সোনালি চুল বাঁ কানে দুল মোটা লাল স্কেচ পেন দিয়ে গোল করে একটা শব্দকে বেড়া
লাগিয়ে দিল । সেই বেড়ার মধ্যে উঁকি মেরে দেখি ,পড়ে আছে কয়েকটা বোকাসোকা শুঁটকো লবঙ্গ । এমনটা হতে পারে, মন বলছিল । তাই
আগেভাগেই ব্যাগের মধ্যে সুবিধেজনক জায়গায় রেখে দিয়েছিলাম । কিউইদের ধরপাকড়ের
কড়াকড়ি ক্যাঙ্গারুদের চেয়ে এক কাঠি সরেস । সারাক্ষণ খালি চারশ ডলার ফাইনের ভয় দেখিয়ে যাচ্ছে ।
নাজুখ দেশ, ফুলের ঘায়ে মূর্ছা যায় ।ব্যাগ খুলে লবঙ্গর ছোট্ট
কৌটোটা পাহারাদারের হাতে তুলে দি ।সেই
শালপ্রাংশু তার দুটো মানানসই হাত
দিয়ে নিরীহ কৌটোটার মধ্যে গোবেচারা লবঙ্গগুলোকে আলোর দিকে তুলে সে কী ঝাঁকানি !
যদি কোন পোকা বেরোয় ! বাবা, সবাই দেখি পোকা বাছে ।
মিনিটখানেক ঝাঁকিয়ে
তিনি খ্যামা দিলেন । আমিও নিমেষের মধ্যে গাঁঠরির মুখ বন্ধ করি । যাক বাবা বাঁচা
গেল, শেষ হল নাটক । চল হে , সরাইখানায় যাই ,দুটো দানাপানি মুখে দি । উটগুলোকে খেতে
দি । আমাদের তো সেই কবে থেকে, চলো মুসাফির
, বাঁধো গাঁঠোরিয়ার জীবন শুরু হয়েছে । আর দানাপানি? সেটা নসিবে লেখা থাকলে তো?
পাহারাদার ততক্ষণে আমার সঙ্গী সুমার বোঁচকা খুলতে শুরু
করেছে । সুমার আবার কি হল ? সে তো দিব্যি চালাক । আমার চাইতে
ঢের বেশি । আচারের ডিবে নিয়ে সবার চোখে ধুলো দিয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে । এ যাবত
কেউ তার টিকিটি ধরতে পারেনি । এ বার তাহলে আর শেষরক্ষা হলনা বোধহয়। পাহারাদার একে একে সব জিনিশপত্র বের করে আনছে । সুমার ভুরুতে ভাঁজ । বিব্রত
বিরক্ত মুখ । মনে মনে নিশ্চয়ই লোকটাকে
কন্নাড়া ভাষায় গালাগালি দিয়ে যাচ্ছে । আমি কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে ।ইংরেজি ছেড়ে হিন্দিতে কথা বলা ভালো , কেউ বুঝতে
পারবে না । একটাই অসুবিধে । সুমার হিন্দি আমার চাইতেও খারাপ আর উচ্চারণ ? সে কথা বেশি না বলাই
ভাল ।
“কি হল, সুমা? আচারের ডিবেটা খুঁজে পাচ্ছ না? ওটাই ধরেছে
তো? জানতাম , একদিন না একদিন ধরা পড়বেই”।
“না না, ওটা না, ওটা না, । হানি হানি” সুমা ইংরেজিতেই বলছে
, মধুর হিন্দি শব্দ জানেনা বোধহয় । সোজা তো ! শহদ । ওই যে গানটা আছে না, কভি নিম
নিম কভি শহদ শহদ। কিন্তু এর মধ্যে মধু এলো কোত্থেকে?
তাজ্জব ব্যাপার । ব্রেকফাস্ট টেবিলে সেই চাকভাঙা মধু নয়তো? স্ফটিকস্বচ্ছ পাত্রে
জমা হচ্ছে মধুকুম্ভ থেকে বিন্দু বিন্দু মাধ্বীধারা । তারই কিছুটা নিয়ে
ঘুরছে নাকি? জিগ্যেস করি “সেই মধু নাকি গো”?
আরো ভুরু কুঁচকে সুমা যতটা সম্ভব না চেঁচিয়ে একটু হাত নেড়ে কিছু বলার
চেষ্টা করে “নো নো , মাই হাজব্যান্ড...
হানি হানি”
ইশ, সুমার কি আক্কেল বলে কিছু নেই? এসব কথা এমন সবার সামনে জোরে জোরে বলতে আছে? সুদীর্ঘ অদর্শনে
হাজব্যান্ডকে হানি মনে তো হবেই ,তারপর
দুদিন যেতে না যেতেই মধু ন তিষ্ঠতি জিহ্বাগ্রে,হৃদয়ে তু ... ।
একটু ফিসফিসিয়ে বললাম
“ইয়ে সব চিল্লা চিল্লাকে বোলনে কা বাত নহি হ্যাঁয় ,সুমা ।“
“আরে না ম্যাডাম , মাই হাজব্যান্ড প্যাকড সাম হানি ,আমি
ফর্মে লিখে দিয়েছি, সেই পাউচগুলোই খোঁজা হচ্ছে । কিন্তু পাওয়া যাচ্ছে না“ ।
এর মধ্যে সব কিছু বের করে স্তূপাকার করে রেখেছে সেই
পাহারাদার , সুটকেস উলটে পালটে দেখছে , কোনাকানা হাতড়ে দেখছে , একটা একটা করে জিনিশ তুলে তুলে দেখছে ,মধু
ব্যাটা গেল কোথায় ? ।
অত বড় হলঘরটায় আমরা কয়েকটা লোক ছাড়া আর কেউ নেই । ওয়েলিংটনের
নিঝুম এয়ারপোর্টে এখন আর কোন ফ্লাইটও নেই । আমাদের সঙ্গে যে সব যাত্রীরা এসেছিল তারা
সবাই বাড়ি চলে গিয়ে কফি খাচ্ছে । শুধু হলঘরের কোনায় একটি মেয়ে গুটিসুটি মেরে বসে
আছে । নির্লিপ্ত , কোন হেলদোল নেই । মুখের মানচিত্রে পূর্ব ইওরোপের ছায়া । তার
পিঠের বস্তার ভেতরের সব জিনিশপত্র নামিয়ে
হাতে গ্লাভস পরে আরেক পাহারাদার একটা একটা
করে দেখছে ... রাইটিং প্যাড, পেন , গল্পের বই , নাক ঝাড়ার টিস্যু , আধ খাওয়া
বিস্কুট,মাথা ধরার ওষুধ । মেয়েটি যেন এইসব ধরপাকড়ে বেশ অভ্যস্ত মনে হচ্ছে ।
কিন্তু সুমা তো অভ্যস্ত নয় । পাহারাদারও নাছোড়বান্দা । তুমি
নিজের হাতে লিখেছ মধু আছে, তাহলে সখী ,সে
গেল কোথায় ? তারে ডেকে নিয়ে আয় ।
এবারে সত্যি সত্যি ব্যাপারটা
ভালো করে বোঝার চেষ্টা করি । সুমার পতিদেবতা সে নিরামিষাশী বলে যাতে তার কোন কষ্ট
নাহয় তার জন্য অনেক খাবার দাবার গুছিয়ে
দিয়েছিল । সেগুলো সুমা যে আমাকে একেবারেই চাখতে দেয় নি তা নয় , কিন্তু মধুর কেস টা
আমি আবার জানতাম না । তাহলে মধুর পাউচগুলো গেল কোথায় ? সত্যিই তো? এতোদিন সুমা মধু নিয়ে টুঁ শব্দটি
করে নি । যেই ফাইনের ভয় দেখানো হয়েছে তখন যা কিছু সঙ্গে নিয়ে ঘুরছে, লিখে দিয়েছে ।
সুমা বিড়বিড়িয়ে বলতে থাকে “খেয়ে ফেলেছি নাকি? ভুলে গেছি
বোধহয় , আসলে এতোদিন ধরে বানজারার মত ঘুরছি তো, তবে এটুকু জানি আমার সঙ্গে প্যাকেটগুলো
ছিল,আমার এতো বড় ভুল হবে? “
কারণ যাই হোক না কেন ,সত্যি সত্যি শেষ পর্যন্ত মাধুরী অধরাই
রয়ে গেল । তাকে বাহুবন্ধনে পাহারাদারের আর ধরা হলনা । তাদের দেশে পোকাদের নিয়ে বড়ই
কড়াকড়ি । ইমিগ্রেশনের পেয়াদা যখন বুঝতে পারলেন সত্যিই মধু নেই, মানে সত্যিই ছিল
না, সত্যিই পোকা দেখার আর কোন সম্ভাবনা নেই, তখন কাঁধ উঁচিয়ে হাত দুটো এবং ঠোঁট উলটে বলল, স্ট্রেঞ্জ , নো হানি । হাউ
ফানি !
আর আমরা সেই অনাঘ্রাত , অনাস্বাদিত , অদর্শিত মধুর শেষ দেখা
না পেয়ে প্রহর শেষ করে ঝাড়া দেড় ঘন্টা
খুইয়ে পা ঘসটাতে ঘসটাতে সম্পূর্ণ কাকতালীয় ভাবে কিচ্ছু না জেনে , না বুঝে মধুর
শহরে ঢুকে পড়লাম ।
পরের দিন রোববার । ঘরে বসে থাকার তো কোন মানেই হয় না ।
ওয়েলিংটনে ভাল আবহাওয়া এখন । তবে “আব” এর চেয়ে
হাওয়ার ওপরেই এনার পক্ষপাত একটু বেশি । বাতাস বয় এখানে বারো মাস । এখানে সবসময় শনশন করে হাওয়া বয় । বাতাসিয়া শহর । তাই
নাকি এর নাম উইন্ডি ওয়েলিংটন । শনশন মানে ঘণ্টায় ১২০/১৩০ /১৪০ কিলোমিটার । রোগা
পটকারা উড়েও যেতে পারে । মাথার চুল উড়ছে , (তাই জন্য নাকি এখানকার ছেলেপিলেদের
মাথায় টাক), গলার মাফলার উড়ছে ,জামাকাপড় খুলে
বেরিয়ে যেতে চাইছে , বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার । ল্যাম্প পোস্ট মুচড়ে মুচড়ে যায় । রাস্তায় হাঁটাচলা করা রীতিমত কঠিন । এর ওপর যদি
বৃষ্টি পড়ে তাহলে তো সোনায় সোহাগা । ছাতা উলটে ছেতরে যাবে । এখানকার পাইলটরা নাকি
একটু বেশি দক্ষ ।হতেই হবে কারণ পাহাড় আর সমুদ্রের সঙ্গে প্যাঁচ পয়জার কষে ছোট্ট
রানওয়েতে যদিও বা প্লেনটাকে কসরত করে কোনমতে নামাতে শুরু করেছে ,কোত্থেকে ছুটে আসবে পাড়ার
সেইসব বখাটে দামাল ছেলেদের মত শনশন মরুত
বাহিনী ,প্লেন আবার বোঁ করে উড়ে চলে যাবে অকল্যান্ড ।এর জন্য কতো বড় বড় মিটিং
কনফারেন্স সই সাবুদ পাকা দেখা ,কথা রাখা
বাতিল হয়ে যায় । এরা সব দুঃখ করে বলছিল ।
রোববার সময় নষ্ট না করে সেই রোদ আর হাওয়ার সঙ্গে দোস্তালি
পাতিয়ে হন্টন শুরু করলাম ।প্রথমে গেলাম মাউন্ট ভিক্টোরিয়া। পাহাড়চুড়ো থেকে পুরো শহরটা
ছবির মত সুন্দর দেখায় । দূর থেকে অবশ্য সবই খুব সুন্দর লাগে ।
আরেকটা পাহাড়ের
মাথা থেকে শুরু হয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন । সেই পাহাড়ের পাকদণ্ডী বেয়ে রমণীয় বনবিথীর মধ্যে মিনিট চল্লিশ হেঁটে আবার নেমে আসা যাবে শহরে । হাঁটাতে কষ্ট নেই । উৎরাই ।সেই আলোছায়া মাখা শিশির ভেজা বনপথ , কতো নাম না জানা ফুল পাতা ,
কতো বিচিত্র পাখির ডাক । বনের গভীর থেকে উঠে আসা সুগন্ধ । নেমে আসছি শহরের দিকে । পথের বাঁকে বাঁকে চা
কফির জায়গা , বাচ্চাদের পার্ক । ব্রেকফাস্টের প্রতি ঘোরতর সুবিচার করে,উৎরাই পথে
নামছি । গলা ভেজানোর দরকার নেই , পা দুটোর
বিশ্রামের দরকার নেই । সামনেই ছায়াঘেরা গাছপালার
মধ্যে একটা টালির ঘর । ট্রি হাউস । সেখানে আছেটাই বা কী ,তাও জানিনা । তবুও আমরা ট্রি হাউসের দিকে এগিয়ে গেলাম । কেন
কে জানে! কিন্তু যেতে হতোই । ওখানে মধুগন্ধে
ভরা মৃদুস্নিগ্ধছায়ে নীপকুঞ্জতলে আমাদের জন্য কতক্ষণ ধরে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে সেই মধুমতী । তার নীল সবুজ চোখে রহস্য । মধুর রহস্য
। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি । ঘন হলুদ রঙে সুমার হারিয়ে যাওয়া মধু যেন তার কাছে জমা হয়ে আছে । মধুমতীর মাথার
চারদিকে মৌ গুন্ঠন । হাতে ধোঁয়ার পাত্র , স্মোকার । যারা মৌমাছি পালন করে তাদের
কাছে থাকতেই হবে এই ঘোমটা আর ধোঁয়ার পাত্র ,মৌমাছির কামড় থেকে বাঁচবার জন্য ।
মধুমতীর ঠোঁটের ওপরে আস্ত একটা মৌমাছি । অনন্তকাল ধরে বসে আছে । ঝড়ে ভেঙে পড়া
ইউক্যালিপটাস গাছ কেটে মধুমতীর সুঠাম শরীর বানিয়েছে আরেক মধুমতী । আলিসন ক্লাউস্টন
নামে এক ভাস্কর , নিজে এক মৌমাছি পালয়িত্রী , কাঠ কেটে যেন নিজেকেই বানিয়েছেন । “দ্য বি লেডি “।
মানুকা আর কানুকা
। মানু আর কানু । ঝোপঝাড় আঁটসাঁট । কুচি কুচি পাতা । কুচি কুচি
হালকা রঙা ফুল । ফুলের বুকে লুকিয়ে আছে চাপ চাপ মধু । গুনগুন মউতান । নিউজিল্যান্ডের ঘন জঙ্গলে মানুকা
আর কানুকা ঝোপের ফুলে মৌমাছির দলে নেশা লাগে । চাকভাঙা মধু গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে করুণা
ধারার মত । তবে এদেশের মধুর মধ্যে মৌচাকের কিছু কিছু অংশ মিশিয়ে দেওয়া হয় ।
আমাদের মৌমাছিরা
। মৌমাছিদের এরা বড্ড ভালবাসে । শখ করে বাগানে মৌমাছি পোষে । কামড় খায় । কিন্তু কিছুতে
দমানো যায় না । দেশের অর্থনীতির একটা বড় অংশ
মধুতে মজে আছে । গভীর প্রেম মিশিয়ে আধবোজা চোখে এক মহিলা বলেছিলেন , “দেখুন
মৌমাছিদের বুঝতে হবে , ভালোভাবে বুঝতে হবে । ওরা কিছু বলতে চায় , সেটা খুব মমতার
সঙ্গে লক্ষ করা উচিত । মৌমাছির কামড় খেয়ে সারা বাগান ছুটে বেড়ানোর আগে ওদের যদি
একটু বুঝে নিতে পারি ।“ আমি মনে মনে বলেছিলাম, ন্যাকা ।
ছোট ছোট
বাচ্চাদের ছোট্টবেলার থেকেই শিখিয়ে দেওয়া হয় যে, তোমাদের মৌমাছিদের নিয়ে এই শোঁশোঁ
হাওয়ার মধ্যেই বাঁচতে হবে বাপু । বৃষ্টি না হলে, বাচ্চাগুলোকে বেশ কিছুক্ষণ এই হাওয়ার মধ্যেই বসিয়ে রাখে, টিফিন খাওয়ায়, স্কুলের দিদিমণিরা । মৌমাছিদের সঙ্গে ভাব পাতিয়ে দেয় মুগ্ধ জননীর দল , কামড়ের ভয় দেখায় না অকারণ।
বাচ্চাদের
জিনিশপত্রে , স্যুভেনির দোকানগুলোতে মৌমাছির বিরাট দাপট ।
এইভাবেই ওয়েলিংটন
সমেত পুরো নিউজিল্যান্ডের আকাশ বাতাস নদী বনভূমি মাতোয়ারা হয়ে রয়েছে -
মধুবাতা ঋতায়তে ,মধু ক্ষরন্তি সিন্ধবঃ , মাধ্বীরন সন্ত্বোষধীঃ ।
এদিকে লাইব্রেরি , ওদিকে স্টেশন ,ওই রাস্তাটা আপনাদের
হোটেলের দিকে , চিনতে পারছেন? আর এদিকে বি হাইভ , পাশে দেখুন একটা হেরিটেজ বাড়ি...
।
শনশনে বাতাসের
মধ্যে হনহনিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আর ডাইনে বাঁয়ে সামনে পিছনে মুন্ডু ঘোরাতে ঘোরাতে
কাছাকাছি জায়গাগুলো চিনে নিচ্ছিলাম । কিন্তু একটা শব্দ মাথার মধ্যে সটান সেঁধিয়ে গেল
“বি হাইভ” । এ ক’দিনে ওয়েলিংটনে আমাদের চারদিকে তো মধুঋতু জাগে দিবা নিশি ।
আমরা তো এতোদিনে চিটেগুড়ে পিমড়ের মত কানুকা
মানুকায় স্রেফ আটকে গেছি । কাছেই আবার বি
হাইভ ? সেটা কি বটে? ইটা ইখানকার পার্লামেন্ট বটে । পার্লামেন্টের নাম বি হাইভ ?
মৌচাক ? হাউ রোম্যান্টিক ! তার মানে আপনি
বলছেন, হানিকম্বের ছোট ছোট কুঠরিতে কেউ কূট কচালি করে না? জুতো,পচা ডিম ছোঁড়ে না?
টেবিল চেয়ার ভাঙে না? গাল দিয়ে চোদ্দ পুরুষ উদ্ধার করে না? বড় বড় হাই তুলে ঘুমোয়
না ? ইয়ে, মানে , মোবাইলে হাবিজাবি কিছু দেখে না? তাহলে কি ওখানে সব্বাই কবিতা
লেখে ? শ্যাম্পেন খায় আর চেলো বাজায় ? আমি খুব উৎসাহী হয়ে পড়ি । সঙ্গীরা জানায়,না মানে ঠিক তা নয় , তবে
আমরা কুলেস্ট লিটল ক্যাপিটালের বাসিন্দা
কিনা ,বি হাইভও তেমনি ঠান্ডা ঠান্ডা কুল কুল । চারদিকে ঘুরে টুরে বেড়ান , এর সবুজ
লনে পা ডুবিয়ে হাঁটুন, ছবি তুলুন , কেউ কিছু বলবে না ।
ইন ফ্যাক্ট,আমি কোন সেপাই সামন্ত দেখতেও পেলাম না ।
বি হাইভ পার্লামেন্ট |
তুলনামূলক আলোচনায় না গিয়েও দিল্লির পার্লামেন্টের কথা
ভাবলেই আমার সব সময় চিদানন্দ দাশগুপ্তর
বানানো একটা ফিল্মের কথা মনে পড়ে যায় । ছবিটার নাম আমোদিনী । সেখানে একটা দৃশ্য
ছিল পন্ডিতমশাই বাড়ি ফিরছেন , পথে যাতে ইতরজনের ছায়াটাও না মাড়াতে হয় তার জন্য
দুটো মুশকো লেঠেল হেঁড়ে গলায় চেঁচিয়ে যাচ্ছে, পন্ডিত মশাই বাড়ি যাচ্ছেন ছোটলোকরা তফাৎ যা
...।
মধু কখনো কখনো অযাচিত ভাবে আচমকা এসেও ধরা দেয় । একেবারে সুমার বিপরীত গল্প ।
গড়িয়ার কামালগাজিতে শ্রীপরামানন্দ সরস্বতীর আশ্রম । ইনি একাধারে কবি এবং সন্ন্যাসী
ছিলেন । এবং ছিলেন একজন পারফেকশনিস্ট । নিখুঁত হতে হবে সব কাজ । আশ্রমের পরিবেশ
একেবারে তপোবন । ছায়াময় , শান্ত , স্নিগ্ধ । ছোট ছোট একতলা বাড়ি । খুব পরিচ্ছন্ন এবং অনাড়ম্বর। বাতাবিলেবু, আম , গাছ থেকে মাটিতে ঝুলে ঝুলে পড়ছে । সাধারণ নিরামিষ খাওয়া , বাগানের টাটকা
ফুল , ধূপের সুগন্ধ , অপূর্ব সঙ্গীত । ধ্রুবানন্দ এবং
সুব্রত ব্রহ্মচারী যাবার সময় মাকে বাগানের একটি ফুল দিলেন । নাগকেশর ফুল ।আমরা
বাড়ি এসে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে , মায়ের হাতব্যাগে চাবি । মা আর চাবি বের করতে
পারছেন না । কি ব্যাপার? কি হল তোমার? মায়ের হাতব্যাগে তখন উপচে পড়ছে মধু । টাকা পয়সা
, রুমাল , চাবি সব মধু মেখে চ্যাট চ্যাট করছে । কোত্থেকে এল এতো মধু ? ওই নাগকেশর
ফুল থেকে । তার পরেও অনেক আলোচনা থেকে যায় , ওই অতটুকু ফুলে অ্যাতো মধু ? যাঃ এরকম
হয় নাকি ?
কিসে যে কী হয় তা আমাদের জানার মধ্যে নেই । আমাদের অগোচরে ,
তুচ্ছতমের মধ্যেও এই মাধ্বীধারা কখন কীভাবে বয়ে চলেছে , আমরা zা ন্তিও পারিনা । করুণা তোমার কোন পথ দিয়ে
কোথা নিয়ে যায় কাহারে ।
আকাশজুড়ে হালকা হালকা মেঘ । যতদূর চোখ যায় সবুজ ঘাসে ঢাকা
মাঠের প্রান্ত । সুন্দর একটি ছিমছাম বড় বারান্দা
। বারান্দার ওধারে সবুজ ঝুপসি গাছ । সবুজ মাঠে কাটাকুটি খেলছে নরম রোদ আর ছায়া । সামনের ঝুপসি গাছটায় উড়ে উড়ে বসছে সাদা সাদা ক্রৌঞ্চ মিথুনের দল, তাদের দীঘল দুটি
ডানা মেলে । আর আপনি বসে আছেন ওই ছিমছাম বারান্দায় , বেতের সোফায় , হাতে মকাইবাড়ি
চায়ের কাপ নিয়ে । পুবদিক থেকে অল্প অল্প হাওয়া । ঘরের ভেতর থেকে সুবিনয় রায় গাইছেন
মধুর মধুর ধ্বনি বাজে...
সোমা গুহর তোলা ছবি |
কোন গাঁটের পয়সা খরচা না করে এই ছবি যিনি বিনিপয়সায় খোদ
কলকাতায় বসে সম্বৎসর উপভোগ করেন তার নাম সোমা গুহ । না, ইনি ঋতু গুহর কেউ হন না
তবে তার একজন সমঝদার বৈকি । এনার কাছেই পেলাম মধু আখ্যানের আরেকটি দিক । ওই
যে গাছটা দেখা যায় , বারান্দার ওধারে , সেটা আশ ফল গাছ । আমি আশফল গাছ চিনি না ।
কিন্তু সোমা গুহ জানালেন সেই ফলে নাকি
প্রচুর মধু । মধু মানেই মৌমাছি । বড় বড় মৌচাক । মৌমাছির ঘরকন্না উনি বারান্দা থেকেই বসে বসে দেখেন । কিন্তু এই
মৌমাছিদের যাত্রাপালা দেখার জন্য মাঝে মাঝে একটু ট্যাকশো দিতে হয় । এরা সোমার
বাড়িতে বেপরোয়া ঢুকে পড়ে । জায়গায় জায়গায় মধুভান্ড তৈরি করে রাখে । সোফার পেছনে ,
পর্দার ফাঁকে । এমনকি খোলা ব্যাগের ভেতরেও খোপ কাটা খোপ কাটা চক মিলানো
ঘরদালান বানিয়ে ফেলে একটু অসাবধান হলেই । এইবারে হয়েছে কি, খাদ্য খাদকের সারণী মেনে সারস
বককুলে,সেই বার্তা রটি গেল ক্রমে, আশফল গাছে শুধু আছে মধু জমে । ব্যাস, আর যায় কোথায় দলে দলে বক সারস তাদের
দীঘল সাদা ডানা মেলে লম্বা লম্বা ঠোঁট
বাগিয়ে আশফল গাছে পাড়ি জমাচ্ছে মধুর জন্য নয় ,খোদ মধুর কারিগর মৌমাছিদের ধরে ধরে
খাবে বলে । কী অ্যান্টি রোম্যান্টিক !
সারাদিন ধরে সোমার বারান্দার সামনের লিরিক্যাল পোয়েট্রিটার পেছনে
আছে একটা ঘোরতর বাস্তব , একটা জৈবিক তাগিদ । পোস্ট মডার্ন পোয়েট্রি ।
বি হাইভের কথা লিখতে লিখতে একটা কথা মনে পড়ে গেল ।দীর্ঘ দিন আমরা কলকাতার
লেকটাউন এলাকার বনফুল আবাসনের বাসিন্দা ছিলাম । সাহিত্যিক বনফুলের বাড়ি এই
এলাকাতেই, তাই এই নাম । সেই আবাসনের বি ফাইভ নম্বর ফ্ল্যাটে দেবপরিবার বাস করত ।
বাবা মজা করে সবাইকে বলতেন “আমাদের বাড়ি
বনফুল আবাসনের বি হাইভ । বাসুদেবের বি আর
তার বাড়ি বি হাইভ “। এখন মনে হয় সত্যিই সেটা বি হাইভ ছিল , আর তার মধুরতার উৎস
ছিলেন তিনি নিজেই । অবিচলিত শান্ত প্রসন্ন ।
অল্পে সন্তুষ্ট । অন্যের সুখে সুখী । “ঈশায় আচ্ছন্ন সব,ঘাসের ভিতর অই লাল
পোকাটিও...”
বি ফাইভের সর্বত্র মধুকোষের জায়গায় ছিল গ্রন্থকোষ ।আমরা বাহারি চাদর দিয়ে
বই ভর্তি প্যাকিং বাক্স ঢেকে ডিভান
বানাতাম । ঘর গেরস্থালীর সব জায়গা বাবা দখল করে নিয়েছিলেন । এমনকি মুড়ি চানাচুর
বিস্কুট রাখার জায়গাও । বাবার নিজস্ব বইপত্র ছাড়াও সারা বাংলার লিটল ম্যাগাজিন আসত
আমাদের বাড়িতে । সত্যি কথা বলতে কি বাড়িতে আর এক চিলতে জায়গাও ছিল না । পরে
আশাবরীতে চলে আসার সময় প্রচুর ম্যাগাজিন বাতিল করতে হয়েছিল । উপায় ছিল না । এই তো সেদিন প্রভাতকুমার দাস বলছিলেন আপনার বাবার
সেইসব লিটল ম্যাগাজিন কালেকশনগুলো আছে তো? এগুলো কিন্তু গবেষক প্রাবন্ধিকদের খুব
উপকারে আসতে পারে ।
আমি আর ভাই শুধু চুপ করেছিলাম ।
ওই বি ফাইভেই আমাদের জীবনের মধুপর্কের বাটি সাজানো হয়ে
গেছিল ।
এখানে বসেই বাবার “নশ্বরতার জার্নাল”লেখার শুরু ।
মধুরেণ সমাপয়েৎ করছি তার একটা মধুর অংশ দিয়ে , আমাদের জন্য বাবার
রেখে যাওয়া মধুপর্কের বাটি ,আমাদের সবার জীবনে
ভীষণ ভাবে প্রাসঙ্গিক ।
"ভালোবাসতেই তো আমি এসেছিলাম । তোমাদের সকলকে , সব কিছুকে ।আগুন ও জল , মাটি ও হাওয়া । আকাশ ও প্রান্তর ও পথ ,বনানী ও পাহাড়,জনপদ আর নদী –ভালোবেসেছি প্রকৃতিকে, মানুষকে , বন্ধু বান্ধবকে , আত্মীয় পরিজন প্রিয় পুরুষ ও নারী , সন্তান ও জায়া , শিল্প ও ঈশ্বর । ভালোবাসার কতো রূপ,কত রঙ, কতো মাধুর্য কত বেদনা ...।
আমার সমস্ত চেতনা ভরে থাকুক সেই পরম ব্রহ্মের অথবা সেই পরম
উৎকর্ষের ভাবনায় । অনাদিমধ্যান্ত সেই রহস্যপুরুষ (নারী বা পুরুষ অর্থ বিযুক্ত) যার
বিভায় বিভাসিত সমস্ত জগত তাঁর কৃপা করুণা এসে লাগুক আমার সত্তার গভীরে ।
কেবল নিজের ছেলে মেয়ে স্ত্রী পরিজন নিয়ে কোন প্রার্থনা নয় ,
সর্বজন হিতায় ।আমার সমস্ত শরীর মন আত্মা থেকে বিচ্ছুরিত হোক অকৃত্রিম শুভচেতনা ,
সকলের জন্য ।
আমার দর্শন বহতা জলের দর্শন , ভালোবাসার দর্শন , নক্ষত্র থেকে নীবার পর্যন্ত এক সংগতির দর্শন ।"
আবার একরাশ ভাললাগা।।।ভালবাসার গন্ধমাখা।সাধু।
ReplyDeleteঅজস্র ধন্যবাদ আর ভালবাসা ।
ReplyDeleteমৌভান্ডের কিছু উপচে পড়া স্বাদ নিলাম।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ । খুশি হলাম ।
ReplyDelete