বেলা প্রায় শেষ হয়ে আসছে । গুনগুনে গরম , ভোমরার ভোঁ ভোঁ , কবুতর আর ঘুঘুর একঘেয়ে ডাক ছাপিয়ে ঘোড়ার খুরের খটখট , উড়ছে বিনবিনে ধুলো । তার রেশম চুলের বিনুনিতে লটকে আছে গাছ থেকে খসে পড়া গুলমোহর
। উড়ে যাচ্ছে ফিরোজা
রঙের ওড়না । তেরো বছরের মাখন মাখন হাত শক্ত করে তলোয়ার ধরে আছে। চলছে পুরোদস্তুর
শিক্ষানবিশি । লড়ছে সত্যি একটা বাচ্চা সিংহীর মত । তেজালো ,টান টান স্নায়ুর এক উড়ন্ত ঘূর্ণি
।অলিন্দে দাঁড়িয়ে আছেন মুগ্ধ পিতা , চোখ জলে চিকচিক । দু হাত
আকাশের দিকে তুলে চেঁচিয়ে ওঠেন “হাফসা মো ঈন , আরো জোরে আরো জোরে
বেটা “। আ জানের সময় হয়ে এলো বলে । চোখের জল মুছে অস্ফুট গলায় বলতে থাকেন , ইয়া আল্লাহ , বিটিয়া কো সহি সলামত
রাখনা । হাফসা মোঈ ন তার দুচোখের নুর । তার লাডলি বেটি । আজও সেই
দিনটার কথা মনে পড়ে সুলতানের । অনেকগুলো পুত্র সন্তানের পর এই হুর কী পরী যখন
জন্মাল , খুব ধুমধাম করেছিলেন ইলতুতমিস
।সেই দিন থেকে তিলে তিলে তার স্বপ্ন কে বড় করে তুলেছেন তিনি । সিয়াসত ,খুন , জংগ ,আর তলোয়ারের অশান্ত জীবনে মেয়েকে উপযুক্ত করে গড়ে তোলার কাজে তিনি এতোটুকু গাফিলতি
দেখান নি । মেয়েকে তিনি যুদ্ধেও নিয়ে গেছেন অনেকবার । পাকা তীরন্দাজি , ঘোড় সওয়ারি , তলোয়ারবাজি ,
কোনকিছু বাকি ছিল না । গোয়ালিয়র দুর্গ দখল করার যুদ্ধে বেরিয়ে
যাবার সময় মেয়ের হাতেই শাসনভার দিয়ে যান আর ফিরে এসে তার পারদর্শিতা দেখে মুগ্ধ
হয়ে সিদ্ধান্তই নিয়ে ফেলেন
তাঁর পরে হুকুমতের দায়িত্ব সঁপে দেবেন তার লাড লির হাতে ।
অতি বিশ্বস্ত অনুচর আবিসিনিয়ার ইয়াকুতের বুকে খঞ্জর দিয়ে সেই সিদ্ধান্ত লিখে দেন
রক্তের অক্ষরে , মোহর লাগিয়ে ।
সময়টা রক্তাক্ত ত্রয়োদশ শতাব্দী , কঠোর রক্ষণশীল পর্দা নশীন সমাজ , অত্যাচারী পুরুষ তন্ত্র ।
২
গৃহবন্দী হয়ে আছেন রাজিয়া । ইন্তেকাল হয়েছে ইলতুতমিসের । সৎ মা শাহ এ তুরকান
বড় সুন্দর করে ছক সাজিয়েছেন । বড় বড় আমির ওমরাহ গিয়াসুদ্দিন বলবনের
মত মন্ত্রী সব্বাইকে খাপে খাপে বসিয়ে তিনি হুকুমত কে কব্জা করে মসনদে বসিয়েছেন
হারেম আর মদে চুরচুর
তার নিজের ছেলে রুকনুদ্দিন
কে । ক্ষমতা দখলের এই ভয়ংকর টালমাটালের মধ্যে রাজিয়ার পাশে ছায়ার মত লেগে আছে আবিসিনিয়ার হাবসি
ক্রীতদাস ইয়াকুত । আর রাজিয়ার বাল্য প্রেমিক আলতুনিয়া ততদিনে ভাতিন্দার শাসক
হয়ে বসেছে ।
ঝরোখার পাশে মাথা এলিয়ে দূরে তালাও এর দিকে তাকিয়ে আছে রাজিয়া,
শুনশান দুপুর । কর্কশ ময়ূরের ডাক । বাবার
কথা ভাবতে ভাবতে মনে পড়ে একবার বাবার সঙ্গে ঘোড়ায় চড়ে কোথাও যাচ্ছিলেন ,হঠাত দেখলেন গাধার পিঠে বসে আসছেন ফকির কাজিমুদ্দিন
জাহিদ । ওনাকে সম্মান দেখাতে বাপ মেয়ে ঘোড়া থেকে নেমে দাঁড়ালেন । কিন্তু ফকির
থামলেন না
। জঙ্গলের মধ্যে মিলিয়ে যেতে যেতে বলে গেলেন “ তোমার মেয়ের মাথার সাজ / হিন্দুস্তানের তাজ”। ভাবনার সূত্র ছিঁড়ে গেল । রাজিয়ার কোরান শিক্ষিকা ফতিমা
বিবি ঘরে
ঢুকলেন । ইলতুতমিস এনাকে খুব সমীহ করতেন । ফতিমা জানালেন দেশের অবস্থা খুব খারাপ ।
প্রজাদের অসন্তোষ দিনদিন বাড়ছে ।
মালিকা এ আলিয়া - শাহ তুরকান, রাজিয়াকে
মেরে ফেলতে পারে ।
তাই লুকিয়ে লুকিয়ে ভাতিন্দা চলে যাওয়াই বোধহয় এখন ভালো । ওখানে
আলতুনিয়া আছে । রাজিয়া বললেন , আলতুনিয়া
নতুন ক্ষমতা হাতে পেয়েছে , নতুন সুলতানের অধীনে । তাছাড়া
একমাত্র ইয়াকুত ছাড়া আর কাউকেই কি এখন বিশ্বাস করা যায় ? এইসময়
রাজিয়ার খাস পরিচারিকা জানাল ফকির সাহেব তার হাত দিয়ে রাজিয়াকে একখানা চিঠি
পাঠিয়েছে । ফকির লিখছেন , শাহজাদি যেন এখখুনি ইয়াকুত কে
কোতোয়ালি দখল করার নির্দেশ দেন । প্রজারা সবাই শাহজাদির সঙ্গেই আছে । আগামী
শুক্রবার জামি মসজিদে দেখা হবে । গোপন নির্দেশ পৌঁছে গেল ইয়াকুতের কাছে । শহর
কোতোয়ালি কব্জা করল ইয়াকুত । শুক্রবার জামি মসজিদে জমজমাট ভিড় ।সবাই এসেছে আমির
উমরাহ , মন্ত্রী সান্ত্রি ,ইয়াকুত ,
রাজিয়া আর সেই ফকির আর দলে দলে প্রজারা । নমাজের
পর ফকির দিল্লির জনতাকে জিজ্ঞেস করলেন কাকে মসনদে দেখতে চাও তোমরা ? হারেম আর শরাবের নেশায় রঙ্গিলা সুলতান না তোমাদের দুখদরদ বুঝতে পারে সেই শাহজাদি
রাজিয়া ? দিল্লির আকাশ বাতাস মুখর করে প্রথম আমজনতার দরবারে
আওয়াজ উঠল, শাহজাদি শাহজাদি শাহজাদি ।হালকা
কুয়াশা ঢাকা মিঠে রোদ্দুর মাখা হাওয়ায় জনতার উল্লাস ।
ইতিহাসের কোন পাতায় হারিয়ে গেছে সেই আম জনতার আওয়াজ , সেই সাধারণ দরবার , যারা শাসক হিশেবে দেখতে চেয়েছিল প্রথম
মহিলা সুলতানকে । এই যুগান্তকারী ঘটনার পরে ওই ফকিরকে আর কোনদিন দেখা নি ।
সময়টা রক্তাক্ত ত্রয়োদশ শতাব্দী , কঠোর
রক্ষণশীল পর্দা
নশীন সমাজ
, অত্যাচারী পুরুষ তন্ত্র ।
৩
পিতার মৃত্যুর সাতমাসের মধ্যে দিল্লির জনতার সমর্থনে ইলতুতমিসসের লাডলি মেয়ের মাথায়
উঠল হিন্দুস্তানের তাজ । বয়স তখন তিরিশ -
একত্রিশ । মাত্র চার বছর মসনদে ছিলেন রাজিয়া । শাসনভার হাতে নিয়ে
প্রথমেই ঘোষণা করলেন যে তাকে ডাকা হবে সুলতান বলে । সুলতানা নয় । কারণ সুলতানা বলা হয় সুলতানের বিবি বা
সঙ্গিনীকে । মুখ থেকে পর্দা সরে গেল , শরীরে উঠল
পুরুষের মত যোদ্ধার পোশাক । মিনহাজ ই সিরাজ তার তবকত ই নাসিরি তে অকুণ্ঠ প্রশংসায়
সাজিয়ে দিয়েছেন রাজিয়াকে । সুশাসক আর যোদ্ধার সমস্ত গুণ তার মধ্যে ছিল । শক্তির
উৎস ছিল মানুষের ভালোবাসা আর সমর্থন । তার আমলেই এসেছিল শান্তি
শৃঙ্খলা নানান গঠনমূলক উদ্যোগ আর কাজ । কিন্তু একজন জেনানার
অধীনে, তার
নীতিনিয়মের বেড়াজালের মধ্যে আটকে থাকা টা তো পুরুষের শোভা পায় না । তুর্কি
আমিরের দল নতুন ফন্দি আঁটতে শুরু করল । দেশজোড়া বড়সড় প্রতিরোধ সম্ভব নয় ।
তাদের নিজেদের মধ্যেই দলবাজি যথেষ্ট ,উপরন্তু
রাজিয়া সাবধানী , দূরদর্শী
। তাই খুব গোপনে ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হতে লাগল ।
সময়টা রক্তাক্ত ত্রয়োদশ শতাব্দী , কঠোর
রক্ষণশীল পর্দা
নশীন সমাজ
, অত্যাচারী পুরুষ তন্ত্র ।
৪
ক্ষমতার শিখরে উঠে এসেও ত্রিশোরধ্ব রাজিয়া প্রেমের যন্ত্রণায় দীর্ণ
হয়ে যাচ্ছিলেন । বাল্যপ্রেমিক এক উচ্চাভিলাষী রাজপুরুষ । ভাতিন্দার আলতুনিয়া ।
আর নানান উত্থান পতনে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় অনিশ্চয়তার মধ্যে তাকে দুহাতে আগলে
রেখেছে আবিসিনিয়ার ইয়াকুত । তার প্রতি রাজিয়ার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই । সেখান থেকে
নির্ভরতা , তার থেকেই ভালবাসা ।
রঞ্জিস আর মুহব্বত এই দুই এর টানাপোড়েনে চুরমার হয়ে যাচ্ছেন শাহজাদি । দরবারে তুর্কি
আমিরদের আধিপত্য ভাঙতে চেয়েছিলেন তিনি । যারা তুর্কি নন এমন অনেকেই উঁচু পদে
বসিয়েছিলেন ,তাদের মধ্যে ইয়াকুতও ছিল । আলতুনিয়ার
ঈর্ষাকে কাজে লাগিয়ে বিদ্রোহের আগুন জ্বালানো হল । বিদ্রোহে
অগ্রণী ভূমিকা নিলো ভাতিন্দা । ইয়াকুতকে মেরে ফেলা হল । রাজিয়া হলেন বাল্য প্রেমিকের হাতে বন্দী
।ভাতিন্দার কিলা মুবারাক হল তার নতুন আস্তানা ।
“কচ্চে ঘড়ে নে জিত লি নদী চড়ি হুই
মজবুত কস্তিয়ো কো কিনারা নহি মিলা “
মেহবুবার জন্য আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্যের কোন অভাব রাখেনি আলতুনিয়া । প্রতিদিন রাজিয়ার সঙ্গে
তার সাক্ষাত হত । একটা সুন্দর সাজানো পালকিতে করে মসজিদে যেতেন রাজিয়া
। সন ১২৪০ । আলতুনিয়াকে বিয়ে করেন রাজিয়া । ভালবাসা থেকে না নিরাপত্তার
স্বার্থে , মিনহাজ তা লিখে যান নি
আর তা জানাও তার পক্ষে না মুমকিন ছিল ।
সময়টা রক্তাক্ত ত্রয়োদশ শতাব্দী , কঠোর
রক্ষণশীল পর্দা
নশীন সমাজ
, অত্যাচারী পুরুষ তন্ত্র ।
৫
দিল্লির মসনদ পুনরুদ্ধার করতে রাজিয়া আর আলতুনিয়া রওনা হলেন । পথের
মধ্যেই তাদের আক্রমণ করে দিল্লির ফৌজ । নতুন দুলহন আর দিল্লি পৌঁছুতে পারেন নি , হাতের মেহেন্দি হয়ত তখনো
উজ্জ্বল , স্বপ্নের রং হয়ত তখনও ফিকে হয় নি , কালো রেশম
চুলে তখনো হয়ত লেগেছিল গোলাপের গন্ধ । ইলতুতমিসের শাহজাদির জীবন
এইভাবেই শেষ হয়েছিল । পঁয়ত্রিশ বছরের বর্ণময় জীবন , তুবড়ির মত আগুনের ফোয়ারা হয়ে আকাশ ছুঁতে চেয়েছিল
, সেই জীবনে ছিল মানুষের আস্থা আর আশীর্বাদের স্নিগ্ধতা
, ছিল প্রেমের গনগনে তাপ ,ক্রীতদাস
কে ভালবেসেছিলেন , বিদ্রোহী ষড়যন্ত্রকারীকে বিয়ে করেছিলেন , ছিল
কর্তব্যভারের তুমুল ব্যস্ততা ,শত্রুপক্ষের
সঙ্গে পদেপদে টক্কর , সাবধানী চতুর ষড়যন্ত্র , শানিত চিন্তা , দীপ্র ব্যক্তিত্ব ।
আজ পুরনো দিল্লির চাঁদনি চকে তুর্ক মান গেটের কাছে বুলবুলি খানে গলির গলি
তস্য গলির ভেতরে , যেখানের
সূর্যের রোশনি প্রায় পৌছয় না ,দুটো মানুষ পাশাপাশি হাঁটতে
পারে না , চারদিকে হতশ্রী বাড়ি দিয়ে ঘেরা এক মলিন জীর্ণ মহল্লায় অনাদরে অবহেলায় এবড়ো খেবড়ো পাথরের মধ্যে লুকিয়ে আছে শাহজাদির
মকবারা । না কোন সাজসজ্জা , না কোন
আয়োজন । হিন্দুস্তান
এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম মহিলা শাসক প্রধানের সমাধিতে কেউ একটা ফুল ও রাখে
না ।
সাহিল কে সু কুঁ সে কিসে ইনকার হ্যাঁয় লেকিন
তুফান সে লড়নে মে মজা অ উর হী কুছ হ্যাঁয়
আল এ আহমদ সুরুর
মুগ্ধ ।
ReplyDeleteসাবাশ!
অনেক অনেক ধন্যবাদ ।
ReplyDeleteThis comment has been removed by the author.
ReplyDeleteঅনেক অনেক ধন্যবাদ ।
ReplyDelete