জিন ও পীর
“আমার প্রার্থনা এর আগেও আপনাকে জানিয়েছি , আবার
জানাচ্ছি। নিতান্ত নিরুপায় হয়ে আমি বারবার আপনার কাছে ফিরে আসছি। আপনার তো কিছুই
অজানা নয় । কয়েক বছর হল দোকান টা আর চালাতে পারছি না । প্রচুর মালপত্র চুরি হয়ে
গেছে , ধার দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছি ।জিনিশপত্র বিক্রি
করা শুরু করেছি । তার ওপর শরীরের অবস্থাও ভালো নয় । এই সময়ে যদি কিছু সুরাহা না
করেন তাহলে তো রাস্তায় গিয়ে দাঁড়াতে হবে । আমার অগাধ বিশ্বাস আপনি নিশ্চয়ই আমাকে
সাহায্য করবেন। আমার নাম অমুক ঠিকানা তমুক , ফোন নম্বর...।“
এ ফোর সাইজের কাগজটায় গোটা গোটা পরিষ্কার ছাঁদে লেখা একখানা চিঠি ।
মনে হতে পারে কোন বড়লোক হোমরা চোমড়া কেউ বা রাজনৈতিক দাদা , যারা
দান খয়রাতি করে থাকে আমাদের গরিবগুরবোদের ,তাদেরই কারুর
উদ্দেশে এই পত্র ।
এই চিঠিটা যখন চোখে পড়ল, তখন সূর্য প্রায় অস্ত যাচ্ছে ।
একটা কমলাটে আলো প্রায় অন্ধকার কুঠরিটার মধ্যে তেরছা হয়ে ঢুকেছে । কুঠরিটার ছাদে
ঝুলে আছে অজস্র বাদুর । নিচের পাথুরে মেঝে কালো হয়ে গেছে প্রদীপের পোড়া তেলে,
ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ফুলের পাপড়ি, ধূপের ছাই । না,
কোনো পীরের মাজার বা দরগা নয় । চিঠিটা লেখা হয়েছে জিন কে উদ্দেশ্য
করে। জায়গাটার নাম কোটলা ফিরোজ শাহ। এককালে ফিরোজশাহ তুঘলকের প্রাসাদ । তার চারদিক
ঘিরে ঝাঁ চকচকে শহরের তুমুল ব্যস্ততা , সরগরম রাজধানী ।
William Dalrymple এর সিটি অফ জিনস এর পর বিশেষ কিছু
লিখলাম না, শুধু নিজে যে টুকু দেখেছি তাই লিখলাম ।
২
বেস্পতি আর শুক্কুরবারে খুব ভিড় হয় । খুব জাগ্রত পীর বাবা । মানত
পুরো হলে বাবাকে দিতে হয় আস্ত একটা মটকা । মটকা পীরের(THE SAINT OF EARTHEN
POT) দরগায় গাছে গাছে মাটিতে মাটিতে সর্বত্র মটকা ।বারো শতকের সুফি
সন্ত খুশি হবেন যদি মটকার সঙ্গে ছোলা , গুড় আর দুধ দেওয়া হয়
। হজরত শেখ আবু বকর তুসি হাইদরি কালান্দরি এসেছিলেন ইরানের তুসি জেলা থেকে আর নাম
থেকেই বোঝা যাচ্ছে তিনি কালান্দরি গোষ্ঠীর ছিলেন । শান্তির বাণী ছড়াতে ছড়াতে সুদূর
ইরান থেকে তাঁর আগমন । আজ প্রগতি ময়দানের কাছে উঁচু টিলার ওপর যেখানে তাঁর দরগা
সেটা আগে জঙ্গল ছিল,যমুনা বয়ে যেত পাশ দিয়ে । পীর বাবা একদিন
দেখলেন একটা লোক জলে ডুবে আত্মহত্যা করতে চলেছে । অসুখ আর সারে না তাই । বাবা তাকে
শান্ত করলেন , তারপর মটকা থেকে জল খেতে দিলেন। লোকটা সেরে
গেলো । এবং বাবার সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল । এদিকে হয়েছে কি , গিয়াসুদ্দিন বলবন তখন সুলতান , তিনি স্বভাবতই
দাম্ভিক । বাবাকে পরীক্ষা করার জন্য ছোলা আর গুড়ের জায়গায় ছোট ছোট লোহার বল আর
খানিকটা কাদার তাল খুব জাঁক করে পাঠিয়ে দিলেন । বাবার চেলারা সুলতানি জাঁক দেখে
খুব খুশি , না জানি কি এসেছে । কিন্তু ঢাকা খুলে দেখেই তো
তারা চটে লাল ।পীর বুঝলেন সুলতান তাঁর পরীক্ষা নিচ্ছে । তিনি প্রার্থনায় বসলেন ,
সেই লোহার বলগুলো হয়ে উঠল ভাজা ছোলা আর কাদার তাল হয়ে গেলো গুড় ।
বাবা তখন গ্রাম থেকে কিছু দুধ আনালেন। দুধে গুড় মিশিয়ে ছোলার সঙ্গে সবাই কে
খাওয়ালেন । সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে । সব ধর্মের লোকেরা এখানে আসে । বলবন আবার
পরে শ্বে তপাথর টাথর দিয়ে জায়গাটা বাঁধিয়ে দেয় । বাবার নাম লেখা জায়গাটায়
খোঁচাখোঁচা বাংলা হরফ চোখে পড়ল ।
কিন্তু এজায়গাটার স্থান মাহাত্ম্য সম্যক উপলব্ধি করতে হলে তো শুধু
ধর্মে আটকে থাকলে চলবে না ।একটু বাসনা প্রবণ হতে হবে । বাসনার সেরা বাসা রসনার
সঙ্গে বাবু খানকেও স্মরণ করতে হবে । ইনি হলেন শাহী বাবুর্চির বংশধর । বাবু শাহী
বাবুর্চির পূর্ব পুরুষ রা ছিল খোদ সম্রাট শাহজাহানের শাহী রসুই আর দস্তরখানের
দায়িত্বে । আর শাহজাহানের রইসি তো প্রবাদের মতো । দিল্লির সেরা বিরিয়ানি আর কোর্মা
খেতে হলে এই মটকা পীর দরগায় মাথা ঠুকতে আসতে হবে । যারা জোমাটো খুঁজে দেখতে ভালোবাসে
দেখুক তারা । সারা রাত্তির ধরে শীতকালে নেড়ে নেড়ে ঘুঁটে ঘুঁটে তৈরি হয় শাবদাগ ,মাংসের
কিমা দিয়ে বানানো । আরেকটার নাম তারকালিয়া
। সব রেসিপিগুলো বংশানুক্রমে বয়ে চলেছে । বাবু খানের দোকানের চারটে ছেলে মৌর্য
শেরাটনে রাঁধে । এদের এখানে একসময় কে না খেয়ে গেছেন শাহনাজ হুসেন, জেনারেল
মানেকশ, মনসুর আলি পতৌদি ।
গাছের শুকনো ডালে ডালে রাশি রাশি মটকা , তার
নিচে বড় বড় ডেকচিতে গরম গরম বিরিয়ানি আর কোর্মা । না কোন সাজ সাজাওট । না কোন
বনাওট , মেহেন্দি , চুনুরি, ।
আসল সুন্দরীকে আবার
সাজতে হয় নাকি !
সপ্তাহান্তে জিভে জল!
ReplyDeleteshukriya karam
ReplyDelete