Thursday 13 November 2014

প্রেম বিবাহ পরকীয়া

ঘটন টা শেষ মেস ঘটেই গেল । দিল্লিতে এসে আমি ঝপাৎ করে প্রেমে পড়ে গেলাম । হ্যাঁ ,একেবারে প্রথম দর্শনেই । কোন বুদ্ধি যুক্তির ধার ধারলো না। আমি পান্ডারার দিওয়ানা হয়ে গেলাম । আমার সেই প্রেমিকের নাম পান্ডারা । কয়েকমাস আগেও আমার জীবনের মানচিত্রে তার কোন অস্তিত্ব ছিল না ইন ফ্যাক্ট তাকে আমি চিনতামই না । তার শান্ত ক্যাজুয়াল অথচ স্মার্ট চেহারা আমার মন  ভরিয়ে দিচ্ছে ।   প্রাণ ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে আমি পান্ডারার অলি গলি পথে পথে প্রায় প্রতিদিনই ঘুরতে থাকি । তার চারদিক জুড়ে ব্যাস্ত দিল্লির গাড়ি ঘোড়া । কিন্তু সে কেমন অবিচল । কী ভীষণ উদাসীন , হ্যান্ডসাম আন্ড কুল ।   তার সবুজ রঙ করা বাঁশের কঞ্চির বেড়ায় মাধবীলতার অজস্র  উপচে পড়া ফুল । আমি যেন দু চারটে ভোমরাও দেখতে পেলাম । আর আমার প্রিয় ফ্র্যাঙ্গিপানি কাঠগোলাপ জায়গাটাকে ছায়াময় করে রেখেছে ।  ভেজা শিউলি তার অলিন্দে কেমন ঝরে ঝরে পড়ছে । মনে মনে কঠিন সঙ্কল্প নিলাম যে  এর গলাতেই মালা পরাতে হবে , নইলে দিল্লির এই পরবাস বৃথা , একেবারেই বৃথা ।   মনের কথা জানাজানি হতেই অমনি হিংসুটের দল বলতে শুরু করল পান্ডারার ফ্যানক্লাব নাকি জবরদস্ত । তার পেছনে  লম্বা লাইন । সে লাইনে বড় বড় সব রাঘব বোয়াল । আমার মত চুনো পুঁটি পাত্তাই পাবে না । সে কি কথা ! হোমড়া চোমড়াদের জন্য তো কত্ত বড় বড় পেল্লাই সব বাড়ি আছে । তারা সেখানেই যাক না । কিন্তু প্রেমের পথ কি কোনোদিন  ফুল বিছানো ছিল ? বন্ধুর দল  বলল, আরে বেজায় কম্পিটিশনের খেলায় নেমেছ! পান্ডারার পাণি প্রার্থী হতে হলে কলজের জোর লাগে ।  আমি তখন গভীর প্রেমে হাবুডুবু । দেখি ,সে আমাকে কতটা চায়?
পান্ডারার সবুজ জমিতে আলোছায়ার আলপনায় আমি তখন অলরেডি স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি । একটা লতানো জুঁই লাগালে কেমন হয়? নেশার মত আমার মন তার সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় চলে  যাচ্ছে কখনো । আমি দেখতে পাচ্ছি সেমি  সার্কুলার   ছোট্ট কাঁচ ঢাকা বারান্দায় আমি জ্বেলে দিয়েছি ডোম ঢাকা নরম আলো । আর সেই লাল কালো কিলিমের ওপর বাহারি সুজনি আর কুশন । কল্পনার গোরু তত ক্ষণে  মগডালে   চড়ে বসেছে।



“তোমার কুকুর আছে? খিদমৎ খাটার জন্য  গুটিচারেক বান্দা?  নেই তো? একা একা থাকবে? তাহলে পান্ডারার স্বপ্ন ছাড়ো । কোন মাল্টি স্টোরিডের দ্বারস্থ হও ।“
এত সহজে হার মানার  পাত্রী আমি নই । আমি জানি এ বিবাহ সম্পন্ন হবে অনলাইনে । বরপক্ষ খোদ সরকারি দপ্তর । চুপিচুপি লিস্ট খুলে দেখি আরে, কি আশ্চর্য  ! পান্ডারায়  মাল্টিস্টোরিড ! তার মানে পান্ডারাও আমাকে চায় ! আমি হ্যাংলার মত প্রেম নিবেদন করতে ছুটে চলে যাই তার কাছে । কিন্তু এ কী ! সর্বাঙ্গ পোড়া আমার প্রেমিক ! চারদিকে শুধু পোড়া কালো দাগ । জানতে পারলাম এ সি ফেটে গিয়ে নাকি এমনটা হয়েছে । আহা রে ,তাতে কী ? আমি তোমাকে ছাড়ব না । সে তুমি যতই কালো হও ।
ওর সেরে উঠতে অনেক সময় লাগবে । লাগুক । দুটো সুটকেসে বন্ধ জীবনের  যন্ত্রণা নাহয় আরো কিছু দিন মেনে নেব ।
পাত্রী স্বয়ম্বরা । বিবাহের দিন ফাইনাল লিস্ট খোলা হল । নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছি না । সে নেই ।   কোথাও নে ই । সে চলে গেল , বলে গেল না , সে কোথায় গেল ফিরে এল না ।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বরপক্ষ কে ফোন করি ।
পালিয়ে গেছে মশাই । পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে । ইলোপ । বুঝলেন না । এরকম কতো হয় । কতলোকের বুক ভাঙ্গে । কতো চোখের জল বয়ে যায় ,কে তার হিশেব কবেই বা রেখেছে ? দুঃখ করবেন না ।  আরো কতো ভাল ভাল পাত্র আছে ।
এমন নির্লিপ্ত বাবা মা আমি চোদ্দ পুরুষে দেখিনি ।
স্তোকবাক্য যাই দিক না কেন , লিস্টের মধ্যে আরো  একটা পান্ডারা ছিল । সোনামণিটা !
দিলাম বোতাম টিপে । তারপর অপেক্ষা আর অপেক্ষা ।
তারপর বসন্তের বাতাসের মতো আমাকে হাহাকারে ডুবিয়ে দিয়ে সেও কার হাত ধরে চলে গেল আমার সামনে দিয়ে ।
অভিভাবকের দল,বন্ধুর দল এবারে হই হই করে উঠল , অনেক হয়েছে , ঢের হয়েছে  প্রেমের কাঁদুনি পনা । কেন,বাকি পাত্রগুলো কী দোষ করেছে ?   তারা তো ওরই তুতো ভাই  । না হয় কারুর মাথায় টাক , একটু ভুঁড়ি , বা একটু বদমেজাজ । তোমাকে একটু মানিয়ে চলতে হবে বাপু । বিয়ে টা অ্যা ডজাস্টমেন্ট ছাড়া আর কি !
আবার আমি গৃহহীন । আমি আর দু টো সুটকেস ।
আবার একটা মাসের অপেক্ষা । আমার পান্ডারাপ্রেম কিন্তু অমলিন ,অবিচল একনিষ্ঠ । সব উপদেশ পরামর্শ আমি পূর্ব রাগের রাধার মত এক কান দিয়ে শুনে আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছি ।
আবার লিস্টি খোলা হল । একটা নয় এবার দু দুটো পান্ডারা নাহ এও আমাকে বড্ডো ভালবাসে
 এবারে  গুরুজনের দল এমনকি খোদ বরপক্ষ আমার এই পাগলপনে রীতিমত ঘাবড়ে গেল । পাত্রপক্ষ তো বলেই বসল, শুনো বেটা, অ্যায়সা   মত কর । পান্ডারার দিওয়ানাপন ছাড় । ও তোকে দুঃখ ছাড়া আর কিছুই দেবে না । বেটা শাদিমে সবসে ইম্পরট্যান্ট হ্যাঁয় সিকিওরিটি ।
এমন পাত্রকে বেছে নে যে তোকে সেফটি সিকিওরিটি দেবে । এই দ্যাখ একটা জবরদস্ত পাত্র তোরই অপেক্ষায় বসে আছে । টল ডার্ক হ্যান্ডসাম  । আর স্ট্যাটাস ? পান্ডারার চেয়ে অনেক বেশি । পান্ডারার আছে টা কি? মিস্টি মিস্টি কথা বলে লোক পটায় আওয়ারাগিরি করে খালি তু যাকে একবার দেখ লে তো সহি ।
সবাই ঠেলেঠুলে পাঠাল । আবাহন ও নেই । বিসর্জন ও নেই । বড়লোক পাত্র । পয়সার জোর আছে । এমনই লম্বা যে চোখ কপালে তুলতে হয় । ইয়া বড় ছাতি । নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা ।   কেঠো চাল । মিষ্টত্বের নাম গন্ধ নেই । ভেরি ম্যাটার অফ ফ্যাক্টলি । তবে এমন পাত্র হাতছাড়া করলে পস্তাবে । শেষে প্রেম জানালা দিয়ে পালাবে ।  বড় মাপের দিল দরাজ অথচ কতো গুছোনো সাবধানী দেখেছ আমাদের পাত্র । এমন হাতে তুমি পড়লে আমাদের শান্তি ।



মনে হতে লাগল পান্ডারা যদি এবারো আমাকে ফাঁকি দেয় । তার মিথ্যে আশ্বাসে এতদিন ধরে দুটো সুটকেসে বন্দী আমার জীবন যে হাঁপিয়ে উঠেছে । আশা নিরাশায় নানান দোটানায় রামকৃষ্ণ পুরম কে একটা টিক লাগালাম ।
প্রতিদিন    লিস্টি খুলে খুলে দেখি । আর মনে মনে শিহরিত হই । আমি এক নম্বরে । পান্ডারা আমাকে চায় । রেখনা বেঁধে আমায় ...।।
বিয়ের দিন সমাগত ।  ঘোষণা করল বরপক্ষ, রামকৃষ্ণপুরমের হাতে তোমাকে আমরা সঁপে দিলাম । সুখী হও মা ।
কেন? কেন ? কেন ? পান্ডারা নয় কেন? সে তো আমাকে এবারে  খুবই চেয়েছিল । কিন্তু তুমি তো তার প্রেমে ভরসা পুরোপুরি রাখতে পারনি ।
আমি ভীষণ কাঁদতে কাঁদতে ওদের বলি প্লিজ আমাকে পান্ডারার হাতে তুলে দিন । আমার এতদিনের কতো স্বপ্ন কল্পনা । মাধবীলতাবিতান , সবুজ গালচের মত ঘাস , হাতের মুঠোয় ইন্ডিয়া গেট , কানের পাশে খান মার্কেট , ঢিল ছুঁড়লেই অফিস ।
এত বড়লোক পাত্রের হাতে তুলে দিলাম ।তাও মন উঠছে না । ওই ভ্যাগাবন্ড টাকে নিয়েই পড়ে আছো? এবার ঘরে গিয়ে ওঠো । শুরু কর সংসার । পান্ডারাকে বাকি সময়ের জন্য ভুলে যাও।    
সংসার তো শুরু করলাম । মনের মিল হল কই । প্রথম রাত বিনিদ্র রজনী । প্রেমালাপে নয় । রাতভোর ইয়া বড় বড় লরি আর ট্রাকের আওয়াজে ।   বাড়ির সামনে দিয়ে দিনভোর রাতভোর যান বাহনের স্রোত । আর তাদের পিলে চমকানো আওয়াজ । অনেক সম্বন্ধ করা বিয়ের মত এই বিয়েতেও অনেক কিছু খবরাখবর নেওয়াই হয় নি ।
ও একটু আধটু দোষ থেকেই থাকে । হিরের আংটির আবার বাঁকা ট্যারা কি? আর কোন অসুবিধে হচ্ছে কি ? সুখ সুবিধের ? নাহ ,আর কোন অভিযোগ নেই আমার । কোন কিছুর অভাব সে রাখেনি । তবুও, বুড়ো তুমি লোকটি ভাল চেহারাও নয় তো কালো , তবু কেন তোমায় ভালবাসছিনে?  সেই প্রেম আর ফিরে এল না ।
প্রতিদিনের জীবন গতানুগতিক বয়ে যায় । আমার প্রেমহীন সুখের জীবন যন্ত্রের মত এগিয়ে চলে । আমার ঘুমহীন রাতে তার কিছু যায় আসে না । সে শুধু জানে আমার কোন অভাব সে রাখেনি । মনের ধার ধারতে তার বয়েই গেছে । 
কিন্তু আবার বসন্তের বাতাস বয় । মাধবীলতার গন্ধ আর ভোমরার দল আবার ফিরে ফিরে আসে । আমি আবার প্রেমে পড়ি ।
সোজা পথে বাড়ি ফিরি না ।জেনেশুনেই । একটু বেঁকে মিটমিটে আলো জ্বলা পথ, যত্ন করে বাঁধানো  মসৃণ রাস্তা ।    কোন শব্দ নেই , চারদিক চুপচাপ ।   ভারি শান্ত । পরিপাটি  সাজানো গাছের সারি ।   ।চৌকস  সুন্দর কেতাদুরস্ত নিউ মোতি বাগ আমাকে হয়ত চেনেই না । চেনার কথাও নয় । তাকে পাবার আশাকে দুরাশাই বলা যেতে পারে । কিন্তু ভালবাসতে বাধা কই? যদি কখনও আমাকে সে চিনে নেয় কোনো এক ফাল্গুনের দিনে? কে বলতে পারে? শব্দহীন রাতের স্বপ্নভরা ঘুম যদি আবার ফিরিয়ে দেয় ? 



এই হল আমার প্রেম বিবাহ পরকীয়া।
 সেই অর্থে ননাসুদুর গল্প নয়  ( নরনারীর সুখ দুঃখ –পূষন দেব উবাচ)
হতাশ হলেন?
জানতাম ! 


















5 comments:

  1. খুব ভাল্লাগলো। ভাবনায়, ভাষার বাঁধুনিতে, চিন্তনশক্তির অভিনবত্বে। লিখতে থাকুন সুপর্ণা দেব।

    ReplyDelete
  2. onek dhonyobad Somabho . Tomar comment peye khub bhalo laglo bhai.

    ReplyDelete
  3. খুবই ভালো।
    আরো লিখুন

    ReplyDelete
  4. খুবই ভালো ।আরো লিখুন

    ReplyDelete
  5. Thank you Anuradha. Khub bhalo laglo.

    ReplyDelete