Thursday 27 October 2016

আলতাফি কিসসা/২


 রা অক্টোবর । গান্ধিজি ছাড়া আমার এক বন্ধুর জন্মদিন । সেদিন আমার খুব তাড়া । বাড়ি থেকে বেরুব । এমন সময় শিবানীর ফিনফিনে ফোন ,”ম্যাডাম ,আজ আমার জন্মদিন
আমিও একটা জন্মদিনের নেমন্তন্ন তেই যাচ্ছি কিনা , বললাম খুব ভালো কথা , ভালো থেকো , সুখে থেকো ..মেনি মেনি হ্যাপি রিটারন্স
কিন্তু সে তখন হু হু করে কাঁদছে । কেন গো ? গান্ধিজির সঙ্গে কেমন মিলিয়ে দেওয়া জন্মদিন । আরও আরও হু হু । , তাই বল ? গান্ধিজি না হয়ে ঋত্বিক রোশন হলে ভালো হত বলছ ? তবে এখন তো লেটেস্ট হার্ট থ্রব ফাওয়াদ খান , সেখানে আবার নানান পোলিটিকাল ঝামেলা , সে যাক গে , তুমি দুঃখ কর না ।
আমি খুব অসুস্থ , খুব শরীর খারাপ , “ঝমঝমিয়ে কান্না ,হু হু হু ।
একেবারেই বাচ্চা মেয়ে , বাড়ি থেকে বহুদূরে দিল্লিতে একা থাকে , চাকরিতে ঢুকেছে সবে পড়াশোনা শেষ করে ।
বললাম , আমার এখানে চলে এসো , আমি থাকছিনা , কিন্তু কোন অসুবিধে হবে না ।
ও বোধহয় সেটাই চাইছিল । বলল , ঠিকানা টা একবার বলে দিন , আমি ক্যাব নিয়ে চলে যাচ্ছি ।
আচ্ছা আচ্ছা ,বলছি ।
সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে হল , আরে , আরও একজনের গলা শুনতে পাবার কথা ছিল যেন , সেই পরোপকারী দিলদরিয়া আজ অনুপস্থিত কেন ?
কথার রেশ তখনো মিলিয়ে যায় নি , মোবাইল টা আবার বেজে উঠল , “ম্যাডাম , বাড়ির ঠিকানাটা বলুন প্লিজ , শিবানী যাচ্ছে তো , আমি যেতে পারছি না , আব্বু খুব অসুস্থ
হ্যাঁ , ঠিক । আমার ক্যালকুলেশন একেবারে ঠিক । জনাব আলতাফের গলা ।
এরপরই শিবানীর ঝটিকা আগমন এবং আমার নির্গমন ।
দিনটা কিন্তু ভয়ানক বাজে ছিল । অসম্ভব গরম । আমি ঝরঝর করে ঘামছি । ক্লান্ত হয়ে পড়ছি দ্রুত । ইশ , শিবানীর জন্য একটা কেক কিনলে হত । দেখেছ কেকের দোকান টা বন্ধ । শুধু কেক নয় , বহু দোকান বন্ধ । চিড়বিড়ে গরমে দেখতে পাচ্ছি না একটাও ফুলের দোকান । যাক গে , আমি আর পারছি না । মাথা ঘুরছে , বাড়ি যাই ।
বাড়ি ফিরে দেখি মুঙ্গ ডাল কি খিচড়ি খেয়ে শিবানী ঘুমিয়ে পড়েছে । আমি ধড়াম করে শুয়ে পড়লাম ।
ঘুম যখন ভাঙল , একটা অস্পষ্ট গলার শব্দ যেন শুনতে পাচ্ছি । সন্ধে হয়েছে । গীতাজি খুচরো কাজ করছে , বসার ঘরে একটা মস্ত ফুলের তোড়া ।
আলতাফ ভাই লায়া ,ওই ঘরে বসে আছে তো
ঘরে ঢুকে দেখি শিবানী উঠে বসে বেশ হাসি হাসি মুখে আলতাফের সঙ্গে কথা কইছে , আর আলতাফের বিখ্যাত কফি আর মারি গোল্ড বিস্কুট খাচ্ছে । বললাম , আরে আলতাফ , ফুলের বুকে টা ওকে দাও ।
আলতাফ চলে যাবার সময় আমাকে খুব করে থ্যাংকস জানালো , আমি শিবানীর খুব ভালো দেখভাল করেছি বলে । ও যেন শিবানীর বাবা , কাকা , দাদা ।
শিবানী বলল , জানেন , আলতাফ ভাই না একটা পাঁচশ টাকার নোট আমার মাথায় ছুঁইয়ে আমার হাতে দিল , আমি বললাম , এ এবার কি? আমরা তো বন্ধু , একই বয়স , একসঙ্গে কাজও করি । আলতাফ ভাই বলল তুমি আমার মেয়ে । কি অদ্ভুত বলুন তো?”
আমি খুব লজ্জা পেলাম ।চুপ করেই থাকলাম । গান্ডে পিণ্ডে নেমন্তন্ন খেয়ে দোকানপাট বন্ধ , উফ কি অসভ্যের মতো গরম এইসব ফাঁকা অজুহাত দিয়ে বাড়িতে এসে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম । আর একটা ছেলে বাবার খুব খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও সহকর্মী বন্ধুর দেখভাল করল , ফুলের দোকান ও খুঁজে পেল , আবার টাকা দিয়ে আশীর্বাদ জানিয়ে সন্ধে বেলা
তাকে দেখেও গেল ।
নিস্তব্ধতা ভাঙল শিবানী । আলতাফভাই এর সেই গল্পটা জানেন আপনি। ?”
কোনটা?
জানেন তো , আলতাফভাই না একজনকে ভীষণ ভালবেসে ফেলেছিল । ওদের ধর্মেরই । কিন্তু কিছুতেই মুখ ফুটে বলতে পারেনি , অনেক চেষ্টা করেছিল । কিন্তু পারেনি । একদিন ফুটপাথ দিয়ে হাঁটছে , হঠাত দেখে ওই মেয়েটা একটা দামি গাড়িতে করে পাশ দিয়ে হুশ করে বেরিয়ে গেল , আর আলতাফভাইও হুঁশ ফিরে হঠাত ই যেন বুঝল দুজনের সমাজে অনেক অনেক ফারাক ।
গল্পটা কেমন হিন্দি ফিল্ম মার্কা হয়ে গেল না?”
তবে হ্যাঁ , Life is more interesting than fiction .
তারপর শুনুন না , আলতাফভাই এর আম্মি তো আমাদের দেখলেই বলেন আমার বেটার সাদির জন্য মেয়ে দেখ না , ওর জন্য মেয়ে পাওয়া তো খুব শক্ত ।
একদিন হয়েছে কি , আলতাফ আমার বাড়িতে এক প্যাকেট মিষ্টি নিয়ে হাজির।
মিষ্টি কেন? তোমার সালগিরাহ নাকি ? না অন্য কোন খুশ খবর ?”
আলতাফ বলল , আগে একটা মিঠাই খাও । তারপর বলব ।
শিবানী মিঠাই খেল এবং মুখ তুলে দেখল আলতাফের চোখদুটো চিকচিক করছে
আজ উসকি ডোলি নিকাল গয়া ... নিকাহ হো গয়া । ওর এই খুশি আমি বাঁটতে এসেছি , মিঠাই নাও
না , আলতাফভাই , এমন ভাবছ কেন? তুমিও কাউকে খুঁজে পাবে , দেখো ।
না মুমকিন
কেন? এরকম ভাবতে নেই , ভাই
এই রকম দিন আমার জীবনে আসবে না । কেন জান?
ম্যায় দিলপে তালা লগাকে চাবি বহত দূর ফেক দিয়া
দূরত্বটা বোঝাবার জন্য শিবানী ছুঁড়ে ফেলার ভঙ্গি করে দেখিয়েছিল , আলতাফকে নকল করে ।

আমার কাছে এখনো পড়ে আছে
তোমার প্রিয় হারিয়ে যাওয়া চাবি
কেমন করে তোরঙ্গ আজ খোলো ?

অবান্তর স্মৃতির ভিতর আছে
তোমার মুখ অশ্রু ঝলোমলো
লিখিও উহা ফিরত চাহো কিনা

কবিতাঃ শক্তি চট্টোপাধ্যায়




2 comments: