Thursday 27 October 2016

দিল্লি দাস্তান ৬

জিন ও পীর


মার প্রার্থনা এর আগেও আপনাকে জানিয়েছি , আবার জানাচ্ছি। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আমি বারবার আপনার কাছে ফিরে আসছি। আপনার তো কিছুই অজানা নয় । কয়েক বছর হল দোকান টা আর চালাতে পারছি না । প্রচুর মালপত্র চুরি হয়ে গেছে , ধার দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি ।জিনিশপত্র বিক্রি করা শুরু করেছি । তার ওপর শরীরের অবস্থাও ভালো নয় । এই সময়ে যদি কিছু সুরাহা না করেন তাহলে তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে । আমার অগাধ বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই আমাকে সাহায্য করবেন। আমার নাম অমুক ঠিকানা তমুক , ফোন নম্বর...।
এ ফোর সাইজের কাগজটায় গোটা গোটা পরিষ্কার ছাঁদে লেখা একখানা চিঠি । মনে হতে পারে কোন বড়লোক হোমরা চোমড়া কেউ বা রাজনৈতিক দাদা , যারা দান খয়রাতি করে থাকে আমাদের গরিবগুরবোদের ,তাদেরই কারুর উদ্দেশে এই পত্র ।
এই চিঠিটা যখন চোখে পড়ল, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে । একটা কমলাটে আলো প্রায় অন্ধকার কুঠরিটার মধ্যে তেরছা হয়ে ঢুকেছে । কুঠরিটার ছাদে ঝুলে আছে অজস্র বাদুর । নিচের পাথুরে মেঝে কালো হয়ে গেছে প্রদীপের পোড়া তেলে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ি, ধূপের ছাই । না, কোনো পীরের মাজার বা দরগা নয় । চিঠিটা লেখা হয়েছে জিন কে উদ্দেশ্য করে। জায়গাটার নাম কোটলা ফিরোজ শাহ। এককালে ফিরোজশাহ তুঘলকের প্রাসাদ । তার চারদিক ঘিরে ঝাঁ চকচকে শহরের তুমুল ব্যস্ততা , সরগরম রাজধানী ।
William Dalrymple এর সিটি অফ জিনস এর পর বিশেষ কিছু লিখলাম না, শুধু নিজে যে টুকু দেখেছি তাই লিখলাম ।




বেস্পতি আর শুক্কুরবারে খুব ভিড় হয় । খুব জাগ্রত পীর বাবা । মানত পুরো হলে বাবাকে দিতে হয় আস্ত একটা মটকা । মটকা পীরের(THE SAINT OF EARTHEN POT) দরগায় গাছে গাছে মাটিতে মাটিতে সর্বত্র মটকা ।বারো শতকের সুফি সন্ত খুশি হবেন যদি মটকার সঙ্গে ছোলা , গুড় আর দুধ দেওয়া হয় । হজরত শেখ আবু বকর তুসি হাইদরি কালান্দরি এসেছিলেন ইরানের তুসি জেলা থেকে আর নাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কালান্দরি গোষ্ঠীর ছিলেন । শান্তির বাণী ছড়াতে ছড়াতে সুদূর ইরান থেকে তাঁর আগমন । আজ প্রগতি ময়দানের কাছে উঁচু টিলার ওপর যেখানে তাঁর দরগা সেটা আগে জঙ্গল ছিল,যমুনা বয়ে যেত পাশ দিয়ে । পীর বাবা একদিন দেখলেন একটা লোক জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে চলেছে । অসুখ আর সারে না তাই । বাবা তাকে শান্ত করলেন , তারপর মটকা থেকে জল খেতে দিলেন। লোকটা সেরে গেলো । এবং বাবার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল । এদিকে হয়েছে কি , গিয়াসুদ্দিন বলবন তখন সুলতান , তিনি স্বভাবতই দাম্ভিক । বাবাকে পরীক্ষা করার জন্য ছোলা আর গুড়ের জায়গায় ছোট ছোট লোহার বল আর খানিকটা কাদার তাল খুব জাঁক করে পাঠিয়ে দিলেন । বাবার চেলারা সুলতানি জাঁক দেখে খুব খুশি , না জানি কি এসেছে । কিন্তু ঢাকা খুলে দেখেই তো তারা চটে লাল ।পীর বুঝলেন সুলতান তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছে । তিনি প্রার্থনায় বসলেন , সেই লোহার বলগুলো হয়ে উঠল ভাজা ছোলা আর কাদার তাল হয়ে গেলো গুড় । বাবা তখন গ্রাম থেকে কিছু দুধ আনালেন। দুধে গুড় মিশিয়ে ছোলার সঙ্গে সবাই কে খাওয়ালেন । সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে । সব ধর্মের লোকেরা এখানে আসে । বলবন আবার পরে শ্বে তপাথর টাথর দিয়ে জায়গাটা বাঁধিয়ে দেয় । বাবার নাম লেখা জায়গাটায় খোঁচাখোঁচা বাংলা হরফ চোখে পড়ল ।
কিন্তু এজায়গাটার স্থান মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তো শুধু ধর্মে আটকে থাকলে চলবে না ।একটু বাসনা প্রবণ হতে হবে । বাসনার সেরা বাসা রসনার সঙ্গে বাবু খানকেও স্মরণ করতে হবে । ইনি হলেন শাহী বাবুর্চির বংশধর । বাবু শাহী বাবুর্চির পূর্ব পুরুষ রা ছিল খোদ সম্রাট শাহজাহানের শাহী রসুই আর দস্তরখানের দায়িত্বে । আর শাহজাহানের রইসি তো প্রবাদের মতো । দিল্লির সেরা বিরিয়ানি আর কোর্মা খেতে হলে এই মটকা পীর দরগায় মাথা ঠুকতে আসতে হবে । যারা জোমাটো খুঁজে দেখতে ভালোবাসে দেখুক তারা । সারা রাত্তির ধরে শীতকালে নেড়ে নেড়ে ঘুঁটে ঘুঁটে তৈরি হয় শাবদাগ ,মাংসের কিমা দিয়ে বানানো আরেকটার নাম তারকালিয়া । সব রেসিপিগুলো বংশানুক্রমে বয়ে চলেছে । বাবু খানের দোকানের চারটে ছেলে মৌর্য শেরাটনে রাঁধে । এদের এখানে একসময় কে না খেয়ে গেছেন শাহনাজ হুসেন, জেনারেল মানেকশ, মনসুর আলি পতৌদি ।
গাছের শুকনো ডালে ডালে রাশি রাশি মটকা , তার নিচে বড় বড় ডেকচিতে গরম গরম বিরিয়ানি আর কোর্মা । না কোন সাজ সাজাওট । না কোন বনাওট , মেহেন্দি , চুনুরি, আসল সুন্দরীকে আবার সাজতে হয় নাকি !





2 comments: