অঘটন টা শেষ মেস ঘটেই গেল । দিল্লিতে এসে আমি ঝপাৎ করে
প্রেমে পড়ে গেলাম । হ্যাঁ ,একেবারে প্রথম দর্শনেই । কোন বুদ্ধি যুক্তির ধার
ধারলো না। আমি পান্ডারার দিওয়ানা হয়ে গেলাম । আমার সেই প্রেমিকের নাম পান্ডারা ।
কয়েকমাস আগেও আমার জীবনের মানচিত্রে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না । ইন ফ্যাক্ট তাকে আমি চিনতামই না । তার শান্ত ক্যাজুয়াল অথচ স্মার্ট চেহারা
আমার মন ভরিয়ে দিচ্ছে । প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আমি পান্ডারার অলি গলি
পথে পথে প্রায় প্রতিদিনই ঘুরতে থাকি । তার চারদিক জুড়ে ব্যাস্ত দিল্লির গাড়ি ঘোড়া
। কিন্তু সে কেমন অবিচল । কী ভীষণ উদাসীন , হ্যান্ডসাম আন্ড কুল । তার সবুজ রঙ করা
বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় মাধবীলতার অজস্র উপচে
পড়া ফুল । আমি যেন দু চারটে ভোমরাও দেখতে পেলাম । আর আমার প্রিয় ফ্র্যাঙ্গিপানি
কাঠগোলাপ জায়গাটাকে ছায়াময় করে রেখেছে । ভেজা শিউলি তার অলিন্দে কেমন ঝরে ঝরে পড়ছে । মনে
মনে কঠিন সঙ্কল্প নিলাম যে এর গলাতেই মালা
পরাতে হবে , নইলে দিল্লির এই পরবাস বৃথা , একেবারেই বৃথা । মনের কথা জানাজানি হতেই অমনি হিংসুটের দল বলতে
শুরু করল পান্ডারার ফ্যানক্লাব নাকি জবরদস্ত । তার পেছনে লম্বা লাইন । সে লাইনে বড় বড় সব রাঘব বোয়াল ।
আমার মত চুনো পুঁটি পাত্তাই পাবে না । সে কি কথা ! হোমড়া চোমড়াদের জন্য তো কত্ত বড়
বড় পেল্লাই সব বাড়ি আছে । তারা সেখানেই যাক না । কিন্তু প্রেমের পথ কি
কোনোদিন ফুল বিছানো ছিল ? বন্ধুর দল বলল, আরে বেজায় কম্পিটিশনের খেলায় নেমেছ!
পান্ডারার পাণি প্রার্থী হতে হলে কলজের জোর লাগে । আমি তখন গভীর প্রেমে হাবুডুবু । দেখি ,সে আমাকে
কতটা চায়?
পান্ডারার সবুজ
জমিতে আলোছায়ার আলপনায় আমি তখন অলরেডি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি । একটা লতানো জুঁই
লাগালে কেমন হয়? নেশার মত আমার মন তার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে যাচ্ছে কখনো । আমি দেখতে পাচ্ছি সেমি সার্কুলার
ছোট্ট কাঁচ ঢাকা বারান্দায় আমি
জ্বেলে দিয়েছি ডোম ঢাকা নরম আলো । আর সেই লাল কালো কিলিমের ওপর বাহারি সুজনি আর
কুশন । কল্পনার গোরু তত ক্ষণে মগডালে চড়ে
বসেছে।
“তোমার কুকুর
আছে? খিদমৎ খাটার জন্য গুটিচারেক বান্দা? নেই তো? একা একা থাকবে? তাহলে পান্ডারার স্বপ্ন
ছাড়ো । কোন মাল্টি স্টোরিডের দ্বারস্থ হও ।“
এত সহজে হার
মানার পাত্রী আমি নই । আমি জানি এ বিবাহ
সম্পন্ন হবে অনলাইনে । বরপক্ষ খোদ সরকারি দপ্তর । চুপিচুপি লিস্ট খুলে দেখি আরে,
কি আশ্চর্য ! পান্ডারায় মাল্টিস্টোরিড ! তার মানে পান্ডারাও আমাকে চায়
! আমি হ্যাংলার মত প্রেম নিবেদন করতে ছুটে চলে যাই তার কাছে । কিন্তু এ কী ! সর্বাঙ্গ
পোড়া আমার প্রেমিক ! চারদিকে শুধু পোড়া কালো দাগ । জানতে পারলাম এ সি ফেটে গিয়ে
নাকি এমনটা হয়েছে । আহা রে ,তাতে কী ? আমি তোমাকে ছাড়ব না । সে তুমি যতই কালো হও ।
ওর সেরে
উঠতে অনেক সময় লাগবে । লাগুক । দুটো সুটকেসে বন্ধ জীবনের যন্ত্রণা নাহয় আরো কিছু দিন মেনে নেব ।
পাত্রী
স্বয়ম্বরা । বিবাহের দিন ফাইনাল লিস্ট খোলা হল । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি
না । সে নেই । কোথাও নে ই । সে চলে গেল , বলে গেল না , সে
কোথায় গেল ফিরে এল না ।
আমি সঙ্গে
সঙ্গে বরপক্ষ কে ফোন করি ।
পালিয়ে
গেছে মশাই । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে । ইলোপ । বুঝলেন না । এরকম কতো হয় । কতলোকের
বুক ভাঙ্গে । কতো চোখের জল বয়ে যায় ,কে তার হিশেব কবেই বা রেখেছে ? দুঃখ করবেন না
। আরো কতো ভাল ভাল পাত্র আছে ।
এমন
নির্লিপ্ত বাবা মা আমি চোদ্দ পুরুষে দেখিনি ।
স্তোকবাক্য
যাই দিক না কেন , লিস্টের মধ্যে আরো একটা
পান্ডারা ছিল । সোনামণিটা !
দিলাম
বোতাম টিপে । তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা ।
তারপর
বসন্তের বাতাসের মতো আমাকে হাহাকারে ডুবিয়ে দিয়ে সেও কার হাত ধরে চলে গেল আমার
সামনে দিয়ে ।
অভিভাবকের
দল,বন্ধুর দল এবারে হই হই করে উঠল , অনেক হয়েছে , ঢের হয়েছে প্রেমের কাঁদুনি পনা । কেন,বাকি পাত্রগুলো কী
দোষ করেছে ? তারা তো ওরই তুতো ভাই । না হয় কারুর মাথায় টাক , একটু ভুঁড়ি , বা
একটু বদমেজাজ । তোমাকে একটু মানিয়ে চলতে হবে বাপু । বিয়ে টা অ্যা ডজাস্টমেন্ট ছাড়া
আর কি !
আবার আমি
গৃহহীন । আমি আর দু টো সুটকেস ।
আবার একটা
মাসের অপেক্ষা । আমার পান্ডারাপ্রেম কিন্তু অমলিন ,অবিচল একনিষ্ঠ । সব উপদেশ
পরামর্শ আমি পূর্ব রাগের রাধার মত এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছি
।
আবার
লিস্টি খোলা হল । একটা নয় এবার দু দুটো পান্ডারা । নাহ এও আমাকে বড্ডো ভালবাসে ।
এবারে
গুরুজনের দল এমনকি খোদ বরপক্ষ আমার এই পাগলপনে রীতিমত ঘাবড়ে গেল ।
পাত্রপক্ষ তো বলেই বসল, শুনো বেটা, অ্যায়সা মত কর ।
পান্ডারার দিওয়ানাপন ছাড় । ও তোকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেবে না । বেটা শাদিমে সবসে
ইম্পরট্যান্ট হ্যাঁয় সিকিওরিটি ।
এমন
পাত্রকে বেছে নে যে তোকে সেফটি সিকিওরিটি দেবে । এই দ্যাখ একটা জবরদস্ত পাত্র তোরই
অপেক্ষায় বসে আছে । টল ডার্ক হ্যান্ডসাম ।
আর স্ট্যাটাস ? পান্ডারার চেয়ে অনেক বেশি । পান্ডারার আছে টা কি? মিস্টি মিস্টি
কথা বলে লোক পটায় । আওয়ারাগিরি করে
খালি। তু যাকে একবার দেখ লে তো সহি ।
সবাই
ঠেলেঠুলে পাঠাল । আবাহন ও নেই । বিসর্জন ও নেই । বড়লোক পাত্র । পয়সার জোর আছে ।
এমনই লম্বা যে চোখ কপালে তুলতে হয় । ইয়া বড় ছাতি । নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা । কেঠো চাল । মিষ্টত্বের নাম গন্ধ নেই । ভেরি
ম্যাটার অফ ফ্যাক্টলি । তবে এমন পাত্র হাতছাড়া করলে পস্তাবে । শেষে প্রেম জানালা
দিয়ে পালাবে । বড় মাপের দিল দরাজ অথচ কতো
গুছোনো সাবধানী দেখেছ আমাদের পাত্র । এমন হাতে তুমি পড়লে আমাদের শান্তি ।
মনে হতে
লাগল পান্ডারা যদি এবারো আমাকে ফাঁকি দেয় । তার মিথ্যে আশ্বাসে এতদিন ধরে দুটো
সুটকেসে বন্দী আমার জীবন যে হাঁপিয়ে উঠেছে । আশা নিরাশায় নানান দোটানায় রামকৃষ্ণ
পুরম কে একটা টিক লাগালাম ।
প্রতিদিন লিস্টি খুলে খুলে দেখি । আর মনে মনে শিহরিত হই
। আমি এক নম্বরে । পান্ডারা আমাকে চায় । রেখনা বেঁধে আমায় ...।।
বিয়ের দিন
সমাগত । ঘোষণা করল বরপক্ষ, রামকৃষ্ণপুরমের
হাতে তোমাকে আমরা সঁপে দিলাম । সুখী হও মা ।
কেন? কেন
? কেন ? পান্ডারা নয় কেন? সে তো আমাকে এবারে খুবই চেয়েছিল । কিন্তু তুমি তো তার প্রেমে ভরসা
পুরোপুরি রাখতে পারনি ।
আমি ভীষণ
কাঁদতে কাঁদতে ওদের বলি প্লিজ আমাকে পান্ডারার হাতে তুলে দিন । আমার এতদিনের কতো
স্বপ্ন কল্পনা । মাধবীলতাবিতান , সবুজ গালচের মত ঘাস , হাতের মুঠোয় ইন্ডিয়া গেট ,
কানের পাশে খান মার্কেট , ঢিল ছুঁড়লেই অফিস ।
এত বড়লোক
পাত্রের হাতে তুলে দিলাম ।তাও মন উঠছে না । ওই ভ্যাগাবন্ড টাকে নিয়েই পড়ে আছো?
এবার ঘরে গিয়ে ওঠো । শুরু কর সংসার । পান্ডারাকে বাকি সময়ের জন্য ভুলে যাও।
সংসার তো
শুরু করলাম । মনের মিল হল কই । প্রথম রাত বিনিদ্র রজনী । প্রেমালাপে নয় । রাতভোর
ইয়া বড় বড় লরি আর ট্রাকের আওয়াজে । বাড়ির সামনে দিয়ে দিনভোর রাতভোর যান বাহনের
স্রোত । আর তাদের পিলে চমকানো আওয়াজ । অনেক সম্বন্ধ করা বিয়ের মত এই বিয়েতেও অনেক কিছু
খবরাখবর নেওয়াই হয় নি ।
ও একটু
আধটু দোষ থেকেই থাকে । হিরের আংটির আবার বাঁকা ট্যারা কি? আর কোন অসুবিধে হচ্ছে কি
? সুখ সুবিধের ? নাহ ,আর কোন অভিযোগ নেই আমার । কোন কিছুর অভাব সে রাখেনি । তবুও,
বুড়ো তুমি লোকটি ভাল চেহারাও নয় তো কালো , তবু কেন তোমায় ভালবাসছিনে? সেই প্রেম আর ফিরে এল না ।
প্রতিদিনের
জীবন গতানুগতিক বয়ে যায় । আমার প্রেমহীন সুখের জীবন যন্ত্রের মত এগিয়ে চলে । আমার
ঘুমহীন রাতে তার কিছু যায় আসে না । সে শুধু জানে আমার কোন অভাব সে রাখেনি । মনের
ধার ধারতে তার বয়েই গেছে ।
কিন্তু
আবার বসন্তের বাতাস বয় । মাধবীলতার গন্ধ আর ভোমরার দল আবার ফিরে ফিরে আসে । আমি
আবার প্রেমে পড়ি ।
সোজা পথে
বাড়ি ফিরি না ।জেনেশুনেই । একটু বেঁকে মিটমিটে আলো জ্বলা পথ, যত্ন করে বাঁধানো মসৃণ রাস্তা । কোন
শব্দ নেই , চারদিক চুপচাপ । ভারি শান্ত ।
পরিপাটি সাজানো গাছের সারি । ।চৌকস সুন্দর কেতাদুরস্ত নিউ মোতি বাগ আমাকে হয়ত চেনেই
না । চেনার কথাও নয় । তাকে পাবার আশাকে দুরাশাই বলা যেতে পারে । কিন্তু ভালবাসতে
বাধা কই? যদি কখনও আমাকে সে চিনে নেয় কোনো এক ফাল্গুনের দিনে? কে বলতে পারে?
শব্দহীন রাতের স্বপ্নভরা ঘুম যদি আবার ফিরিয়ে দেয় ?
এই হল
আমার প্রেম বিবাহ পরকীয়া।
সেই অর্থে ননাসুদুর গল্প নয় ( নরনারীর সুখ দুঃখ –পূষন দেব উবাচ)
হতাশ
হলেন?
জানতাম !
খুব ভাল্লাগলো। ভাবনায়, ভাষার বাঁধুনিতে, চিন্তনশক্তির অভিনবত্বে। লিখতে থাকুন সুপর্ণা দেব।
ReplyDeleteonek dhonyobad Somabho . Tomar comment peye khub bhalo laglo bhai.
ReplyDeleteখুবই ভালো।
ReplyDeleteআরো লিখুন
খুবই ভালো ।আরো লিখুন
ReplyDeleteThank you Anuradha. Khub bhalo laglo.
ReplyDelete