জামালি কামালি
গল্প পড়ার মতোই গল্প শুনতে ততোটাই আমোদ , একেবারে নেশার
মতো । কাজেই হেরিটেজ বৈঠক শাম এ আওয়াধের
মৌতাত কাটতে না কাটতেই দাস্তানগো মানে গল্প বলিয়ে আসিফ ভাই কে ধরলাম ,
পরেরটা কবে হবে , হ্যাঁ ? আর এবারে কি
বলবে? তা বলে যে উত্তরটা এলো সেটাও আবার একেবারে আশা করিনি ।
“রাত মে তা রোঁ কে ছাও মে ,জামালি কামালি ফরেস্ট মে ভূতো
কি কহানিয়া “।
রহস্য ছমছমিয়ে উঠল । জামালি কামালি নামটাতেই যেন জমকালো শিরশিরানি ।
ঘন হয়ে উঠছে নিশুতি রাত ,
জঙ্গল ঝোপঝাড় ,তারার সলমা চুমকির চাদর , ভূত রা ঘুর
ঘুর করছে । কোনো রাতচরা পাখি মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে
।
দিল্লির খাঁজে খাঁজে কোনে কোনে গল্প ঘাপটি মেরে লুকিয়ে
আছে । শুধু তুলে আনার অপেক্ষায় ।
এ ক শনিবার
মেহেরাউলির দিকে রওনা দিলাম । গন্তব্য জামালি কামালি মসজিদ । কোন গল্প বলা টলার বৈঠক নেই, স্রেফ
নিজের কৌতূহল । বেশ খানিকটা নাকাল হবার পর একটা ডাব
ওয়ালা বলল তিন নম্বর ডাব ওয়ালা যেখানে বসেছে তার পাশের রাস্তা ধরে চলে যান । এবারে ডাব ওয়ালা গোনার পালা । ঢিবি করে রাখা আছে ডাব । তিন নম্বর সত্যি সত্যি পাওয়াও গেল । পাশ দিয়ে একখানা মাটির রাস্তা । ধুলো ধুলো । সন্ধে হয়ে আসছে , হালকা মলিন আলো । মেহেরাউলি আরকিওলজিক্যাল পার্ক আদতে
একটা ঘেরা জঙ্গল । নানান
দিক থেকে ঢুকে পড়া যায় । এই
জঙ্গলের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ঘুমিয়ে আছে
ইতিহাস । বাওলি(step well) , মকবারা , মসজিদ , বুলন্দ ইমারতের খন্ডহর । জঙ্গলের মধ্যে খানিকটা গিয়ে দেখা
পেলাম জামালি কামালির ।
চারদিকে লোকজন প্রায় নেই বললেই চলে । খুব শুনশান । হয়ত সন্ধে নেমেছে বলেই । মসজিদের লোহার গেট বন্ধ । দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক দেখছি ,
জায়গাটা কেমন যেন ভুতুড়ে মতো । লম্বা লম্বা গাছ ,ঝুপসি ঝুপ্সি ছায়া , উঁচু নিচু ঢিবি , কোন লোকজন নেই,
শব্দ নেই ।
একটা দুটো লোক দেখা যাচ্ছে ,তাদেরই একজন কাছে এসে বলল , মসজিদ তো এখন বন্ধ হয়ে গেছে । সাড়ে পাঁচটার পর কেউ আর ঢোকে না ।
ঢোকা বারণ । যেই না বলল বারণ , অমনি গন্ধটা সন্দেহজনক ।
“ কেন? কেন? “
“ঢুকলেই থাপ্পড় খেতে হবে ।”
“থাপ্পড় ?”
“ চুল ধরেও টানতে পারে । যেটা কপালে আছে ।”
আমার
বন্ধুবর(বন্ধু+ বর ) জয়ন্ত বলল , সে একটা
থাপ্পড় না হয় খেলামই ।
“একটা? একশটাও এসে পড়তে পারে । ভেতরে ঢুকলেই একটা অদ্ভুত শিরশিরানি টের পাবেন
। ব্লাড
প্রেশারের ফারাক টা বুঝতে পারবেন । ওনারা এইসময় কেউ ঢুকলে বিরক্ত হন
“কারা ? জামালি কামালি ? “
“না না , ওনারা তো সুফি সাধক ছিলেন । এই সব জায়গায় আস্তানা গেড়ে বসে আছে জিন রা । “
সত্যি সত্যি মনে হচ্ছিল পাঁচিলের ওপাশ থেকে অন্ধকার
কুঠরিগুলো থেকে কারা যেন তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে । আর ভারি বিরক্ত হচ্ছে ।
আর দাঁড়িয়ে থাকার কোন মানেই হয় না । আবার জঙ্গলের ভেতর দিয়ে খন্ডহরের ভেতর দিয়ে
বড় রাস্তায় এসে পড়ি ।
পরিত্যক্ত ভাঙা
চোরা বাড়ি ঘর নিঝঝুম লোক জন নেই এমন জায়গায় জিনেরা বাস করে । এই যেমন ধরুন ফিরোজ শাহ কোটলা । চোখ ধাঁধানো আলো তুমুল হট্টগোলের
মধ্যে বল্লেবাজি ক্রিকেট সোফায়
বসে কফি চিপস খেতে খেতে সবাই দেখে, সেই কোটলার অন্যএক
পোড়ো জংলা প্রান্তে সন্ধে নামার
আগে লোকজন অন্ধকার সব আনাচ কানাচে
বাতি জ্বালিয়ে জিনের কাছে মনের কথা জানাতে আসে । চিঠি লিখে দরখাস্ত লিখে, প্লিজ লুক
ইনটু দ্য ম্যাটার বলে দেওয়ালে সাঁটিয়ে দিয়ে আসে ।
আসিফ ভাই স্পিরিচুয়াল
তায় সুফি । তার
সঙ্গে এসব জায়গায় ঘুরলে অনেকেই নাকি
গোলাপের চন্দনের গন্ধ পায় । অথচ ধারে কাছে কোন ধূপ বা সুগন্ধি নেই ।
তবে সেও নাকি বলে এইসব বৈঠকে লম্বাচুল ভালো করে বেঁধে
আসতে হবে আর কোনো পারফিউম মাখা চলবে না কারণ ওই দুটোই জিনদের খুব আকর্ষণ করে । মানুষের মধ্যে যেমন ভালমন্দ
,জিনদের মধ্যেও তাই । মন্দ জিনকে চটিয়ে লাভ কি !
কৌতূহল এমন মারাত্মক হয়ে উঠলো যে আবার পরের দিন ঠিক দুপুর বেলা ভূতে মারে ঢ্যালা
অর্থাৎ প্রচণ্ড ঝলসানো গরমে রোদ্দুরে গিয়ে দেখি মসজিদের গেট খোলা , তেতে পুড়ে ঝামা
হয়ে আছে পাথরের চত্বর । পা
দেওয়া যাচ্ছে না । চারদিক
শান্ত , ভীষণ শান্ত । সন্ধের নিভে যাওয়া আলোয় যাকে দেখে গা ছমছম করে উঠেছিল সেই
প্রশস্ত দালান আর অপূর্ব নকশা তোলা বন্ধ
দরজা গুলো যেন বলছে ,বসে দুদন্ড জিরিয়ে নাও বাপু ।
জামালি ছিলেন এক
সুফি সন্ত এবং কবি। কামালির পরিচয় নিয়ে ধন্দ আছে । পাগল বাবরালির চোখের মত এলোমেলো আকাশের নিচে
জামালি কামালি মসজিদ , মেহেরাউলির জঙ্গল
,বিস্তীর্ণ ধ্বংসস্তূপ, প্রশস্ত বাওলি
জুড়ে শুধু পড়ে আছে
স্তব্ধতা । অখণ্ড নীরবতা । এক সন্ত কবির
প্রার্থনা। সেখানে যার কণ্ঠস্বর শোনা যায় তাতে কোন শব্দ নেই ,শুধু
অনন্তের স্তবগান , যে শুনতে চায় সেই কেবল
শুনতে পায় । আর কেউ
নয় ।
চন্দন রঙের আলো বুকে নিয়ে যে
মানুষ একা হেঁটে যায়
তুমি তাকে ডেকেছ কখনও?
তার কাছে বৃষ্টি আছে । আছে
দিন বদলের গান ।
ডাকো, তাকে ডেকে নাও কাছে
রয়েছে আখর যত শুদ্ধতম স্পর্শ দিয়ে
শোনো...।
কবিতা রেহান কৌশিক
আহা।যেন চন্দন রঙের গান!
ReplyDeleteভালবাসা নেবেন
ReplyDelete