Thursday 5 January 2017

জীবনরেখারা

ঙ্গ সারি গুলাবি চুনারিয়া রে,মোহে মারে নজরিয়া সাঁবরিয়ারে

অমলতাস আর ছাতিমের তলা দিয়ে যখন তার দীঘল মেদহীন টান টান শরীর , চাপা গাল আর টিকলো নাক , গর্বিত চিবুক ,পাকা গমের মতো গায়ের রঙে সকালের রোদ পিছলে পিছলে যায় তখন আমিও বার কতক মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছি । এ তো পড়ালেখা জানেনা , বিউটি পার্লারের দোরগোড়াতেও কোনদিন যায় নি । কিন্তু কি দৃপ্ত তার ভঙ্গি । একেবারে স্বাভাবিক । যে কোন নজরিয়াকে টুসকি মেরে উড়িয়ে দিতে পারার ক্ষমতা রাখে , দেখে তাই মনে হয় । 
মাথায় কাপড়ের মস্ত গাঁঠরি , তাতে শুধু গোলাপি নয় আছে কতো বান্ডিল বান্ডিল নানা রঙের জামাকাপড় । সে হল আমাদের বিমলা আন্টি । আমি আন্টি বলি, বলতে ভালো লাগে । বিমলা আন্টি আমাদের পাড়ার ধোপানি । ওর একটা খিটকেল বর আছে , রামস্বরূপ । কোন জামাকাপড় তাড়াতাড়ি ইস্ত্রি করতে হলে রামস্বরূপকে ফোন করতে হয় । সে বলে এখখুনি নিয়ে আসছি । আমি বলি বিমলা আন্টি আসবে? তাকেই পাঠাও না কেন? তোমার ওই হাঁড়িচাঁচার মতো মুখটা কি না দেখলেই নয়?
 
বিমলা আন্টি এসেই তার গুছিয়ে পরা কোটা শাড়ির ঘোমটা একটু টেনে গলা তুলে বলে, কাপড়া । তারপর গাঁঠরি খুলে বলে, গিনলো। আবার নতুন কাপড় দেওয়া শুরু হয়। এবার টাকা দেবার পালা । আমি ফস করে বলে বসি, তুমি কি সুন্দর দেখতে, বিমলা আন্টি ।
 
 মাথা নিচু করে টাকা গুনছে বিমলা আন্টি । আমার এই কথায় তার নিচু চোখের পাতা, বসা গাল ,টিকলো নাক, গর্বিত চিবুক ,কোথাও এতটুকু পরিবর্তন দেখতে পাই না । চোখ দুটো তুলে বলে , সত্তর রুপিয়া , ইয়ে লো তিস রুপিয়া ওয়াপস । 
 বিমলা আন্টিকে ঠিক এখানে মানায় না । আমি দেখতে থাকি, হুহু করে বালি মেশানো গনগনে হাওয়ার মধ্যে হুড খোলা জিপে বিমলা আন্টি দাঁড়িয়ে আছে , কপালে কমলা রঙের সিঁদুর , গুছিয়ে পরা সাঙ্গানেরি শাড়ি, কোমরে তিনকোনা রুমাল , হাতের কব্জিতে লাল হলুদ সুতো । ধুলো মাখা একপাল গ্রামের লোক চিল্লিয়ে যাচ্ছে বিমলা দেবীকি জয় । অগলে চুনাব মে….

ইডলি দোসা সম্বরম, রান্নাতে আমি উত্তমম

পুনম আন্টির অবস্থা কিন্তু বরাবর এমন ছিল না । পালিকা ভবনের গমগমে বাজারে তার নিজের খাবার দোকান ছিল । কর্তা গিন্নি দুজনে মিলে সেটা চালাতো । বড় বড় স্টিলের বাসনে উপচে পড়তো ধোঁয়া ওঠা ইডলি , দোসা, উত্তপম, তিন রকম চাটনি আর সম্বর ডাল । দুটো কাজের লোকও ছিল । কিন্তু এত ধকল আর শরীর নিল না । তাই একরম বাধ্য হয়ে মাধবীলতার ঝাড় আর ঘন বুড়ো ছাতিম তলায় পার্কের রেলিং ঘেঁসে সকালে সব্জি বিক্রি করে । সবার সঙ্গে হেসে হেসে কথা বলে।আর ওর বরটা একটা শালগ্রাম শিলার মতো গোমরা মুখে একজায়গায় বসে হিসেব লেখে । পুনম আন্টির চোখে লেপ্টে থাকে কাজল, মাথায় বাসি ফুলের মালা । দেখলেই একগাল হাসি দিয়ে বলে ,নমস্তে । মাশরুম আছে, খুব তাজা, আরো দেখো, একদম ফ্রেশ । সে আমি জানি । ভোর চারটেয় উঠে মান্ডি যায় পুনম আন্টি । দেখে রাখা বাজার পুনমের ছেলের বউ এর হাত দিয়ে আমার বাড়ি চলে যাবে । তবে তার ছেলের বউ লছমি মাথা কুটে কুটে আমাকে একশ বার বলেছে , সে তার শাশুড়িমায়ের নখের যুগ্যি নয় । সে আর বলতে । আমি ছাড়া আর কে তা ভালো জানে? ওদের বাড়িতে খুব পুজো আচ্চা হয় । আর আমার বাড়িতে তার প্রসাদ আসে । সে কতরকমের খাবার, নোনতা , মিস্টি , পিঠে,মুরুক্কু ,চানা বড়া মেদু বড়া ।
একেবারে দোকানের মতো । সব পুনম আন্টির বানানো । লছমি তো অষ্টরম্ভা ।
সকালে সময়মত আসে না , বেলা গড়িয়ে যায়, আপিসে যাবার সময় এগিয়ে আসে , আমার খিদে পায়, মেজাজ সপ্তমে চড়তে থাকে । শেষে ভাবি, দুত্তোর বেরিয়েই পড়ি। কাঁহাতক চলে এসব, সক্কাল বেলায়? আচ্ছা শিক্ষা দেবো আজকে । হঠাত দড়াম করে লছমি এসে হাজির হয়। আমি মুখ খোলার আগেই বলে ওঠে, আজ খুব খুব দেরি হয়ে গেছে । এইজন্যই তো ব্রেকফাস্ট বাড়ি থেকে নিয়েই চলে এলাম। গরম গরম খেয়ে নিন । মাম্মি নে বানায়া । আমি তখন জুল জুল করে পুনম আন্টির হাতে বানানো ধোঁয়া ওঠা ধপধপে নরম ইডলি , আধখানা ভাঁজ করা নরম মুচমুচে দোসা আর তিন রকম চাটনি দেখে ভাবি , একদিন না হয় অফিস যেতে একটু দেরিই হল । তাতে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাবে?

 
সায়েন্স, পোলিটিকাল কা

গীতা কে কেন যে আমি প্রথম থেকেই গীতাজি বলে ডাকতে শুরু করলাম তার কারণ আমি বেশ ভালো করে অনুসন্ধান করে দেখেছি । সে আমার ঘর লাগোয়া দশ ফুটিয়াতে থাকে আর আমার বাড়ির কাজ করে । গীতাজির সময়ের দাম আছে । সে সময় হাতে ঘড়ি পরে থাকে । ঝড়ের গতিতে বাড়ির কাজ করে আর একটা সরকারি অফিসে দিন মজুরি খাটে । কোন আধা অধুরা কথা বার্তা তার সঙ্গে চলে না । গীতাজি একটু বাইরে যাচ্ছি । একটু পরে ফিরব । এসব এলোমেলো কথা একেবারেই চলবে না । গীতাজি জানতে চাইবে ঠিক কটার সময় আমি ফিরব । কিতনে বাজে? 
চা খাব । কিতনে বাজে? কাল কিন্তু দেরি করে ঘুম থেকে উঠব। কিতনে বাজে?
 
মাঝে মাঝে এইসা রাগ হয় । শোনো অত ঘড়িঘন্টা মেপে বলতে পারব না ।
 
গীতাজির বক্তব্য, তারও তো নিজের একটা শিডিউল আছে, তাই আমার সময় তার কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ । কারণ সে চায় না তার নামে কোন অভিযোগের আঙুল ওঠে । গীতাজির বর কোন একটা সরকারি দপ্তরে কাজ করে। কিন্তু সংসারের হাল গীতার হাতে । মেয়েকে আই এ এস বানাবে । ওজন কমানোর জন্য একবেলা খায় না । প্রতিদিন নেলপালিশ বদলে বদলে লাগায় । নবরাত্রির সময় আমাকে সাবুদানা খিচুড়ি খাওয়ায় । মাতা রানির কাছে আমার কল্যাণ কামনা করে । আর মাঝে মাঝেই বলে, ম্যায় থোড়া পাতলি হো গয়ি না ? কথায় কথায় গীতা জানায় সে বি এ ফাইনাল দিচ্ছে । আমিতো অবাক । এতো কাজকর্ম করে কখন পড়ো তুমি?
রাত্তির বেলা । এগারোটা থেকে একটা । কোথায় বসে পড়? ঘরে তো সবাই ঘুমায় তখন। গীতা বলল ও সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ বসে পড়ে । আমি আরো জানতে চাই । কি কি সাবজেক্ট তোমার?
হিস্ট্রি , ইকনমিক্স আর সায়েন্স ।
এ আবার কি অদ্ভুত কম্বিনেশন ? কোনদিন শুনিনি । এগুলোর সঙ্গে সায়েন্স? কি সায়েন্স , গীতাজি?
কেন? খুব অবাক হয়ে গীতাজি বলে , সায়েন্স, পোলিটিকাল কা ।
Top of Form

2 comments: