Sunday 7 September 2014

চাষ নালার মেয়ে


বীন্দ্রনাথের “রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি “ এই লাইনটাকে এখন এভাবেও বলা যেতে পারে “ পুরুষ হস্ত করে সমস্ত রমণীর ধন চুরি “ (বাসুদেব দেবের লেখা) ।
এখানে রাজা বা পুরুষ এই শব্দের দ্যোতনা আসলে  মনোভাব , কতগুলো চারিত্র লক্ষণ । আগ্রাসী চিন্তা, লোভ, লালসা ,  রিরংসা ,ভোগ ,ক্ষমতার আস্ফালন , দম্ভ । যাকে বলা হচ্ছে পুরুষালি মনোভাব । মাসকুলিনিটি । এর বিপরীতে নারী প্রকৃতি , নারীমনোভাব  । সংবেদনশীলতা ,সহনশীলতা , সহমর্মিতা , স্নেহ ,মমত্ব, পালন পোষণ ধারণ ও একটি অনুভবী মন  । মেয়েলিপনা নয় কিন্তু ।
মধ্যবিত্ত বলতে যেমন বিত্তের থেকে মানসিকতাকেই বোঝায় , সেই রকমই পুরুষালি মনোভাব বা নারী মনোভাবের সঙ্গে লিঙ্গের সম্পর্ক নেই । একজন নারীও হতে পারেন পুরুষালি মনোভাব সম্পন্ন । বা একজন পুরুষ ,নারী মনোভাবাপন্ন  । ব্যক্তিত্বের মধ্যে লালিত হয় নারী  বা পুরুষ প্রকৃতি ।নেপথ্যে হয়ত থাকে  মানসিক গঠন, শিক্ষা ,সংস্কার, মূল্যবোধ ,সংস্কৃতি ।  সৃজনশীলতা বা ক্রিয়েটভিটির একটা উৎস এই নারী মনোভাব যা সূক্ষ্ম অনুভূতি গুলোকে ছুঁয়ে যেতে পারে অনায়াসে । সেই আবার একজন ভাল মানুষ হয়ে উঠতে পারে সহজে । মানবিক গুণ আর নারী মনোভাবের মধ্যে  দুস্তর ফারাক নেই ।
পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা ভাবনা সেই দিক থেকে মানবিক মূল্যবোধ থেকে অনেক দূরে ।
এই যে পুরুষ তন্ত্রের রমরমা বাজার,  তার সাফল্যের জন্য  মেয়েদের পুরুষালি মনোভাবের ভূমিকা লক্ষণীয় ।  উল্টো দিকে ঠিক তেমনি একজন পুরুষ তার নারী মনোভাব দিয়ে একটি মেয়ের অনুভূতির গভীর থেকে গভীরতর কেন্দ্রে পৌঁছুতে অবশ্যই পারেন । তা যত বেশি হয় ততই সমাজের মঙ্গল ।
কিন্তু দুঃখের কথা আজকের এই উদ্ধত পুরুষালি মনোভাবের জন্যই চুরমার হয়ে যাচ্ছে একটি মেয়ের জীবন, তার সম্মান, তার স্বপ্ন , তার অধিকার ।নদী বন সম্পদ উজাড় করে পণ্য আর বাজারে পুরুষালি আধিপত্যের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে তুমুল ভাবে আর ক্রমশ প্রান্তিক থেকে প্রান্তিকতম হয়ে পড়ছে মেয়েরা নারীর চোখ দিয়ে বিশ্বকে দেখতে হবে । পুরুষের চোখ দিয়ে নয় । তবেই যন্ত্রণা বেদনা আর অসম্মানের মূল্য বোঝা যাবে । আর তারই অভাব আজকের দিনে বড় বেশি ।
ওপরে যা লিখলাম তা নিয়ে সাউথ এশিয়ার  বিখ্যাত নারীবাদী নেত্রী কমলা ভাসিন নিরন্তর কাজ করে চলেছেন । দ্য হিন্দু পত্রিকায় (২৬ এপ্রিল ২০১৩) একটি ইন্টারভিউ তে তিনি বলেছিলেন যে এতদিনে তার স্বামীর থেকে বড় ফেমিনিস্ট মানুষ তিনি দেখেন নি । আমাদের বাবাকেও দেখতাম মেয়েদের খুব ভাল বুঝতে পারতেন । হয়ত এমন করে আমার মা ও পারতেন না । মেয়েরা বাবার ওপর খুব নির্ভর করত । নিজের স্বামীকে এমনকি বাপের বাড়িতে যে সব কথা বলতে পারতেন না অবলীলায় বাবাকে এসে বলতেন, কোন দ্বিধা বোধ  করতেন না । বাবার চলে যাবার পর  অনেকেই তাই  মানসিক ভাবে খুব অসহায় বোধ করেন । এ কথা তারা নিজেরা আমাকে বলেছেন ।
 
কমলা ভাসিন উৎস গুগল


  
ধানবাদের কাছে চাষ নালার কয়লা খনিতে প্রবল জলের তোড়ে তিনশ বাহাত্তর জন শ্রমিক প্রাণ হারিয়েছিল । তখন ১৯৭৫ সালের ডিসেম্বরের শেষ । আমি তখন নেহাতই বালিকা ,স্কুলের নিচু ক্লাস । তখন মিডিয়া বলতে খবরের কাগজ , সাদা কালো টিভি কলকাতা দূরদর্শন সবে শুরু ,আর রেডিও। চাষ নালার মর্মান্তিক খবর নিশ্চয় বাড়ির বড়রা শুনেছিলেন , আমিও হয়ত শুনেছিলাম । কিন্তু সময়টাতো এখনকার মত অত খবরমুখী ছিল না । পঞ্চাশটা চ্যানেলের  হুমড়ি খেয়ে মানুষের দুঃখ কষ্ট চোখের জল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে  সেকেন্ডে সেকেন্ডে ব্যাখ্যান করার অত্যাচার তখন ছিল না । তবে ঘটনাটা নিয়ে খুব হৈ চৈ হয়েছিল ।
আমাদের বাড়িতে  অনেক  সময় নানান চমৎকার সব মানুষেরা এসে হাজির হতেন সেই সব অনেক আলোকিত সময় , অনেক স্মৃতিজোনাকি আজও বেঁচে থাকবার রসদ যোগায় ।   কাঁধে ঝোলা ব্যাগ নিয়ে হৈ হৈ অজিত  পান্ডে আসতেন ।ঝোলা ব্যাগ থেকে বের হত তার সদ্য প্রকাশিত ৪৫ আর পি এম এর রেকর্ড । কাকু গণ সঙ্গীত গাইতেন । হা হা করে হাসতেন । খুব ভালবাসতেন আমাকে । গানগুলো আমরা শুনতাম ,খুবই শুনতাম । অনেক সময় বিষয় বস্তু বুঝতাম না ,বোঝার বয়সও সেটা নয় । বেশ একটা জোরালো দাপুটে ব্যক্তিত্ব ছিল তাঁর । গলাটাও ছিল মানানসই । ছোটবেলায় আমার মনে হত কাকুর বোধহয় মাইক লাগেনা । যা তেজালো গলা ! লোকে এমনি শুনতে পাবে । খুব একটা উচ্চকিত ব্যাপার ছিল তাঁর গানে , গণ সঙ্গীতের ধর্মই তাই । একদিন আমাদের হাতে এল কাকুর নতুন রেকর্ড । যাবার সময়  গমগমে গলায় বলে গেলেন “মিঠু মা, শুনিস কিন্তু ।চাষ নালার খনি নিয়ে গেয়েছি । ওখানে গিয়েছিলাম , জানিস ?“
রেকর্ড বাজানো শুরু হল । বিকেলের আলো মাখা আমাদের মফস্বলের ছোট বসার ঘরে বাবা মা একমাত্র  মেয়ের শান্তির নীড় খান খান করে বন্যার জলের মত ঘুরপাক খেতে লাগলো 

এই পাঞ্চেতের পাহাড়ে ম্যাঘ জম্যাছে আহা রে
এমন দিনে হায় হায় মরদ আমার ঘরে নাই
গ্যান্দা ফুলেও রঙ নাই
এই টুসু পরবে যাবক নাই
বাপ নাই ভাই নাই
দুগগা পূজায় যাবক নাই ,মহরমে যাবক নাই ,পীরের মেলায় যাবক নাই
খোঁপায় ফুল গুঁজবো নাই , চুড়ি আলতা পরবো নাই
এই চাষ নালার খনিতে মরদ আমার ডুব্যা গেল রে
দিন কে বিতাইলাম হো , রাতকে বিতাইলাম হো...
তেবেও আমার মনের মানুষ আইল না
এই চাষ নালার খনিতে মরদ আমার হারায় গেল গো ...

তিনশ বাহাত্তরটি মেয়ের ডুকরে ওঠা কান্না , বুকের হাহাকার   একটি জোরালো পুরুষ কন্ঠের ভেতর দিয়ে  সার্বজনীন হারাবার দুঃখ হয়ে কী অপরিসীম বেদনার্ত পরিবেশ তৈরী করেছিল আমাদের বাড়িতে সেদিন ! সাদামাটা সুর সাদামাটা কথা ! কিন্তু তাঁর গলার ভেতরে কী ছিল জানিনা ,আমি হাউ হাউ করে কাঁদতে লাগলাম ।  পাঞ্চেতের মেঘ তখন অঝোরে বৃষ্টি হয়ে ভিজিয়ে দিচ্ছে আমাদের । কেউ একজন মাঝপথে গান টা থামিয়ে দিয়েছিল মনে আছে । একটি বালিকা হৃদয় নিংড়ে তার চোখের জল বের করে এনেছিলেন তিনি । কী ভাবে ? কতদূর সংবেদনশীল হলে এমনটা সম্ভব ?  শুধু সংবেদনশীলতা নয়, আরো বেশি কিছু, তা হল একাত্মতা ,সেই মেয়েটির চোখ দিয়ে দেখা ।  নারী প্রকৃতির আলোয় ।
সেই মুহূর্তে তিনি  তখন হাটে মাঠে শহরে গ্রামে গঞ্জের ডাকসাইটে গায়ক নন, কারুর বাবা, স্বামী, বন্ধু ও না ।

তিনি তখন স্বামী হারানো , বাপ হারানো ভাই হারানো  ভিটে খোয়ান  চাষনালার মেয়ে হয়ে গিয়েছিলেন । 

অজিত পান্ডে

4 comments:

  1. prantiktomo hoye proche meyeder pasapasi sucheton anubhuti gulo,hariye jachche manobik anubhuti,boro prasongik ei gaan te,ei album ei chilo 'no passaeron ' banglay 'par pabe na',chotobelay sona spain er grihojuddher somoy er ani-fascist gan ,amar o ek jholok soishob firiye dilen didi,ami jodio 45 rpm LP te na gathanir cassette e sunechilam.

    ReplyDelete
  2. e michil robindronather gaan erokomi lain chilo "no passaeron" e .
    Thanks for comments,Suman

    ReplyDelete
  3. ঞ্চাশটা চ্যানেলের হুমড়ি খেয়ে মানুষের দুঃখ কষ্ট চোখের জল খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে সেকেন্ডে সেকেন্ডে ব্যাখ্যান করার অত্যাচার তখন ছিল না । ....এই খান থেকে শুরু করে , অজিত পান্ডের গানের কথা... কত কিছু মনে পড়াল... আমার মনে আছে অজিত পান্ডের ৪৫ স্পিডের ছোট্ট রেকর্ড ছিল আমাদেরো, তবে অন্য কোন গানের... আমার প্রিয় অজিত পান্ডের গান বলতে কলেজে সবাই মিলে টেবিল বাজিয়ে গাওয়া ডাউন দ্য ওয়ের বাংলা, ওই দূর সুদূর কোন স্বপনপুর, মন যে গায় ঘরে ফেরার সুর...

    ReplyDelete
  4. ঠিক তাই যশোধরা

    ReplyDelete