Sunday 10 July 2016

দিল্লি দাস্তান ৩


দাদি পোতি
দাদি আম্মা, কিসসা সুনাও না । ছোট্ট রুকবানু ঝাঁপিয়ে পড়ে দাদি আম্মার কোলে।
পশমিনা শালের গরম । রঙদার কার্পেট চারপায়ার ওপর  পেতে দাদি তখন গুরগুর করে তামাক টানছে , অম্বুরি তামাকের গন্ধ , দাদির চুলের মেহেন্দির গন্ধ মিলেমিশে সে একটা ভারি মিঠে আমেজ তৈরি করেছে , রুকবানুর খুব পছন্দ । দাদির নাকে হিরের নাকছাবি , সুর্মা টানা চোখে কিসসা ঝিকঝিক করছে ।  সামনে রাখা জর্দা পানের খোপকাটা রেকাবি । ফেলে আসা আফঘানিস্তানের গল্প , তার টলটলে নীল হ্রদ , তার ওপর নীল আকাশ , ঝকঝকে রোদ্দুর , জাফরান খেত , পাহাড়ের মাথায় বরফ ,পাখতুনি গান তারপর এদেশে চলে আসা । রুকবানুর দু’চোখের নীল তারায় তার ফেলে আসা দিনের ছবি দেখতে থাকেন দাদি আম্মা ।  তারপর কোথা থেকে কি হয়ে গেলো কেউ জানে না , কেউ না ।  শুধু আজ সকালে জমজমাট হৌজ খাসে রাস্তার বাঁকে হঠাৎ চোখে পড়ল শতাব্দীর পর শতাব্দী এক ঠাকুমা আর নাতনি পাশাপাশি শুয়ে সবুজ ঘাসে ঘাসে মিশে মিশে অনন্তকাল ধরে গল্প করে চলেছে । লোকজন ভিড়ভাট্টা গরম শীত বৃষ্টি শহরের ইতিহাসের কতো পালাবদল  তাদের আলাদা করতে পারে নি । সেই চকিতে দেখা নিরালা সবুজ ঘাসের দুপুর হঠাৎ ভাসিয়ে নিয়ে গেলো ভিক্টোরিয়া পাহাড়ের মাথায় । ওয়েলিংটনের শনশনে বাতাসিয়া দুপুরে ওইরকমই এক নিরালা কোণে বসেছিল তিনজনে ঘন  হোয়ে, দাদু দিদুন আর নাতি । কতো লোক ক্যাফেটারিয়ায় মাছ ভাজা আর বিয়ার খাচ্ছিল, বাচ্চারা বল খেলছিল , সুগন্ধি গাছপালারা ছায়া দিচ্ছিল । আর ওরা নিজেদের মধ্যে খুনশুটি করছিল, সেবার ক্রিসমাসে কত্ত মজা হয়েছিল , বরফ জমা রাত, তারা ভরা রাত, বাতি জ্বলা রাত - Silent night, holy night!
All is calm, all is bright.
Round yon Virgin, Mother and Child.
Holy infant so tender and mild,
Sleep in heavenly peace,
Sleep in heavenly peace







এই দিল্লি শহরের আনাচে কানাচে পরতে পরতে দানা দানা আফসানা লুকিয়ে আছে ,তুলে নাও , কুড়িয়ে নাও , তুলোর বীজের মতো ,মেঘের মতো ,  পাখির পালকের মতো হাওয়ায় উড়ছে তারা । কোথাও বাসা বাঁধে না , কোথাও থিতু হয় না । “ছায়া দেয় , মায়া দেয় , দুঃখ দেয় , হারিয়ে যায় । স্বপ্নবীজ কাপাশের মতো রোদ্দুরে জ্যোৎস্নায় ছড়িয়ে পড়ে “ এক অদৃশ্য  স্বপ্নের চাদর মুড়ে আছে  শহরটাকে চারদিকে ব্যস্ততা , শোরগোল , হাঁকাহাঁকি , দর কষাকষি , নতুন উদ্ধত ইমারত , আধুনিক দুরস্ত মানুষ , গতিশীল যানবাহন ,ঝাঁ চকচকে জীবন,রাজনীতির কূট কচালি   এসবের মধ্যে আজও অমলতাসের হলুদ রঙা নিঝুম দুপুরে মেহেরাউলির রাস্তায় অথবা ঠিক সন্ধে নামার মুখে হজ খাস বা আজিম খান মকবারা ,  সফদারজং বা পুরানা কিল্লার আশেপাশে  ভুঁইফোড়ের মতো হাজির হবে এক উস্কোখুস্কো    দাস্তানগো । শ্যাওলাধরা গম্বুজের  গায়ে হেলান দিয়ে নিচে তুমুল শহরকে বিন্দুমাত্র  নজর না করে কুতুবমিনারেরে পেছনে ওই ডুবে যাওয়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলে চলবে





শোনো , একটা গল্প বলি । কোন এক কালে  একটা কবুতর ছিল, কুঁড়ের বাদশা ,খ্যাপাটে আর বুদ্ধু । না আছে আজকের চিন্তা , না গতকালের জন্য কোন আফসোস । হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়, মেঘের সঙ্গে গল্প করে ।আর সন্ধে হলে কোন একটা উঁচু গাছের মগডালে চড়ে ঢলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকে।
ও বলত, মেঘের ওপাশ থেকে কেউ একজন আসবে তার জন্য, তাকে নিয়ে ও চাঁদের দেশে পাড়ি দেবে । বাকি পাখিরা এসব শুনে  ওকে নিয়ে হাসাহাসি করতসময় এইরকমই  এলোমেলো ভাবে কেটে  যাচ্ছিল । কিন্তু একদিন হোলো কি , আমাদের এই পাখি একজনের সঙ্গে ধাক্কা খেল ,তারপর কি হল জানো, চোখে চোখে দেখা হল ,বুকের ধুকপুকুনি বেড়ে গেল,রক্তের তেজ বেড়ে গেল, একে অন্যের নিঃশ্বাসে জড়িয়ে গেলোআর আমাদের এই আওয়ারা কবুতরের জীবনটাই কেমন  পালটে গেলো , রামধনুর সাতটা রঙ রাঙিয়ে দিল সেই পাগলাটাকে । আমাদের কবুতর নেশা জড়ানো আধবোজা চোখে নতুন সঙ্গীকে বলে কে তুমি সুন্দরী? যাকে দেখে আমি যেন নিজেকেই হারিয়ে ফেলছি ।
আমি? আমি তো মেঘের ওপাশ থেকে এসেছি”।
“আচ্ছা বলতো, তোমার চোখের এই কাজল তুমি কোত্থেকে পেলে ? আমি যেন আগে কোথাও দেখেছি ।“
“সত্যি বলব? কাল চুরি করে এনেছি কালো মেঘের কাছ থেকে “।
“তুমি না , তুমি এক্কেবারে আমার মতো “।
“হি হি হি হি ,তোমার মতো ? কি যে বলো ? তুমি কোথাকার একটা পাগলাটে ছোকরা , উস্কোখুস্কো , চেহারা দেখেছ নিজের? এসো তো আমি ঠিক করে দি “।
এরপর দুজনায় একসঙ্গে থাকতে শুরু করে । বর্ষার টুপটাপ ঝরা জলে , ভরা শ্রাবনের ঘনঘটায়, বসন্তের রঙে , ঝরে পড়া পাতায়, সবসময় । সবচেয়ে উঁচু গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালে নতুন স্বপ্ন দিয়ে এক ঘরন্দা বানানো হল । 
এরপর জানো কী হোলো? আমাদের সেই পাগলা পরিন্দা বিলকুল বদলে গেলো । এখন শুধুমাত্র নিজের স্বপ্ন নিয়েই মেতে থাকত না । আলসেমি কুঁড়েমি  কোথায় উধাও হল ।
একদিন খুব ঝড় বাদল শুরু হল । খুব শোঁ শোঁ করে হাওয়া বইছিল । সঙ্গী বলল “ তোমাকে কয়েকটা কথা বলার ছিল “।
 “হুম, বল না , আমি শুনছি”।
“এই রাগ করবে না বলো?আমি মেঘের ওপারে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছি , সেখানে আবার ফিরে যেতে হবে,জানো? আমি তো ওদেশের রাজকুমারী । ওখানে একদিন দম আটকে এলো , আমি তাই খোলা হাওয়ায় উড়ে চললাম । তারপর তোমার সঙ্গে দেখা আর তোমার বাউন্ডুলেপনায় কেমন জড়িয়ে ভেসে গেলাম । কিন্তু এখন আমাকে যেতেই হবে । এই , তুমি শুনছ তো?”
কিন্তু আমাদের বেচারা ভালোমানুষ কবুতর তার সঙ্গীর ডানার ওমের মধ্যে ততোক্ষণে ঘুমে ঢলে পড়েছে । গভীর রাতে সবচেয়ে বড় তুফান এলো , সেই সময়ের সবচেয়ে ভয়ানক তুফান, সব কিছু ভেসে গেলো ,  সব কিছু উজাড় হয়ে গেলো । সকাল বেলা তুফান থেমে সব শান্ত হয়ে  গেলো ।





আমাদের কবুতর ঘুম থেকে উঠে  চারদিক দেখল , কিন্তু সঙ্গীকে খুঁজে পেল না ,সব জায়গায় খুঁজে খুঁজে বেড়াল , কোথাও সে নেই । আর আমাদের সেই বিন্দাস পরিন্দা যে নিজেকে নিয়েই খুশি থাকত সবসময়, সে একদম ভেঙে পড়ল, ভেঙে ভেঙে একেবারে  চুরমার হয়ে যেতে লাগলো ।


  কবুতরের গল্প আসিফ খান দেহেলভি



2 comments:

  1. কাফেটেরিয়ার শহরের উল্টো পিঠের গল্প বেঁচে থাকুক ।আপনার লেখনী জয়যুক্ত হোক।

    ReplyDelete
  2. onek dhonyobad onek bhalo laga

    ReplyDelete