পারলেন আরে এতো নবাবের বাড়ি । হালুয়া পুরি তো খেলেনই , আবার বিবির জন্য ছাঁদা বেঁধে নিয়ে গেলেন । নবাবি মর্জি । গানা শুনে খুশ । এরপর ফরমায়েশ এলো , নবাবকে কাঁদাতে হবে , নাহলে উস্তাদ কে দরিয়ার পানিতে ডুবিয়ে দেবো । যাক সে যাত্রা হায়দরি প্রাণে বেঁচে গেছিলেন ।
আর ছিল দাস্তানগোই । গলপ বলা ।  দিল্লিতেও দাস্তানগোই ছিল । তবে সিধা সাদা । লখনউতে দাস্তান গোই ছিল শের শায়েরিতে ভরপুর । দাস্তান । ম্যায়খানা । হুক্কাখানা । আফসানা আর দাস্তানের মধ্যেই বুঁদ হয়ে থাকত সবাই । ছিল ভাঁড় , তাদের নৌ টঙ্কি । আর ছিল দস্তরখানের কেরামতি । বাবুর্চিখানা র মধ্যে ছিল নানান গ্রেড । নবাবি খানাপিনা মানে খাসা পেশ করা , দস্তরখান সাজানো বড় বাহাদুরির কাজ ছিল তখন । রকাবদার আর বাবুর্চি দের মেজাজ মর্জি ও ছিল তেমনি দেমাকি ফিনফিনে । দিল্লি আর লখনউ এর মধ্যে বেশ একটা পাল্লা দেবার ব্যাপার ছিল তখন বাদশা আর নবাবদের মধ্যে । মুর্গা কে খাওয়ানো হত জাফরান আর কস্তুরির গুলি, রান্না করার পর তার যা খোশবায় হত ! তবে লখনউ পছন্দ করত পুলাও ।  বিরিয়ানি ছিল বদনুমা খানা । লখনভি খানায় ইরানি প্রভাব বেশি ছিল । মশল্লার সুচতুর ব্যাবহার ।  যাকে বলে খানদানি রইস । সঙ্গে বাখরখানি রোটি মোতি পুলাও । নবরতন পুলাও । আনারদানা পুলাও । ভাতের দানা অর্ধেক লাল , অর্ধেক শাদা । খাবার পেশকশ ও সেই রকম । রেকাব এগিয়ে দেবার সময় সমানেই বলা হত তসলিম , তসলিম , আদাব আদাব । যতটা খাওয়া হচ্ছে তার বেশির ভাগই আদব কায়দায় চলে যেত  । কোথায় জানি একবার পড়ে ছিলাম, নবাব তার খাস নফরকে নিয়ে দাওয়াতে গেছেন । নিমন্ত্রণ কর্তা সবাইকে নিয়ে খেতে বসেছেন । এমন সময় তার খাস বান্দা মিহিসুরে গেয়ে উঠলো ফুলের তলে বুলবুল ছানা ,তারে উড়িয়ে দেনা উড়িয়ে দে না । এই কথা কানে যাওয়া মাত্র সেই কর্তা তার দাড়ির মধ্যে আটকে থাকা  সরু লম্বা ভাতের দানাটি ঝেড়ে ফেলে দিলেন । এদিকে আমাদের এই নবাবের ব্যাপারটা খুব মনে ধরে গেলো । তিনিও একদিন সবাইকে দাওয়াতে ডাকলেন । নফরকে বললেন শোন , সেদিন অমুক মিয়াঁ র  বাড়িতে দেখেছিলি না ওনার নফর কেমন কায়দা করছিল? তুইও ওরকম করবি , কেমন? যথাসময়ে আমাদের এই নবাব তার দাড়ির মধ্যে একটা ভাত ফেলে দিয়ে তার নফরকে ইশারা করে কেরামতি দেখাতে বললেন । আর সেই নফর তখন বলে উঠল, সেই যে কাদের বাড়িতে কিসের না কিসের কথা হয়েছিল না? আপনার দাড়িতে তাই হয়েছে ।


রইসি আরো ধরা পড়ত পানদানের আকারের ওপর । যতবড় পানদান তত বেশি রইসি । বিশেষ করে মেয়ের বিয়ের সময় বিরাট বিরাট পানদান দিয়ে পাঠানো হত । চার কাহার ডোলি সাজিয়ে যখন দুলহনকে শশুরাল ছাড়তে যেত , দেখা যেত , পালকির মধ্যে এককোণে গুটিসুটি মেরে ছোট্ট বউ বসে আছে। পুরো পালকিই জুড়ে রাজত্ব করছে বিশাল পানদান ।  জলে ভেজানো  মাটির পাতলা পাতলা ভাঁড়ে পান ঠান্ডা করে রাখা হত ।
এইছিল সেকালের মিঠে পানপাতার মতো গপ্প গাছা । চলতেই থাকে , ফুরোয় আর না । এই অঞ্চলেই গঙ্গা যমুনি তেহজিবের কেন্দ্র ছিল । তেহজিব মানে এটিকেট অযোধ্যার নবাবরা এর প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন । হিন্দু মুসলমান যৌথ ভাবে এই  তেহজিব মেনে চলত ।  বেনারস আর মথুরার ব্রাহ্মণরা সরকার বাহাদুরের পতনের পর একবছর কোন তেওহার পালন করেনি ।  
গল্প জমে উঠেছে । দেখি  আমাদের আঙুলের ফাঁকে ফাঁকে কেমন জোনাকি জ্বলে ওঠে , ইতিহাস কেমন ফিসফিসিয়ে ওঠে, নানান দিলচস্পি কিসসা কহানির মধ্যে  আসর জমে উঠছে আজ  আওয়াধের  “মীর এ আতশ” সবার অগোচরে  তার খুশির রোশনাই জ্বালিয়ে দেবেন, যদিও আমরা কেউ দেখতে তা  পাব না ।


সফদরজঙ্গের সমাধি
কাহিনি সূত্রঃ আসিফ খান দেহেলভি

3 comments: