Thursday 20 November 2014

প্রিয়সখা চিরসখা



“খুকুমণি ,হোয়াট আর ইউ ডুইং?”
‘খুকুমণি,হোয়াট ইস দা কালার অফ ইওর হেয়ার?”
“খুকুমণি হুইচ ক্লাস ডু ইউ রিড ইন”?
এই পর্যন্ত শুনে যে কেউ মনে করতে পারে আমার বাবা তার খুদে  সুনটুনি মুনটুনি নাতনির সঙ্গে কথা কইছেন বোধহয়  । সেই আড়াই তিনের মেয়েটি মাটিতে থেবড়ে বসে আছে , চুলে দুটো ঝুঁটি । হালকা গোলাপি ফ্রকে নীল বেলুন,আর ভেজা ভেজা করমচার মত দুটো ঠোঁট হাতের সামনে একরাশ রঙ পেন্সিল ,সাদা কাগজে অজস্র হিজিবিজি । আসলে বাবা কথা কইছেন যার সঙ্গে তার নাম  সুনটুনি মুনটুনি নয় আর তার বয়সও আড়াই তিনের অন্তত পাঁচ গুণ । তার নাম শাবানা খাতুন ।
তার মাথার চুল লাল লাল রুখু রুখু । সিন্থেটিক সালোয়ার কামিজ  পরা রোগা কালো মেয়েটা মাটিতে বসে তরকারি কুটছে ।আর বাবার প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছে  খুব হালকা গলায় প্রায়  লুকিয়ে লুকিয়ে  শাবানা বাড়ি বাড়ি কাজ করে আর ইস্কুলে পড়তে যায় । ক্লাস সেভেন । বাবা তাকে ইংরেজি আর ফিজিক্স পড়ান এই দ্বৈত সংলাপ  আমাদের আশাবরী বাড়ির প্রায় প্রতিদিনের ঘটনা ছিল । শাবানা খাতুন ওরফে খুকুমণির পড়াশোনা যাতে ঠিকমতো চলে সেদিকে বাবার খুব নজর দিতেন ।  একদিক থেকে সে বাবার নাতনি বটে । বাবাকে  সে দাদু বলে ডাকতো
আমার বাবা মেয়েদের প্রগতি উন্নতির একজন সোচ্চার সমর্থক ছিলেন । খুব অবহেলার স্তর থেকে খেটে খুটে দিন গুজরান করে যেসব মেয়েরা ,তাদের প্রতি বাবার অপরিসীম মমতা ছিল । আমার খুব ছোটবেলার স্মৃতিও একই কথা বলে । আমার প্রায় সমবয়সী মল্লিকা বাবার কাছে খুব প্রশ্রয় পেত । বাবাকে সে ডাকতো মেসাসাই (মেসোমশাই) বলে । ঝগড়া খুনসুটি লেগেই থাকত ।  বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাবা কিন্তু অন্যপক্ষের দোষ বিশেষ দেখতে পেত না ।  বাবা কেন এমন করত? সেই সময় খুব অভিমান হত । বাবা হয়ত আমাকে ভালবাসে না । আমি  একমাত্র মেয়ে । আমাকে সাপোর্ট করা কি বাবার উচিত নয়  ? মা’র কাছে গিয়ে অনেক অভিযোগ করতাম । আর একটু বড় হলে বাবা বুঝিয়ে বলেছিল “একটু বোঝার চেষ্টা কর । তুই আর ও কি এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছিস? তোর কোন কিছুর অভাব আছে বল? আর ও কী পেয়েছে  ? ওর সঙ্গে তোর তুলনা চলে? ওর থেকে কি আমরা বিরাট কিছু আশা করতে পারি? কিন্তু তোর থেকে তো পারি?” তাই বলে কি তাদের ভুল শুধরে দিতেন না , তবে সেটা অন্য রকম ভাবে । অন্যের অন্যায় আচরণকে  সমর্থন করতেন না বটে,কিন্তু আমৃত্যু ওই মমত্ববোধের জায়গাটায়  স্থির ছিলেন ।
কালী ফুলওয়ালি বাজারে বাবা দিন কয়েক যায় নি খেয়াল করে ছিল । শেষ যে দিন দেখেছিল,তার মনে আছে, বাবার শরীরটা ঠিক ভালো ছিল না ।বাজারে অনেক ফুল ওয়ালা থাকলেও বাবা ওই এক কোনে বসা কালীর কাছ থেকেই ফুল কিনতেন । বাবার নাম না জানলেও খবরটা কালীর কাছে পৌঁছে গেছিল ।  আমাদের বাড়ি সে চিনত না । এক পড়ন্ত দুপুরে এক রাশ ফুলের মালা নিয়ে  কেমন করে যেন এসে  হাজির হয় ।
“আমি কালী । বাবুকে মালা পরিয়ে দিই ?”কালীর সঙ্গে সেদিন আমরাও কেঁদেছিলাম ।  এতো ভালবাসা ছিল তোমার বাবা এই মানুষগুলোর জন্য ?

 তোমরা যারা বরের সঙ্গে
পাকা ঘরে পাখার নিচে
রঙ্গে মাতো রঙিন টিভির
তখন আমি ভর দুপুরে
এই পৃথিবীর ছেঁড়া শাড়ি
 খালি ঘড়া একলা বেওয়া
 ঠা ঠা মাঠের  পথ ভেঙে যাই
বাবুর বাড়ি,মনে রেখো

তোমরা যখন ফুলটুসি মউ
সোনামেয়ের হাত ধরে যাও
বাগান ঘেরা পাঠশালাতে
হাতের থেকে গড়িয়ে পড়া
কমলালেবু সকালবেলায়
টিফিন বাকস জলের বোতল
গেটের কাছে কচি হাতের
নিশান দোলে টাটা তখন
আমার মেয়ে জ্বর গায়ে যে
কাপড় কাচে বাসন মাজে
কয়লা ভাঙে কপাল ভাঙে
সকাল সাঁজে ,মনে  রেখো

ভালো থেকো তোমরা সবাই
বউদি মণি
কেবল তাতে একটু খানিক
নুনের মতো থাকুক মিশে
আমাদের এই তেষ্টা খিদে
বুকের অসুখ,পাতের শেষে
আচার চেখো

বাবা মেয়েদের খুব ভাল বুঝতে পারতেন । এবং মেয়েরাও বাবার কাছে অত্যন্ত স্বচ্ছন্দ বোধ করত । সুতপা কাকিমা
তো (কবি মানস রায়চৌধুরীর অকালপ্রয়াতা স্ত্রী)  বাবাকে বাসুদেব সখা বলে ডাকতেন ।বাবার  সমস্ত অণু পরমাণু দিয়ে সকলের জন্য যে অকৃত্রিম শুভকামনা ঝরে পড়ত তার সঙ্গে এক দুর্লভ নারী প্রকৃতির মিশেলে তিনি  ছিলেন সাধারণের থেকে অনেক অনেক ওপরে এখানে মেয়েদের কথা বিশেষ করে বলছি এই কারণে যে আমাদের চারপাশের অনেক মেয়েরই মনের কথা বলার জায়গা নেই । 
আরতি কাকিমা বাবাকে তার  গুরুদেব মেনে নিয়েছিলেন আমাকে একদিন বলেছিলেন, তিনি তার স্বামী ভাই বাপের বাড়ি   কোথাও যে সব কথা বলতে পারতেন না, সেইসব জমানো কথা বাবা কে অকপটে বলে দিতেন ।
আরেকদিন বাবার এক বন্ধুর স্ত্রী আমাকে ফোন করে তার কিছু পারিবারিক সমস্যার কথা বলেন ।  খুব জটিল সমস্যা ।আইন আদালত পুলিশ ইত্যাদি । আমার পরামর্শ আর সাহায্য দরকার । বেজায় মুশকিলে পড়লাম।  ।  চেষ্টা করলেও আমি জানি ওনাকে আমি খুশি করতে পারছিলাম না । ভরসা দিতে পারছিলাম না । একদিন উনি বলেই ফেললেন ,” আসলে কি জানো? বাসুদেব দা চলে যাবার পর এতো অসুবিধেয় পড়ি মাঝে মাঝে । একটা পরামর্শ দেবার লোক পর্যন্ত পাই না । তোমার কাকু টাকুরা তো আবার সেই ধরণের নন । বাসুদেব দা  ছিলেন আলাদা । একটা না একটা পথ উনি বাতলে দিতেনই । আজ যদি উনি থাকতেন একটা কিছু করতেন ,আমি জানি”। তার গলায় ক্ষোভ ঝরে ঝরে পড়লেও আমার কিচ্ছু করার নেই ।
বাবাও যে সব সমস্যার সমাধান করতে পারতেন,তাও নয় । কিন্তু তার কথায় , তার বাচন ভঙ্গিতে ,তার আশ্বাসে কিছু একটা থাকত যাতে সবাই খুব জোর পেত, ভরসা পেত ,সাহস পেত ।মেয়েদের তিনি মেয়েদের মতো করে বুঝতে পারতেন ।
আবার আরেকদিন রাত প্রায় এগারোটা নাগাদ এক পিসির ফোন । বাবার সহকর্মী । বয়সে ছোট । খুব অশান্ত অস্থিরভাবে প্রায় আধঘণ্টা ধরে বলে চললেন তার নানান সমস্যার কথা । একতরফা । বলে চলেছেন বলেই চলেছেন । তিনি তো এইসব আমার সঙ্গে কোনদিন   আলোচনা করেন  নিতবে আমাকে কেন ফোন করলেন ? আমার মনে হল আসলে  ফোন টা এরা কেউই আমাকে করতে চাননি । করতে চেয়েছেন বাবাকে । আমার ভেতর দিয়ে । একটা ভীষণ অভাববোধ থেকে ।
এরকম কতো মেয়ের  কতো কথা তুমি শুনতে বাবা ?  কতোজনের মন হালকা করতে ? কতো  অস্থিরকে স্থির আর শান্ত করতে , শুশ্রূষার জলের মতো বয়ে গেছ কতো জনের বিভ্রান্ত জীবনে? আমরা তো জানতেও পারিনি কোনদিন ।  তুমি কাউকে জানতে দাও নি ।

 
উৎস ঃ গুগল 

নারী বললেই আমার মার কথা মনে পড়ে। সমস্ত সৃষ্টি তার পায়ের কাছে নিচু হয়ে আছে । আর মনে পড়ে পুব বাংলার সেই নদীটির কথা ।আমাদের বারান্দা ঘেঁসে বয়ে যেত সে। আর এক কল্পনাপ্রবণ বালককে শোনাতো আবহমানের রূপকথা ।
নারী বললেই আমার দিদি আর বোনদের কথা মনে হয়।কেমন ক্যারমের গুটির মতো ছিটকে দূরে চলে গেল সবাই । মোম বাতির মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে তারা আলো দিয়ে যাচ্ছে কতো না সংসারে ।
নারী বললেই আমার মনে পড়ে আমার স্ত্রীর কথা নানা সুখদুঃখের টানাপোড়েনে বুনে চলেছে এক সংসার ।
আমাদের প্রদীপ টিকে মেজে ঘসে স্নেহ সিঞ্চনে জ্বালিয়ে রাখতে তার সকাল থেকে রাত উৎসর্গ করা ।আমাদের খাদ্যকে স্বাদু রাখে সে, আমাদের জীবনকে গতিময় । নারী বললেই আমাদের সমস্ত ব্যবহার আর ভাবনার নেপথ্যে ঝুঁকে পড়া সেই প্রকৃতির আনত মুখ আমার মনে পড়ে।
মেয়েদের নিয়ে কবিতা লেখা হয়েছে অনেক কিন্তু সত্যিকারের তাদের কথা পুরুষ কবিরা কেউ জানতে চায় নি । তাদের মুক্ত হাসির জন্য তৈরি হয়েছে অনবদ্য পদ্য কিন্তু দাঁতের ব্যথার কথা তারা কখনো বলার সুযোগ পায় নি
নারী বললেই আমার মার কথাই মনে পড়ে(বাবার লেখা )

6 comments:

  1. চোখে জল এনে দিল ....এরকম কতো মেয়ের কতো কথা তুমি শুনতে বাবা ? কতোজনের মন হালকা করতে ? কতো অস্থিরকে স্থির আর শান্ত করতে, শুশ্রূষার জলের মতো বয়ে গেছ কতো জনের বিভ্রান্ত জীবনে? আমরা তো জানতেও পারিনি কোনদিন । তুমি কাউকে জানতে দাও নি । আর ওনার লেখায় "নারী বললেই মনে পড়ে মায়ের কথা, স্ত্রীয়ের কথা," যারা ক্ষয়ে যায় তিলে তিলে মোমবাতির মত, ফুরিয়ে যায় একসময়। সত্যি সত্যি কত মন ছুঁয়ে যায় কথাগুলো ! সুপর্ণা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ জোনাকীর ফুটফুটে আলোর মত লেখা দুটি একত্রে রাখলে ব্লগে।

    ReplyDelete
  2. তোমার কমেন্ট পড়ে আমারও মনটা ভরে গেল । অনেক ধন্যবাদ ইন্দিরা ।

    ReplyDelete
  3. পড়ে খুব ভালো লাগল, মিঠু। এ রকম একজন মানুষকে এত কাছ থেকে জেনেছ চিনেছ বলে হিংসে হচ্ছে।

    ReplyDelete
  4. খুব ভাল লাগল ,কুন্তলা তুমি পড়েছ বলে ! শেয়ার করার একটা আনন্দ আছে । বিশেষ করে পছন্দের মানুষদের সঙ্গে ।

    ReplyDelete
  5. আহা... এই রকম মানুষ কি যে দরকার মেয়েদের জীবনে....

    ReplyDelete
  6. একদম ঠিক বলেছেন...।

    ReplyDelete