Thursday 27 October 2016

দিল্লি দাস্তান ৫


শিকারগাহ
বেশ ঘুসঘুসে ঠান্ডা পড়ত , জম্পেশ করে আংরাখা পশমিনা গায়ে দিয়ে সুলতান আমির দের দল শিকারগাহ তে( হান্টিং লজ)  গিয়ে উঠতেন । শিকারগাহ এর চারদিক খোলা , প্রচুর রোদ হাওয়া , অনেকগুলো সিঁড়ি বেয়ে  খোলা চত্বরটায় উঠতে হয়। আবার গর্মির দিনেও কোন অসুবিধে নেই , চারদিকে সুন্দর গাছ গাছালির ফুরফুরে মিঠে হাওয়া , পাখিরা না চাইতেই শিস দিত , শীতকালে আগনগারের ধিকিধিকি আগুন , অম্বুরি তামাকের বুড়বুড়ি , আর গরমে আম পান্নার সরবত , ইস্পাহানি কার্পেটে দাবার ঘুঁটি , শের শায়েরি ।
পুরাকালে শরতকালে রাজারা মৃগয়ায় বের হতেন । সে রকমই শখের শিকার নবাব সুলতানরা হামেশাই করতেন হয়তো এবং সবচেয়ে বড় কথা এই শিকারের জন্য খুব বেশি কাঠখড় পোড়াতেন না বলে মনে হয় কারণ দিল্লির মধ্যেই প্রায় গোটা চারেক শিকারগাহ দেখতে পাচ্ছি ।
নিচে অনেকগুলো কুঠুরি আর জল নিকাশের ব্যবস্থা দেখে মনে হয় এগুলোতে  শিকার করে আনা পশু পাখি জবাই করে রান্না করা হত, কাবাব বানানো হত , আর উঁচু সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে খানসামার  দল সেই ধোঁয়া ওঠা খুশবুদার খানা পরিবেশন করে আসত । এইসব করতে করতে রাত কাবার । কয়েক পাত্তর সিরাজি ।  কখনো দুএক দিন থেকেও যাওয়া হত । ব্রিটিশ আমলের ইন্সপেকশন বাংলোর প্রথম সরলীকৃত চেহারা বোধহয় শিকারগাহ ।
ফিরোজ শাহ তুঘলক শিকারপ্রিয় ছিলেন কিনা জানি না । তার নিজের লেখা ফুতুহাত এ ফিরোজশাহিতেও এ ব্যাপারে কিছু বলেন নি তিনি । একটা হালকা সূত্র ছেড়ে গেছেন , তিনি আমির ওমরাহদের চটাতে চাইতেন না । তার আমলে তৈরি তিনটি চারটি হান্টিং লজ দিল্লিতে আছে । এখানে হয়তো ওমরাহ্‌রা মাঝে মাঝেই দিলখুশ করতে , গুলতানি করতে আসত
তিনমূরতি ভবনের চৌহদ্দির মধ্যে আছে কুশক মহলওই লম্বা খা ড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে বসে পড় । শেষ ধাপে উঠেই মনে হল আরে এটা তো আমার  জায়গা সাদাসিধে গড়ন এবং বেশ ছড়ানো ছিটানো মজলিশি ধরনের ।   বেশ জায়গাটা , ল্যাপটপ , কফি স্যান্ডউইচ নিয়ে ঘন্টা কয়েক দিব্যি কাটিয়ে দেওয়া যায় । কেউ বিরক্ত করবে না , ট্যুরিস্ট যদিও আসে, তিন মিনিটের বেশি থাকবে না , সেলফিও তুলবে না । অথচ আমি জানি আমার সামনে এখনি খসে খসে  পড়বে ওই লতানে গাছটার হলুদ ফুল, লেজ নাচিয়ে পাখিরা আসবে , শ্যাওলা ধরা খোলা চাতালে আমার সঙ্গে আমি থাকব, আর কেউ না ।




কুশক মহল ছেড়ে এবার যেদিকে চললাম সেটা কিছুটা চমকপ্রদ । হান্টিং ছাড়াও এটা আবার দিল্লির অন্যতম হন্টেড হাউস ও বটে । ভুলিভাটিয়ারি কি মহল । ঘন ঠাসা  জঙ্গলের মধ্যে যখন ঢুকলাম মনে হল লম্বাপানা  কেউ তার লম্বা  চুল খুলে সাদা শিফনের সাড়ি পরে একখানা মোমবাতি জ্বালিয়ে একটু একটু করে দেখা দিচ্ছে আর গাইছে ,”ও ভুলি দাস্তান , লো ফির ইয়াদ আ গয়ি” ।।
কেউ বলে বু আলি বাখতিয়ারি নামে এক সাধুর নাম থেকে ভেঙেই এই নাম । আবার শোনা যায় ভাটিয়ারিন বা রাজস্থানের আদিবাসী মেয়ে পথ হারিয়ে এই খানে আস্তানা গেড়ে ছিল । আবার  বু আলি ভাট্টি নাকি এখানকার মহিলা কেয়ার টেকার ছিল , আর আত্মা নাকি আজও ঘুরঘুর করে বেড়াচ্ছে । এখন ভুলি ভাটিয়ারিতে দিনমানে একা যাওয়া যায় না , বেশ গা ছমছমে , খন্ডহর আর জঙ্গল ।  মজবুত প্রাচীর দিয়ে ঘেরা , অনেক ছোট্ট ছোট্ট কুঠুরি , কি হত কে জানে, দারোয়ান রান্নার বাবুর্চি খানসামা এরা সব থাকত বোধহয় ।  মচমচ করে আমাদের পায়ের শব্দ হচ্ছে । ও হরি , মূল দরজার সামনে দাঁড়ানো মাত্র দেখলাম স্কুল পালানো এক দঙ্গল বখাটে ছেলেমেয়ে কোন খান থেকে বেড়িয়ে ফুড়ুৎ করে পালিয়ে গেলো আর আমাদের সঙ্গীর মুখ থেকে বেরিয়ে এলো ,  তওবা , কেয়া জমানা।



এরপর চল্লাম আরেক শিকারগাহ দেখতে । সেটাও ওই ফিরোজশাহ বানিয়েছেন । এটা আবার দোতলা, সিলিন্ড্রিকাল । এখানে নাকি অবসারভেটরিও  ছিল ।  খুব সাদামাটা গঠন । শিকারগাহ তে কারিকুরি নকশা করে  লাভ কিছু নেই । প্রত্যেকটাই খুব কাঠখোট্টা , ফাংশানাল । এবারেরটা বেশ মজার । এটার নাম পীর গায়েব ।সত্যি  একজন পীর এখানে তার সাধনার জায়গা বানিয়েছিলেন আর একদিন নাকি হঠাত রহস্য জনকভাবে কোথায় অদৃশ্য হয়ে যান , কেউ আর তাকে দেখতে পায়নি । আজও প্রচুর লোকসমাগম হয় ,দূর দূরান্ত থেকে লোক আসে , প্রার্থনা করে, একটা দমবন্ধ ঘুপচি সরু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে দেখি অপ্রশস্ত ঘরে জ্বলছে একটা প্রদীপ । আর নিচ থেকে এখানকার দেখভাল করেন  এক হিন্দু মহিলা তারস্বরে চেঁচাচ্ছেন  জুতা খোলকে, জুতা খোলকে ।




কোথা থেকে কে কখন সুতোয় টান দেয় বোঝা  মুশকিল । শিকারগাহ কুশক মহল যে আমাদের ভালবেসে ফেলেছে সেটা বুঝলাম ওই টান থেকে । আহা রে, সুলতান মুঘল এমনকি সাহেবরা চলে যাবার কেউ বিশেষ আড্ডা মজলিশ বসায় নি বোধহয় ।
“মাস আলা যব ভি চিরাগোঁ কা উঠা
ফ্যায়সালা সিরফ হাওয়া করতি হ্যাঁয়”(পরভিন শাকির)
তা এখানে শুধু হাওয়া নয় , শ্যাওলা ধরা  চওড়া ছাদটা , ছাদ ছুঁয়ে নেমে আসা নিম গাছটা, বুড়ো অশ্বত্থ গাছ ,   সবুজ পাতা আর রোদের ঝিলিমিলি সবাই ঠিক করে দিল যে আমাদের একবার ওখানে বসে গুলতানি করাটা খুব দরকার। বেশ শরত কালের আবহাওয়া । নিমগাছের ছাতার তলায় সেই তুঘলকি চাতালে বসে ছাদের আলসেতে মাথা ঠেকিয়ে আধশোয়া হয়ে ভারি একটা আমোদ পেলাম । হঠাত দেখি একদল লোক এসেছে , তাদের সঙ্গে যেন অরুণা চলের  জঙ্গল থেকে ধনেশ পাখি এসে হাজির হয়েছে । তার একটা ছবি নিলাম । কতকালের শিকার গাহ , কতো কাহিনির পটভূমি । বাড়িটারও মনে হল আমাদের পেয়ে সে খুশি বেশ  হয়েছে । চা , স্যান্ডউইচ খাওয়া হয়ে গেলো, দেদার কবিতা পড়া হয়ে গেলো , ঝিমনোও হয়ে গেলো । এবারে যেতে হয় । ইয়া বড় বড় পাথুরে সিঁড়ি একটু এবড়ো খেবড়ো ।
সিঁড়িটাও যেন বলে উঠল, ধীরে ধীরে চলো , বাছা । এখন তো আর সে মানুষ নেই , আর বড় বড় পাও নেই । সাবধানে আস্তে আস্তে নামো ।

ধীরে ধীরে চল চাঁদ গগনমে
কহিঁ ঢল না যায়ে রাত,টুট না যায়ে সপনে...।














2 comments:

  1. এই লেখাটিও কফি স্যান্ডউইচ সহকারে ঐ জায়গায় বসে পড়তে সাধ হচ্ছে!

    ReplyDelete