Saturday 22 July 2017

মেরহাবা, আওয়ারগি /১


 টোমান আর বাইজান্টাইন রোমান । জোর লড়াই ।  কনস্টান্টিনোপলের বুকে জোর লড়াই । কত রক্ত । কত হত্যা । কত লুটপাট । কৃষ্ণসাগরের জল লালে লাল হয়ে গেল । কামান দেগে নগরের পাঁচিল ভেঙে ফেলে ঘোড়া টগবগ করে ছুটিয়ে মেহমুদ সোজা হাজির হলেন আয়া সোফিয়া গির্জায় । রাতারাতি সেই গ্রিক রোমান চার্চ হয়ে গেল তুরকিশ মসজিদ  । তারপর প্রাণ মন দিয়ে কনস্টান্টিনোপল কে  ইস্তানবুল বানিয়ে তাকে সাজিয়ে সাজিয়ে নাস্তানাবুদ করে তুললেন ।
আজ সন্ধ্যায় রাস্তার দুপাশে বাতিগুলো ঝলমল করে জ্বলে উঠেছে । সাঁঝের মিঠে   হাওয়ায় টুং টাং করে দোল খাচ্ছে রঙ বেরঙের কাঁচের ডোমশিশা বা হুঁকোর  জ্বলন্ত টিকের মধ্যে ঢেলে দেওয়া হচ্ছে লেবু , কফি , আপেল , মিন্টের সুগন্ধ । সেই সুগন্ধ , কৃষ্ণসাগরের তাজা মাছ ঝলসানোর উমদা খোশবায়ে ,  বেলোয়ারি বাতির রঙ মশালে , অপরূপ নক্সাকাটা  কুশনের স্বপ্নজমিনে বসে আমার তখন তুমুল  নেশার ঘোর ।  
উঠে পড়ে ঢিমে তালে প্রায় মাতালের মতই হাঁটছি । আর দেখছি সামনে প্রস্তুত  যুদ্ধ ক্ষেত্র সেনাবাহিনী তটস্থঅটোমান আর বাইজান্টাইন রোমান । আগুপিছু আগুপিছু । জবরদস্ত তাদের পোশাক । আমিও যুদ্ধ দেখতে দাঁড়িয়ে পড়লাম । পাথুরে পাঁচিলের গা ঘেঁসে ম্যাপল গাছের তলায় তখন দারুণ লড়াই
আমাদের দেখে চশমা পরা হাসিমাখা চোখ দুটো ওপরে উঠল ।
একগাল হেসে নুরানি বলল , খুব ভালোবাসি দাবা খেলতে । সাত বছর বয়সেই দাবা ধরেছি । বসো বসো , তোমরা ইন্দিস্তানি । আমরা ব্রাদার তো । ভাই ভাই । ইন্দি তুর্কি ভাইভাই ।
দেখলাম নুরানির চারদিকে বেশ সুন্দর করে চেয়ার পাতা, রাস্তার ধারে  । বসো , খেলো , হুঁকো খাও । ভারি মজলিসি এরা ।
তুমি একা একাই দাবা খেলো ?
এই সামনের দোকানটা আমার ।

দেখলাম থরেথরে লোভনীয় রঙদার রকমারি জিনিশ দিয়ে সাজানো বেশ বড় দোকান ।
কাজ না থাকলে থাকলে দুহাত খেলে নিই ।

নুরানির সঙ্গে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে গপ্প জুড়ি । এখানে সব্বাই খুব গল্প করতে ভালোবাসে । বকর বকর বকর বকর ।
নুরানি আরো বলে , ও সাইকোলজি নিয়ে পড়ে । রাত বারোটায় দোকান বন্ধ করে বাড়ি যায় ।
আবার সকাল সাতটায় উঠতে হয় । পড়তে বসতে হয় একটু ।  
আচ্ছা নুরানি , তুমি ভালো গাইডের সন্ধান জানো ? এই আমাদের ঘুরিয়ে টুরিয়ে দেখাবে ?
কেন ? গাইডের কি দরকার ? এই চারপাশেই তো সব । হেঁটে হেঁটে নিজেরাই দেখে নাওনা  । ফালতু  গাইডের কোনো দরকারই নেই আর ট্রামে করে ঘোরো ।  
নুরানি একলাইনেই সব ছিমছাম করে দিলো । পরে বুঝছিলাম ব্যাটা ঠিকই বলেছিল , খুব ইয়ার দোস্তি আর আওয়ারগির শহর  ।কোন অসুবিধেই হয় না ।  
আচ্ছা নুরানি, এখন খেতে যাই । কোথায় যাবো বলতো ?
এখানে কত খাবারের দোকান , যে কোনো একটায় চলে যাও । না না রাত্তির হলে কোনো ভয় নেই । এই শহর রাতে জেগে থাকে ।
তা বেশ, আমরা বন্ধু হলুম । আবার দেখা হবে ।












সুলতান আহমেট স্কোয়ারে রাস্তার দুপাশে যেন মোচ্ছব লেগেছে । দু পাশের দোকান থেকে সবাই জবরদস্তি খাওয়াতে চায় । আমরাও হাঁটতে হাঁটতে উঁচু নিচু ঢালু পথ পেরিয়ে বেশ অনেকটা চলে এলুম । এবারে একটা দোকানে ঢুকতেই হয় ।  সন্ধ্যায় ইস্তানবুলে এসেছি , এখন  রাত প্রায় সাড়ে দশ । আরে আসুন । আপনার পথ চেয়েই বসে আছি যে টাটকা মাছ , ব্ল্যাক সি থেকে , এখখুনি গ্রিল করে নিয়ে আসছি । এখন একটু মেজে খেতে থাকুন ।
এই বলে গুচ্ছের হামাস বাবাগানুশ অলিভ , পারস্লে, রুটি ,দই দিয়ে সে ভেতরে চলে গেল । তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর একটা মস্ত মাছ আস্ত গ্রিল করে নিয়ে এলো ।
আমি বললাম , যাব্বাবা , আমি ফিলে করতে বল্লুম যে । আর রুটিটাও কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা ।
আ হাহা , রাত হয়ে গেছে , রমজান চলছে , আমার রাঁধুনি ব্যাটা ভালো করে শোনে নি বোধহয় । কালকের লাঞ্চটা জব্বর করিয়ে দেবো । আচ্ছা, মাছের কাঁটা গুলো আমি ছাড়িয়ে দিচ্ছি ।
এই বলে মাছের কাঁটা ছাড়িয়ে ছাড়িয়ে আমাদের পাতে তুলে দিচ্ছে আর দুনিয়ার গপ্প বলে যাচ্ছে ।
এই যে জার্মানি ফ্রান্স ইটালি , একদম দেখতে পারি না জানোতো ? আমাদের হ্যাটা করে আমাদের কি নেই ? সব সব সব আছে । বোস্ফোরাস ক্রুজ নেবে ? একদম নিও না । হাবিজাবি হাবিজাবি । কতগুলো যাত্রার মত ড্রেস পরে নাটক করবে, যা তা খাওয়াবে , আর বেলি ডান্স দেখাবে । অমন বেলি ডান্স আমিও জানি , দেখিয়ে দেবোখন । শোনো গালাটা ব্রিজ থেকে জাহাজ ছাড়ে , চড়ে বসলেই হল অত ক্রুজ ট্রুজ করতে হবে না । মাছটা দেখো কি ফ্রেশ ! কোনো বাসি জিনিশ  নেই আমার দোকানে। সব টাটকাওই গালাটা ব্রিজের নিচে রাশি রাশি দোকান। সব বাসি খাবার । একদম খাবেনা কিন্তু ।
ও গাইড ? কোনো দরকার নেই । নিজেরা চলে যাও । গিয়েই দেখবে সব্বাই কথা বলছে , টকিং টকিং টকিং। কিন্তু শোনার লোক নেই । আর যদি মনে হয় শুনবে একটু, কোনো একটা গ্রুপের পাশে টুক করে বোকা বোকা মুখ দাঁড়িয়ে পড়বে ।
ওর কথা তখনো অফুরন্ত । এদিকে আমাদের খাওয়া শেষ । পাশের দোকান থেকে ইফতারের হুল্লোড় ভেসে আসছে । ডুগি বাজনা বাজিয়ে কারা গান গাইতে গাইতে চলে গেল । আইসক্রিম খেতে খেতে ছেলেমেয়ে নিয়ে গেরস্থরা বাড়ি ফিরছে ।
আচ্ছা চলি।  
কাল এসো , মনে করে, আমার দোকানে সবসময় টাটকা...





খাওয়া শেষ করে একটা বিটকেল ঘুরন্ত পথে হোটেলে ফিরলাম । ঝকঝকে নীলচে কালো আকাশের নিচে ব্লু মস্ক আর আয়া সোফিয়ার সঙ্গে দেখা হল । যখন হোটেলে ফিরছি, রাত হয়েছে ঢের , কিন্তু জমজমাট ইফতার ,হাসির ছররা , খুশির তুফান রাতকে যেন দিন করে দিয়েছে ।



সকালবেলা আমাদের হোটেলের খাবার ঘর থেকে দেখি বসফোরাসের নীল জলে রোদের আলো , ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ , আর সি গাল বড় বড় ডানা মেলে উড়ছে । তার মানে জলের প্রায় কাছাকাছি আছি আমরা  । শহরটা উঁচু নিচু । শোবার ঘর থেকে মুখ বাড়িয়ে দেখি সেই ম্যাজিক পাড়াটা উধাও । শুনশান । কে বলবে মাত্র কয়েক ঘন্টা আগেই স্বপ্নের তারাবাতিরা জ্বলে উঠছিল । নুরানির দোকান বন্ধ । চেয়ারগুলো নেই । মানে সকালটা একটু দেরিতে শুরু হয় এখানে  ।



মিমার সিনান একজন নামজাদা স্থপতি ছিলেন অটোমান দের সময়ে । বিভিন্ন সুলতানদের নামে পেল্লাই সব মসজিদ গুলোর তিনিই রূপকার । আমাদের তাজমহলেও নাকি তার চিন্তা ভাবনার মিশেল ধার করা হয়েছিল । ইস্তানবুলে মিমার সিনানের নামে ফাইন আর্টস ইউনিভার্সিটিও আছে ।  ১৫৮৪ সনে সিনান কে দিয়ে হাম্মাম বানালেন সুলতান দ্বিতীয় সেলিমের বেগম নুরবানো ।  সুলতান আহমেট স্কোয়ার থেকে মাত্র এক স্টপ পরেই মাহমুদ পাশা মস্কের পাশেই চেম্বারলিটাস হাম্মামি । সেই তখনকার আমলের বানানো  । প্রায় সারাদিন খোলা । আমরা সটান গিয়ে হাজির । সব কিছু দেখে শুনে ঠিক হল আমরা কালকে আসব টার্কিশ বাথ নিতে । কারণ আমরা তো চান  টান করেই কুমড়োর তরকারি দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে রওয়ানা হয়েছিলাম, যদিও পাঁজিতে কুমড়ো খাওয়া বারণ ছিল, কিন্তু কুমড়ো টা পচে যাচ্ছিল কিনা তাই । তারপর  রাস্তায় মশলার দোকানে ঢুকে আবার গুলতানি । ট্রামের টিকিট কিছুতেই কাটা যাচ্ছে না । আবার সেই মশল্লা ওয়ালাকে ধরে তাকে গুনে গেঁথে ভাড়া দিয়ে তার মান্থলি ট্রাম পাসটা মেশিনে ছুঁইয়ে তবে শান্তি । ব্লু মস্ক আর আয়া সোফিয়া জুড়ে সুসজ্জিত এলানো চত্বরে তখন জাঁকালো মেলা । কিছুক্ষণ পরেই ইফতার । ছেলেপুলে নাতিপুতি নিয়ে কত কত পরিবার জড়ো হয়েছে । সকলের মিলিত খুশি বিকেলের সোনালি আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে , পায়ের নিচে পরিষ্কার পথ , নকশা কাটা জলের কল , ফেল্টের মত নরম সবুজ ঘাস । ফলের রস কোল্ড ড্রিঙ্কস আইরান কাবাব রুটি একে একে জড়ো হচ্ছে । ওদিকে ইস্তিকলাল স্কোয়ারের বিখ্যাত মিষ্টান্ন  ভান্ডার হাফিজ মুস্তাফার লোকেরা এখানেও দোকান খুলে বাকলাভা কুনেফে  বাকলাভা কুনেফে বলে চিল চিৎকার করছে আর কি এনার্জি লেভেল । সারাদিন উপোস করেও কি বাজখাঁই গলা ! দেভরিশ ক্যাফে তে এখন তো  কিছুই পাওয়া যাবে না । কাজেই একটা করে  দোনদুরমা খাওয়া যেতে পারে । ওমা সেখানেও কি নৌটঙ্কি !





আমরা হাতে কোন ধরে দাঁড়িয়ে আছি  , সেই কোনের মধ্যে  এক খাবলা দোনদুরমা থুড়ি আইস্ক্রিম ঠুসে দেওয়া হবে । কিন্তু পুরো কেনা বেচাটাই একটা নাটক ! দোনদুরমা আসছে যাচ্ছে , মুখের থেকে সরে যাচ্ছে , প্রায় ম্যাজিক দেখানোর মত করে দোনদুরমার পরতে পরতে দিল্লাগি মজাক আর নৌটঙ্কি মিশিয়ে দিচ্ছে দোকানের লোকগুলো ।
ক্রেতাকে কতটা আনন্দ দেওয়া যায় , আহা দেখে বড্ড ভালো লাগল ঝানু ব্যাবসাদার, সন্দেহ নেই । কিন্তু পেশকশ টি বড় মধুর । বড় মন কাড়া । সবজায়গায় । আমার মনে পড়লো বেশ কয়েক বছর আগে কায়রোর কথা । সেখানে বিক্রিবাটার দিকে কোন উৎসাহ নেই । একটা দোকানে ঢুকে দেখি একটা মুশকো লোক চেয়ারে পা তুলে টিউনিশিয়া আর ইজিপ্টের ফুটবল ম্যাচ দেখছে । আমরা যে দোকানে ঢুকেছি তাকিয়ে দেখছেও না পর্যন্ত । আমরা গলা খাঁকড়িয়ে বললাম ইয়ে বাটার আছে? ও হরি , নড়েচড়েও না । কিছুক্ষণ পরে বলল বাটার ?  তারপর হাত মাথা নেড়ে বোঝালো সে জানে না সেটা খায় না মাথায় দেয় !
একটি মহিলা , তিনিও কেনাকাটি করতেই এসেছেন , গলা তুলে বললেন ,  জাবদা । তখন মুশকো লোকটা খুব অনিচ্ছার  সঙ্গে  একতাল গোবদা  মাখন এনে রাখলো । টার্কি এক্কেবারে উলটো মেরুতে ।








ব্লু মস্ক থেকে হেঁটে হেঁটে আরাস্তা বাজার । সেখানে আমার সদ্য পাতানো ভাই সেলিমের হাম্মাম সামগ্রীর দোকান । কতরকমের সাবুন , পেস্তামাল (তোয়ালে) মুখে মাখার মাটি , বাথ  সল্ট , লুফা । দোকানটা সুগন্ধে ভুরভুর । এর মধ্যে আবার এরদোগানের মুখ এক কোনায় লটকে আছে  । সামনের রেস্তোরাঁয় ভরপুর মজলিশ । গানের তালে তালে দরবেশ নাচছে , চুল এলিয়ে তুর্কি সুন্দরী হুঁকো খাচ্ছে ,  খাবারের জোগান দিতে লোকজন হিমশিম । ক্যারমের ঘুঁটির মত ঘুঁটি আর একটা বাক্স নিয়ে প্রচন্ড খেলা চলছে , আড্ডা তুঙ্গে উঠেছে ,হই হই হই হই ।  কিশোর  দরবেশের সাদা পোশাকের ঘেরে  ঝাপটাচ্ছে  মারমারা সাগরের ঢেউ
 এই ফাঁকে আমি সেলিম ভাই কে  জিগ্যেস করি , হ্যাঁ গো , সেলিম ভাই , তুমি এরদোগানকে বেশ পছন্দ কর,তাই না?
দোকানে ছবি দেখছি যে । 
সেলিম বলল , তুমি যেহেতু আমার বোন ( এমন ভাবে বলল যেন আমি ওর কত জন্মের বোন ! ) তোমায় বলতে কোন অসুবিধে নেই , এরদোগান ঠিক করছেন । আতাতুরক এতো বেশি বাড়াবাড়ি করেছেন না ! আমাদের খুব বেশি করে ইওরোপ বানিয়েছেন । আরে বাবা আমাদের তো নিজেদের ধর্ম সংস্কৃতি আছে না কি ? সব তো চুলোয় যেতে বসেছিল ।
নুরানির গলাতেও একই কথা শুনেছিলাম । সে বলেছিল অটোমান সংস্কৃতি মুছে দিয়েছেন আতাতুরক । অটোমান , উফ কি তাদের ইতিহাস ,  কি তাদের বীরত্ব,  কী গ্ল্যামার ! আমাদের খুব বর্ণাঢ্য ট্র্যাডিশন , সব উনি উলটে দিতে চেয়েছেন ।
আমি জানিনা কোন পথে ইতিহাস চলছে । একসময়এখানে  হিজাব পরা , দাড়ি রাখা নিষেধ ছিল । ইসলাম হয়েও সেক্যুলার রাষ্ট্র এখন কোন পথে হাঁটছে ? এতো সুন্দর একটা দেশ যেন নষ্ট না হয় ! আমাদের আশা ভরসা স্বপ্নের পরিসর ক্রমশই ছোট হয়ে আসছে !






পরের দিন সুলতানের হাম্মামে দাঁত কেলিয়ে হাজির হলাম । ভেতরে ঢুকেই মনে হল কয়েক শতাব্দী হুশ করে পিছিয়ে গেছি । ও , বলতে ভুলেই গেছি । চেম্বারলিটাস হামামের জিনিশপত্র আমার ভাই এর দোকানে দেখে বললাম, হ্যাঁ রে ভাই , তুই কি ওদের জিনিশপত্র বিক্রি করার এজেন্সি নিয়েছিস ? সে খুব অবাক হয়ে একচোট হেসে বলল  , ওটা তো আমাদের হাম্মাম । এই নাও আমি সই করে স্ট্যাম্প মেরে দিচ্ছি, ভালো ডিস্কাউন্ট পাবে । সত্যিই ডিস্কাউন্ট পেলাম ।
গোল গম্বুজ । ওপর থেকে অনেক উঁচু থেকে আলো আসছে । ঘরের ভেতরে গুমগুম প্রতিধ্বনি হচ্ছে । চারকোনা শ্বেত পাথরের মঞ্চ । গরম তপতপে হয়ে আছে । অতি রমনীয় রাজকীয় প্রমোদ ।সওনা , বাবল বাথ , অ্যারোমা মাসাজ । খুব খুশি খুশি মন নিয়ে সুবাসিত হয়ে  আইরান বোরেক আর কাবাব দিয়ে লাঞ্চ সেরে সোজা গ্র্যান্ড বাজারপনেরো শতকে এই বাজারের শুরু , এখানে চার হাজার দোকান আছে , অজস্র গলি আছে , সে সব শুকনো তথ্য দেবার কি দরকার ! সেখানে ঢুকে কিনি আর নাই কিনি পণ্য সম্ভারের উপচে পড়া বর্ণাঢ্য সম্ভার যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ ডাকাডাকিও চলছে প্রবল । মেরহাবা বললেই আরো বেশি করে ডাকছে । দরদস্তুর করতে হবে সেয়ানার মত । এরা খুব ব্যাবসা ভালো বোঝে । রমজান চলছে । খুব ক্লান্ত ভুখা সব । তার মধ্যে কী যে প্রাণশক্তি ! একদিকে কার্পেটের দোকান, একদিকে গয়না গাটি বাসনপত্র কাপড়জামা , কাঁচ , সেরামিক , চামড়া , পাথর , এন্তার দেদার । জৌলুস । রকমারি ।  এসব দেখে আমার আলিবাবা  গীতিনাটকের একটা গান ডাক ছেড়ে গাইতে ইচ্ছে করছিল , হমে ছোড়ি দেরে সাঁ ইয়া ছোড়ি দেরে ম্যায় নহি জানে দুনিয়াদারি ।
তারপর টাটকা কমলালেবুর রস খেয়ে   ট্রামে চেপে বসলুম ।  কায়রোতে এরকম  একটা বাজার আছে , খান এল খলিলি । সেটা  অবিশ্যি এতো সাজানো গোছানো বাজার নয় । বাজারের পাশেই একটা দোকানে বসে সাহিত্যিক নাইব মেহফুজ মিন্ট চা খেতেন । তা এখানে ওরহান পামুক বা আমার প্রিয় কবি নাজিম ঘোরাঘুরি করতেন কি না সেই তথ্য জোগাড় হয় নি । ট্রাম চলছে । প্রাচ্য পশ্চিমি মেলানো শহর । প্রাচ্যের উষ্ণতা আবেগ আর পশ্চিমি কায়দার মোড়ক । চমৎকার ট্রাম । কোথায় চলেছি কে জানে ! প্রায় পুরো শহরটাই লম্বালম্বি ভাবে দেখা হয়ে যাচ্ছে । দেখা হয়ে যাচ্ছে লোকজন । শিষ্ট সভ্য । সুন্দর শহর । ভারি সুন্দর । ভারি চমৎকার  সৌন্দর্য বোধ । টিউলিপ তাদের প্রিয় ফুল । এরও সূত্র বাঁধা অটোমান ইতিহাসে । সব জায়গায় টিউলিপের ছবি ,মোটিফ , নকশা । হল্যান্ড যতই চেঁচাক , টিউলিপের টিকি তুরস্কেই বাঁধা । অটোমান জমানায় একটা সুন্দর স্বল্পকালীন সময় এসেছিল , অনেকটা রেনেসাঁ র মত, তাকে বলে টিউলিপ পিরিয়ড । ইওরোপের টিউলিপ ম্যানিয়ারও আগে । ইস্তানবুলে এখনও টিউলিপ উৎসব হয় । ফুলের গড়ন পাগড়ির মতন অনেকটা , ফারসি টারবান থেকে শব্দটা এসেছে । অটোমান এলিটদের হাত ধরেই ইওরোপে পাড়ি দিয়েছে টিউলিপ ।




বন্ধুবর বলে ,  নামো এবার । আমরা যাবো তাক্সিম স্কোয়ারে । পরিবহন ব্যাবস্থা পুরোপুরি পশ্চিমি ধাঁচেরতাক্সিম স্কোয়ারে আতাতুরকের স্ট্যাচু । জায়গাটা পুরো এসপ্ল্যানেড । ভিড়টা একটু কম । সামনেই আবার  ভিড় ঠাসাঠাসি ইস্তিকলাল  । কাতারে কাতারে লোক । বেশ সম্ভ্রান্ত পাড়া । পার্ক স্ট্রিট টাইপের । আমি বল্লুম ওহে চলো , ভাইদের কাছে সুলতান  আহমেটে ফিরে যাই । ওখানে ম্যাজিক আছে ।আওয়ারগির ম্যাজিক । কেয়ারফ্রি স্টেট অফ মাইন্ড । আর  এতো মিনি কলকাতা । এ দেখার কোনো মানে হয় না ।





সেলিমের মামাতো পিসতুতো যত ভাই, তারাও এখন আমার ভাই । আরাস্তা বাজারে এসে মনের সুখে একেক ভাই এর দোকানে ঢুকে হরেক রকমের মশলা জাতার সুমাক ,পুদিনা, দিল , রোজমারি ।  নানান কিসিমের চা,শীতের চা, গরমের চা, অটোমান চা, ভালোবাসার চা ।  কোথাও কারপেট,বেদানার দানা ভাঙা ডিজাইন , কোথাও মাদালিন বা শক্তির প্রতীক, সুলতানের প্রতীক নানান কার্পেট ।  পেয়ালার পর পেয়ালা তুরকিশ চা , কত গল্প ,  তুরকিশ ডিলাইটের কিটকিটে মিস্টি নয় অথচ ভারি  সুস্বাদু চকোলেট, সব দোকানে ঢুকে ঢুকে  খুব খানিক আড্ডা দেওয়া হল ।ভাইরা খুব দুঃখ করে বলছিল গ্র্যান্ড বাজার স্পাইস বাজার এসবের কি এখন জাত ধর্ম বজায় আছে ? চিনের জিনিশ ঢুকে যাবার পর আগের সেই চরিত্র আর নেই ।

 খুব সুইট চারমিং শহর , একটু বিচ্ছু , একটু দুষ্টু , একটু একটু মিচকে বদমাশ আর ভরপুর ড্রামাবাজি  । আহ বড্ড ভালো । আবার মিঠে ঠান্ডা রাতে উঁচু নিচু রাস্তা বেয়ে বেয়ে বেলোয়ারি কাঁচের টুং টাং কানে নিয়ে মোজোর দোকানে হাজির হই । মোজো খাওয়াবে টেস্টিসি কাবাব । একটা মাটির কুঁজোর মত পাত্রের মধ্যে কাবাব টা রান্না হবে আর ফটাস করে সেটাকে ফাটিয়ে ভেতর থেকে কাবাব বের করে প্লেটে নিয়ে খেতে হবে । মানে সব কিছুর মধ্যে মেলোড্রামাটা একটু বেশি । সামান্য  জোলো স্টু ধরনের, বেশ হালকা । মোজোর দোকানে আমরা হুঁকো খেলাম । লেবু আর মিন্ট । আমার হুঁকো খাওয়া দেখে মোজো আর হেসে বাঁচে না । হাসতে হাসতে বোধহয় ফেটেই যাবে ।



ফেরার সময় দেখলাম নুরানি দাবা খেলছে । অটোমানদের নির্ঘাত জিতিয়ে দিচ্ছে । যে পথ দিয়ে হাঁটছি সেটা ইতিহাসের পথ, কত শতাব্দীর কত মানুষ হেঁটে গেছে । সেই সব অচেনা পায়ের ছাপ তো একেবারে মুছে যায় নি , তারা ফিরে ফিরে এসেছে বারবার , সেলিম হয়ে , নুরানি হয়ে, মোজো হয়ে ।  আমরা পা ঘসটাতে ঘসটাতে ফিরছি  আর ঠাণ্ডা শিরশিরে হাওয়া গান গাইছে

ইয়ে দিল ইয়ে পাগল দিল মেরা
কিউ বুঝ গয়া আওয়ারগি
ইস দস্ত মে এক শহর থা  
উয়ো কেয়া হুয়া আওয়ারগি
এক অজনবি ঝোঁকে মে
জব পুছা মেরে ঘম কা শবব
শেহরা কি ভিগি রেত পর
ম্যায়নে লিখা আওয়ারগি ।।




কবিতা মোহসিন নকভি

ছবি লেখক 

4 comments:

  1. এই মেঘলায় একটা ঝলমলে ইস্তানবুল ঢুকে পড়ছে আমাদের রবিবারে

    ReplyDelete
    Replies
    1. আপনাকে অনেক ধন্যবাদ

      Delete
  2. মুগ্ধবোধ! যেন রূপকথা!কুর্ণিশ!

    ReplyDelete
  3. আরে অনুরাধা , খুব ভাল লাগে আপনি পড়লে

    ReplyDelete