Friday, 29 August 2014

ইকো ফ্রেন্ডলি

 
“সকালবেলা একা একা আবার হাঁটতে যাবেন না যেন ।“
“কেন, গেলে কী হবে? “ খুব আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করি ।  আমার তো যাবার খুবই ইচ্ছে । হবে নাই বা কেন? যে দিকে দু চোখ যায় সবুজ গাছের সারি আর চকচকে রাস্তা । দেখলেই মন ভাল হয়ে যায় ।
“কিছুদূর গিয়েই হয়ত দেখলেন চুপিচুপি পেছনে একটা চিতাবাঘ আসছে । তখন ? এখানে যে কতো দুর্ঘটনা ঘটেছে ,তাই বলছিলাম সাবধানের মার নেই”।
আমাকে এই কথা গুলো বুঝিয়ে সে রাতের মতো কেয়ারটেকারটি বিদায় নিল ।
না এটা কোন বনবাংলো নয় । এসেছি চান্দায় (মহারাষ্ট্রের চন্দ্রপুর) গোলাবারুদ ফ্যাক্টরি তে নিতান্তই অফিসের কাজে । ফ্যাক্টরিগুলো শহরের বাইরেই বেশি হয় । বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন গাছপালা ঘেরা অনেক অনেক জায়গা  । তার যে এমন মারাত্মক গল্প আছে কে জানতো ।
পরের দিন প্রায় সারা রাত ধরে ক্যানেস্তারা পেটানোর শব্দ শুনলাম , চিতা বাঘ তাড়ানো হচ্ছে । ইঁদুর ধরার  খাঁচা বাড়িতে যেমন রাখা হয় তেমনি চিতা ধরবার জন্য বড়বড় খাঁচা বসান হয় এখানে ।
চান্দায় এসেছি অথচ তাড়োবার জঙ্গল দেখতে যাব না ? এখানকার সেই  চার বাচ্চেওয়ালি বাঘিনী তখন রীতিমত বিখ্যাত ।
“তাড়োবায়  আর গিয়ে কী করবেন ? এখানেই বসে থাকুন , ওখানে যা যা দেখতে পেতেন ,দেখবেন সবই  একে একে আপনার সামনে হাজির হচ্ছে । “ কর্মকর্তাদের একজন কেউ আমাকে বললেন । আসলে তাড়োবার জঙ্গল ঘিরে আছে চান্দা ফ্যাক্টরিকে । “জঙ্গল তো পাতলা হয়েই আসছে । তাই এখানেই আমরা  অনেক  কিছু দেখতে পাই “।   অর্থাৎ চান্দার গেস্ট হাউস কোন ফরেস্ট বাংলোর চেয়ে কম কিছু নয় ।
সেদিক থেকে আমাদের সল্টলেকের সরকারি বাড়িটা ছিল খুবই ইকো ফ্রেন্ডলি । মাঝে মাঝে শীতের রাতে জমকালো হুক্কাহুয়া হুয়া হুয়া  ডাকে মনে হত যেন শীতটা আরো জাঁকিয়ে পড়ল । বাগানে একটা ঢোঁড়া সাপ নিয়ম করে বেড়াতে আসত । তবে খুব বেশি নয় কারণ চারদিকে বেজিরা টহল দিত ।  আর ছিল প্রচুর পাখি । ফিঙে , দোয়েল , মৌটুসি আরো অনেক আমি তাদের নামও জানিনা ।  একটু হলুদ ডানার ঝলক একটু বাহারি ঝুঁটির দেমাক দেখিয়ে উড়ে পালিয়ে  যেত ।  বাগানে রাজত্ব ছিল কাঠবেড়ালিদের । আমরা মুড়ি বাদাম ছড়াতাম , পাখিদের খাবার দিতাম । নীল ডানা ছড়িয়ে কিংফিশার মাছরাঙা  বসে থাকতো  ।  এমনকি লাল চোখো রাগী কোকিল কতবার পাতার ফাঁক থেকে বেরিয়ে এসেছে । গা ঘষটে ঘষটে শামুকের দল বারান্দায় উঠে পড়ত । অবিশ্যি ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফের খেসারৎ ও  ছিল ভালোই  ।  দেওয়াল আলমারিতে উই লেগে সবকিছু নষ্ট হয়ে যেত ।

এই  প্রকৃতি ,মহাবিশ্ব মহাকাশ আর আমি একা  মানুষ এই দুই এর  মধ্যে যে নিবিড় অচ্ছেদ্য একাত্মতা   সেটা ভেঙে গেলেই যত উৎপাত আর গন্ডগোলের শুরু । মানসিক শারীরিক সবকিছুর ।  আমাদের পরম শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানী সজল বন্দ্যোপাধ্যায়ের জাইরোসোনিক্সের   ( Gyrosonics)  গবেষণার বিষয় তাই । সজল দা বলেন মাটির কাছাকাছি থাকবি, ঘাসে ,রোদে জলে মিশে । সজলদা চিনিয়ে দেন ,দেখ সব জায়গায় কেমন একই প্যাটার্ন , গাছের পাতায় শিরা উপশিরার জালি , আকাশ চেরা বিদ্যুৎ, তোর হাতের রক্ত বয়ে নিয়ে যাওয়া নালী গুলো সব এক প্যাটার্নের । ছক একটাই । ফ্র্যাক্টাল ।   চালাকি করে ডিজাইন ভেঙেছিস কি মরেছিস ।  সজল দা কে বলি ,জানেন কাঠগোলাপ গাছটায় বসার একটা সুন্দর ব্যাবস্থা বের করেছি । নাম দেওয়া যেতে পারে Frangipani couch  । বেশ আরামেই বসা যায় । আমি সকালে ওখানে বসেই চা খাই , খবরের কাগজও পড়ি । দু একটা কাঠ পিঁপড়ে আসে না যে তা নয় ,একটু টোকা মেরে ফেলে দিলেই হয় । একদিন  ঝিরঝিরে বৃষ্টি  এসে গেল । ঘন পাতার জন্য গায়ে জল  পড়ছিল না । ওমা , কোত্থেকে একটা বড় পাখি (নাম জানিনা) বৃষ্টি থেকে বাঁচতে গাছটার পাতার নিচে এসে বসলো । আমি ও বসে আছি , পাখিও বসে আছে । আমাদের দুজনকেই গাছ জড়িয়ে আছে নিবিড় ভালবাসায় ।
সজলদা শুনে বলেন গাছ থেকে এনার্জি নিয়ে নিবি ,  ওর থেকে  শক্তিশালী  পজিটিভ  এনার্জি  বের  হয় । চুপ করে বসে থাকবি ওর নিচে ।
যত্ন করে প্রাণায়াম তো আর করা হয় না ,ওই একদিন বসে দম নিচ্ছি ,ছাড়ছি । একটা নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে ,একটা ছন্দে বলা যেতে পারে । একটা মৌটুসি পাখি তার রিনরিনে সুরেলা গলায় ওই একই মাত্রায় ডেকে যাচ্ছে ,আমার নিঃশ্বাস প্রশ্বাস আর তার ডাক তালে তালে কেমন জড়িয়ে মিশিয়ে যাচ্ছে !


Frangipani couch    সল্ট লেকের বাড়িতে


আজকাল লোকে দেদার পয়সা খরচ করে ইকো ফ্রেন্ডলি ট্যুর করে । দুই কিস্তিতে সাত বছর ভুবনেশ্বর বাস আমার সে শখ মিটিয়ে দিয়েছে । আমি দুটো বাড়িতে থেকেছি  এক নম্বর আর এগারো নম্বর ।  এলাকা টার নামও একেবারে মানানসই , ফরেস্ট পার্ক ।
এক নম্বর বাড়িতে বারান্দাটা দেখা যেত না । ছাদ থেকে লতানো পাতা দিয়ে পাতার ঠাসবুনুনি পর্দা করা ছিল মাটি পর্যন্ত । আমি তো আর টারজান নই । সেই পর্দা উপড়ে ফেলতেই হল । সাবাড় করে দিতে হল পাতা পচানো সারের দুটি ঢিবি । তার দুর্গন্ধে টেকা দায় । বাগানের চৌবাচ্চায় এই বড়বড় কচ্ছপের সাইজের ব্যাং থাকত । আর তাদের কী ডাক । পিলে চমকানো । আর সারা বাড়ি জুড়ে তিড়িং বিড়িং লাফাতো নানান সাইজের ব্যাং । সাপের কথা আর আলাদা করে কি লিখব ।
গাছপালার বাড়বাড়ন্তের সীমা তো ছিলই না । এই কাটছি এই গজাচ্ছে  । এক সময় হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম ।  নাম না জানা পোকা বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে কামড়ে দিয়ে চলে যেত । সেই ভয়ঙ্কর মুখ নিয়ে অফিস ও করতে হয়েছে । বোলতার কামড় তো খেতে হয়েইছে । চান টান করে বেশ তোয়ালে দিয়ে গা হাত পা মুছলেন , কিন্তু সারা শরীর চুলকে একসা ! তোয়ালের গায়ে তো শুঁয়ো পোকা লেগেছিল । তাকে তো খেয়াল করাই হয় নি । এসব তো আমাদের হামেশাই হত ।  ইকো ফ্রেন্ডলি লাইফে আরেকটা দরকারি বিষয় হল সেন্স অফ টাইমিং । সেটা কী রকম ? যেমন পিঁপড়ের সারি যেই মাটি তুলতে শুরু করবে বুঝে নিতে হবে মেঘ ডাকল বলে । কাজেই হাতের কাছে সব গুছিয়ে নিতে হবে কারণ গাছের দুলুনিতে ঘষা খেয়ে এক্ষুনি ইলেক্ট্রিকের তার ছিঁড়ে কারেন্ট চলে যাবে । ইনভারটার আবার ইকো ফ্রেন্ডলি বাড়িতে থাকে নাকি ?
বৃষ্টি শেষ হলেই ফড়ফড় করে উড়তে শুরু করবে উই পোকার দল । যদি দরজা জানালা খোলা পায় তবে আর রক্ষে নেই । রেড্ডি আগেরদিন নুনের বদলে   চিনি দিয়ে চিকেন রান্না করেছিল বলে আমি রেগে মেগে নিজেই রান্না ঘরে ঢুকলাম । খেয়ালও করিনি যে গোধূলির আকাশ পতঙ্গে পতঙ্গে ছয়লাপ । তারপর যা হবার তাই হল । চিকেন আর উইপোকার একটা নতুন রেসিপি ।
সেদিন অফিস থেকে  ফিরে দেখি বাড়ির চারদিকে প্রচুর লোকের জটলা । এ তল্লাটে  যে এতো লোক আছে  তাই জানতাম না । তারা সব্বাই পর দিকে গাছগুলোর মাথার দিকে তাকিয়ে খুব উত্তেজিত ভাবে  খুব চিল্লামিল্লি করছে ।
“ওই যে ওখানে । না না ওই তো সেই দিকে” এপটে  ওপটে  পিছপটে । তার মধ্যে আমাদের মিত্তুন আর রেড্ডি লাঠি সোটা নিয়ে দৌড়া দৌড়ি করছে । সে এক মহা যুদ্ধের প্রস্তুতি । আমার গলা শোনা তো দূরের কথা । আমাকে কেউ দেখতেই পাচ্ছে না । কোনরকমে ওদের থামিয়ে জিগ্যেস করি , ব্যাপারটা কি ? কি  হয়েছে বলবি তো?
ঘেমে নেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ গোলগোল করে রেড্ডি বলল “শ  রি  য়া  প তি নি”।
সেটা কি  ? ভূতপেত্নী না কোন অপদেবতা? অনুমান করলাম শরিয়াপতিনি বলে কিছু একটা এ ডালে সে ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে । সবাই তারই পেছনে পেছনে ছুটছে । তবে  রেড্ডি যেভাবে  কথাটা বলল তাতে মনে একটু খটকা লাগছিল । একটু চিন্তাও হচ্ছিল ।  কাছেই চন্দকা ফরেস্ট । কি জানি কী এসে পড়ল আবার? তবুও   এ ভাবে কাঁহাতক আর দাঁড়িয়ে থাকা যায় ? ঘরে ঢুকতে যাব ,সমস্বরে চিৎকার “পশি গলা ,পশি গলা ,পশি গলা  ”।
আবার কি  হল ? জানা গেল সেই শরিয়াপতিনি লাফ দিয়ে রান্নাঘরের চিমনির মধ্যে ঢুকে পড়েছে । চিমনি দিয়ে যে রান্নাঘরে সেঁধিয়ে যাবে সে উপায় নেই কারণ সে রাস্তা আগেই বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে  ।  ধোঁয়া বের হবার চিমনি ,আজকাল তার ব্যাবহার নেই । তার মানে শরিয়াপতিনি এখন অন্ধকূপে নাকানি চোবানি খাচ্ছে । দেখলাম মিত্তুন  আর রেড্ডি  লাফ মেরে  কার্নিশ বেয়ে  একেবারে বাড়ির ছাদে । নিচে দাঁড়িয়ে থাকা  আগ্রহী জনতার একদল স্রেফ মজা দেখছে , আরেক দল ওই দু জনকে নানান উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে । জল ঢাল , না না আগুন দিয়ে ভয় দেখাও , নানা অন্য কিছু কর , দাঁড়াও, ভেবে বলছি  । রেড্ডি এরই মধ্যে বাঁশের মাথায় কাপড়ের পুঁটলি বেঁধে আগুন জ্বালাবার জন্য তৈরি । চারদিকে হুলুস্থূল ,চেঁচা মেচি আর চিমনির ভেতরে সেই শরিয়াপতিনির লম্ফঝম্প ।
 এদিকে বসার ঘরে টেলিফোন ঝন ঝন করে বেজেই যাচ্ছে । উফ এসময় আবার কে ফোন করে? ফোন টা তুলতেই হল ।
ওপাশ থেকে কেউ বলে চলেছে “ আপনার বাড়িতে একটা  শরিয়াপতিনি আটকে পড়েছে ? “
“হ্যাঁ পড়েছে ,তা আমি কি করতে পারি বলুন?” আমি ঝাঁঝিয়ে উঠি ।  
“ওড়িশা ওয়াইল্ড লাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট অনুসারে শরিয়াপতিনি এনডেঞ্জারড স্পেসিস ।  সুতরাং প্রাণী টির যদি কোন ক্ষতি হয় বুঝতেই পারছেন  আপনার কী  হতে পারে?”
“মানে? আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন ? আমার বাড়িতে ঢুকে গেলে আমি কী করতে পারি ?” 
কে ফোন করছে, কোত্থেকে  করছে , কিভাবে খবর পেল ?  কিছু না জিজ্ঞেস করে আমি  অসম্ভব রেগে যেতে থাকি । এমনিতেই মাথা গরম হয়েই  ছিল ।
“আমি অত কিছু জানতে চাই না । শুধু জানাচ্ছি আইন অনুযায়ী ব্যাবস্থা নিতে বাধ্য হব যদি শরিয়াপতিনির কিছু হয়...”
মিনিট কয়েক ধরে  আমাদের চাপান উতোর চলতেই  থাকে ।
 হঠাত্  লোকটির গলা ছাপিয়ে তখন আরেকটা চিল চিৎকার , এবার হিন্দিতে , “নিকাল গয়া, নিকাল গয়া , 
নিকাল গয়া ”।

শরিয়াপতিনি একটা ওয়াইল্ড ক্যাট ,জংলি বিল্লি বা লেপার্ড ক্যাট ( Prionailurus Bengalensis)  !


Tuesday, 5 August 2014

পদ্মনাভ




“সতীপতি গোস্বামী (Superintendent) আমাকে একদিন বললেন বাচ্চা হতে দেখেছ । অবাক হলাম হঠাৎ প্রশ্নে । সামান্য লজ্জায় বিব্রতও বটে । কবিতা লিখি তখন পুরোদস্তুর । বল্লাম  ঃ না । অন্যমনস্ক ভাবে প্রবীণ ডাক্তার বলে যাচ্ছিলেন “সে এক অদ্ভুত দৃশ্য । পদ্মনাভ শুনেছ? শ্রীকৃষ্ণের এক নাম । সৃষ্টির প্রথমে ছিল জল । জলের ওপর পদ্ম । সেই পদ্মলগ্ন নাভিতে ঈশ্বর শয়ান ।

শিশুর ভূমিষ্ঠ হওয়াও সেই পৌরানিক কাহিনীর মতই । একটি রক্তপদ্ম অর্থাৎ প্ল্যাসেন্টার মাঝখানে ,জলের মধ্যে ভাসছে জায়মান শিশু । সে এক অপার্থিব দৃশ্য “। সত্যি, একজন সার্জেন না হয়ে কবি হলে বেশ হত তার পক্ষে। এতদিন পরেও তার কথা আমার মনে আছে ।“

ওপরের লেখাটি  আমার বাবার লেখা (বাসুদেব দেব) স্মৃতিকথা থেকে নেওয়া,  ষাটের দশকের একেবারে প্রথমদিকের ঘটনা ।

এর পরে কেটে গেছে আরো কয়েকটা দশক । ২০০১ সালে ভুবনেশ্বর বদলি হই । বাড়ির কাছে বদলি হবার সুবাদে ঘনঘন কলকাতা আসা হতই । শুক্রবার এলেই মনটা পালাই পালাই করত । রেলের ব্যাবস্থাপনাও ছিল সময় মিলিয়ে । কাকভোরে কলকাতায় হাজির হও আবার ভাল মন্দ চাট্টি খেয়ে সোমবার সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে ফেরত যাও । এতদিন পরে মিথ্যে বলব না, কলকাতায় আসার জন্য যেমন মন আনচান করত আবার ভুবনেশ্বর ফিরে গেলে শান্ত সবুজ শহরটা তার সবটুকু ভালবাসা দিয়ে জড়িয়ে ধরত   গেট খুলে লাল নুড়ির রাস্তা দিয়ে বাড়ির দরজার দিকে যেতে যেতে দেখতাম বাগানে কেমন ফুল এসেছে ,ভেজা ভেজা ঘাস ,গাছের ছায়া ,আমার দরজা জানালা হাট করে খোলা বাড়ি , অরবিন্দ আশ্রমের ধূপের গন্ধ ,কাঁচের বাটিতে বাগান থেকে তোলা ক’টি সাদা ফুল আমারই অপেক্ষায় বসে আছে ।

সেবারে আউট হাউস থেকে গোপী লছমির জায়গায় থাকতে এল প্রফুল্ল নায়েক আর সুকান্তির জমজমাট সংসার । তাদের দুটো মেয়ে ।  প্রফুল্ল অটো চালায় । সুকান্তি আমাকে বাড়ির কাজে সাহায্য করে । মাঝে মাঝে প্রফুল্লর মা আর বোনও আসে ।  

সেবারে আমি আর আমার সর্ব ঘটে সহকারী ড্রাইভার কাম কেয়ারটেকার কাম সেক্রেটারি  মিত্তুন   দু জনেই কলকাতায় গেছিলাম । ফিরে দেখি বাড়িটা অদ্ভুত শান্ত । বাচ্চাগুলো স্কুলে গেছে । প্রফুল্ল ও নিশ্চয় বেরিয়ে গেছে । সুকান্তিকে কোথাও দেখা যাচ্ছে না । ও তো জানে আমরা ফিরে আসব সাত সকালেই । ভয়ানক নিঝুম চারদিক । কী হল রে বাবা এদের ? আমি সুকান্তির ঘরের দিকে যেতে থাকি । ওদের ঘরটা বাড়ির পি ছন দিকে ।   সেদিকে আম আর কাঁঠালের রাজত্ব । এতোটাই ঘন পাতার ঘেরাটোপ যে মাটিতে রোদ প্রায় পড়েই না ।  হিজলের নয়,সেই আম কাঁঠালের বনে তখন ঘুঘুর ডাকের  কনসার্ট  । সকালেই দুপুরের ঘুম এসে যাচ্ছে সেই একটানা ডাকে। দেখতে পেলাম সুকান্তির ঘরের দরজা আধ খোলা । তালা দেওয়া নেই । তাহলে সে গেল কোথায় ? আমি সুকান্তি সুকান্তি বলে ডাকতে ডাকতে ঘরের দিকে এগুচ্ছি,কিন্তু কেউ সাড়াও দিচ্ছে না । দু ধাপ সিঁড়ি উঠে আমি দরজা টা হাট করে খুলে যা দে খলাম তাতে আমি হতবাক আর নিশ্চল হয়ে রইলাম কয়েক মুহূর্ত ।

দেখলাম সুকান্তি মাটিতে পড়ে আছে । জলে ভেসে যাচ্ছে ঘরের মেঝে । জন্ম হচ্ছে একটি শিশুর । জন্ম হচ্ছে পদ্মনাভর । মায়ের শরীরের সঙ্গে জুড়ে আছে তার নাভি ।জলের মধ্যেই শুয়ে আছে সে । আমার শব্দ শুনে চোখে করুণ মিনতি নিয়ে সুকান্তি হাত দুটোকে  কোন রকমে মাথার ওপর তুলে  প্রণামের ভঙ্গি করে নির্বাক আকুতি জানাচ্ছে ,বলতে চাইছে বাঁচাও আমাদের। আমার জীবনের এ এক দুর্লভ অভিজ্ঞতা । ভয়ে,উত্তেজনায় তখন আমি আর আমার মধ্যে নেই । সম্বিত ফিরে পেয়ে মিত্তুন কে  ডাকতে থাকি।  এখখুনি গাড়ি নিয়ে হাসপাতালে চলে যা ,নার্স ,দাই যাকেই পাবি নিয়ে চলে আয়।

মিত্তুন হতভম্ব । আমি একা পারব না ,আপনিও চলুন ।

আমি তখন ভেতরে ভেতরে কাঁপছি ,বললাম এদের একা রেখে কীভাবে যাবো? যদি কুকুর বেড়াল ঢোকে? তুই চলে যা। সময় নষ্ট করিস না ।

মিত্তুন চলে গেলে আমি সেই অদ্ভুত নিরালা সকালে  ঝরে পড়া একরাশ আম পাতার মধ্যে দাঁড়িয়ে  সেই ঈশ্বর আর তার জন্মদাত্রীকে পাহারা দিতে থাকলাম ।  ঘুঘু পাখির ডাক ছাড়া কোথাও কোন শব্দ নেই 

একেকটা মুহূর্ত কে মনে হতে থাকল অনন্তকাল ।


 কয়েক বছর পরে আবার ভুবনেশ্বর । একদিন বিকেলবেলায় দেখি সুকান্তি আসছে ।ছোট জায়গা তো । খবর পেয়েছে বোধহয় ,  সঙ্গে আসছে আরো একজোড়া ছোট ছোট পা।  সুকান্তির আঁচলে তার মুখ ঢাকা । হাসিমুখে সুকান্তি দাঁড়ায় । আঁচলটা সরিয়ে নিয়ে তার পিঠে ঠ্যালা দিয়ে এগিয়ে দিয়ে বলে  “পুঅ “ ।




Monday, 28 July 2014

বেতুল আর বাতাল



নাগপুর থেকে প্রায় পঞ্চাশ ষাট কিলোমিটার দূরে তেঁতুল গাছের ছায়ায় ঢাকা বেতুল গ্রাম। কেমন ছন্দ মিলিয়ে দিলাম বলুন?  তেঁতুলকে মারাঠিরা বলে চিঞ্চ। এই গ্রামে অনেক মাহারদের বাস ।এরা বুদ্ধ ঠাকুরের পুজো করে । চিঞ্চগাছের ছায়ায় ,গাছের কোটরে বুদ্ধ ঠাকুর বসে আছেন । এই মাহারদের ভেতর থেকেই উঠে এসে ছিলেন ভীমরাও আম্বেদকার । এখন হয়ত বেতুল ভেতরে বাইরে আমূল বদলে গেছে কিন্তু সেই কুড়ি বাইশ বছর আগে সেটা নিতান্ত গ্রাম ই ছিল।
এ হেন বেতুল গ্রামে আমাদের পাঁচ ছ জনের দল জিপের ধুলো উড়িয়ে হাজির হলাম এক বিকেলবেলায় । কারণ আমাদের প্রশিক্ষণের একটা বিশেষ অঙ্গ হল ভিলেজ ভিজিট । গ্রামের জীবনের সঙ্গে মুখোমুখি পরিচয় । শখের পরিচয় । সে যাই হোক, কয়েকজন লোক নিয়ে সরপঞ্চ এসে আমাদের ওয়েলকাম জানালেন । আমাদের ঠাঁই হল গ্রামের পাঠশালায় । একটা ছোট পাকা বাড়ি । লাল টালির ছাদ । দলে আমরা দুটি মেয়ে । ঘরে ঢুকে আমি  সত্যি সত্যি হাঁ হয়ে গেলাম । দেওয়ালে ঝুলে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ আর সুভাষ চন্দ্র ।  তাজ্জব হবার মতই কথা। আর কী আশ্চর্য ,অন্য মেয়েটি জন্মসূত্রে বাঙালি হলেও একটাও বাংলা যার মুখে আমি এতদিন শুনতে পাইনি, সে রীতিমতো  দলের অন্যদের কাছে তার সংস্কৃতি নিয়ে বড়াই করতে থাকল । 
সাদামাঠা গ্রাম,পাঠশালায় পড়ুয়ার দল। গোদা হনুমানের   গাছ থেকে গাছে    লাফিয়ে লাফিয়ে চলা ,সরপঞ্চের মাথার বিশাল পাগড়ি,পাকান গোঁফ আর দলে দলে কুঙ্কু,সদাশিব আর বিঠঠল পাটিলদের দেখে দেখে আমাদের বেশ ভাল রকম ভিলেজ ভিজিট হচ্ছিল। কিন্তু আসল আকর্ষণ ছিল অন্য জায়গায়। সেটা হল সরপঞ্চের মেয়ে থুড়ি মেয়ের হাতের রান্না। মাটির চুলার গন্ধমাখা পোহা,আমঠি,ভাকরির রুটি,পুরন পুলি, কোকাম, বলা বাহুল্য, হুশ হাশ করে শেষ হয়ে যেত। শহুরেপনার ধার ধারত না কেউ । বছর তিনেক আগে সাতারা হয়ে গান্ধিজির সেবাগ্রাম দেখতে গেছিলামসেবাগ্রামের সামনে মাটিতে বসে মারাঠি স্টাইলে খাবার সুন্দর ব্যাবস্থা। আমাদের ড্রাইভার মারুতি কী খাচ্ছে জিজ্ঞেস করলে বলল “জুঙ্কা (ব্যাসন ভাজা)আর  ভাকরির রোটি” । সে আরো বলল , এ তো আজকাল বাড়িতে কেউ বানায় ই না এ সব গাঁ এর বাড়িতে এক সময় হত । তাই সুযোগ পেয়ে খেয়ে নিচ্ছি । 
  গল্পে ফিরে আসি । একদিন গ্রামের হাটে আমাদের অন্য  একটা দলের সঙ্গে হঠাত দেখা হয়ে গেল । সেই দলে আমার এক হরিহর আত্মা বন্ধু বুদ্ধি দিল একদিনের জন্য আমাদের গ্রুপে চলে আয় না । যেমন ভাবা তেমন কাজ । কেই বা দেখতে যাচ্ছে ! এমনিতে তো আমরা নিয়ম ভাঙার মাস্টার ছিলাম সেই সময় ।


ওদের দলে ছিল হিতেশ । বিশালায়তন ছেলেটি নাকি বিরাট বড়লোক অথচ ভারি মাটির কাছাকাছি । একটা সাদা কাপড়ের থান থেকে সারা বছরের ছ’টা জামা নাকি বানিয়ে নেয় । ভাষা জানার সুবাদেই হয়ত গ্রামের লোক দের সঙ্গে তার মিলজুল বেশি ছিল। হিতেশকে বলতে শুনলাম “আজ মুখিয়ার বাড়িতে যে পুজোপাঠ গান বাজনা হবে, সেখানে কে কে যাচ্ছ?”
দলের সবাই হাত পা ছুঁড়ে খুব আপত্তি জানাল। হিতেশ বলল “সে হয় না । ওরা খুব খারাপ ভাববে । এদিকে তিন বেলা যে বসে বসে ভালমন্দ খাচ্ছ সেটা আর ভেবেই দেখছ না “বলতে বলতে হিতেশের চোখ পড়ল আমার ওপর । তারপর আর কি ,  চক্ষুলজ্জার খাতিরে রাজি  হতেই হল ।
অন্ধকারে ডুবে থাকা গ্রামে শুধু মুখিয়ার বাড়িটায় বিজলি বাতির আলো টিম টিম করছে । দেওয়ালে ইয়া বড় বড় ঘুঁটে লাগানো আছে। ভেতরে ঢুকে মাটিতে বসলাম গান শুরু হল হারমোনিয়াম নিয়ে বসে আছে একটি ছোট্টখাট্ট মেয়ে ,মুখিয়ার মেয়ে । তার নাম কুঙ্কুও হতে পারে । মেয়েটির গলা থেকে জলদগম্ভীর আওয়াজ বেরুতে লাগল । সে থেকে থেকে চোখ দুটো ওপরের দিকে তুলে  “গোবিন্দাআআ  কৃষ্ণা আআ” বলে সুর লাগাতে থাকল । আমার কেমন যেন গাঙ্গুবাঈ হাঙ্গলের কথা মনে পড়ছিল । ওইটুকু শরীরে এমন আওয়াজ! এরপর যেটা হল তার জন্য আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না ।
মেয়েটির গান  শেষ হলে হিতেশ ফস করে বলে বসল
“ এবারে একটা বঙ্গালি ভজন শুনব ।“
ছোকরা বলে কি? অথচ সবাই আমার দিকে হাসি হাসি মুখ করে তাকিয়ে আছে । আমার মাথার ভেতরটা একদম ফাঁকা ।  কিছুই মনে আসছে না । শেষমেশ যে বঙ্গালি ভজন গাওয়া হল সেটা হল “আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে”। বিঠঠল পাটিলদের দল পাগড়ি নেড়ে বল্ল বেশ বেশ ।
তারপর উঠে এলাম। হিতেশ প্রোগ্রাম শেষ না হলে আসবে না । কারণ সেটা ভারি খারাপ দেখাবে। বাইরে বেরিয়ে দেখি নিশুতি রাত, গোরুর গাড়ি গুলো এদিক ওদিক ছড়িয়ে,পথে কুকুর বেড়ালটা পর্যন্ত নেই,শুধু চিঞ্চগাছের ঝুপ্সি ছায়া বলা বাহুল্য পথ হারিয়ে ছিলাম ।  আবার লজ্জার মাথা খেয়ে মুখিয়ার বাড়ি । কেউ একজন পাঠশালায় পৌঁছে দিয়েছিল ,মনে আছে। এখন মনে হয়,  তখন আমরা অনেক নিরাপদ ছিলাম । পদে পদে ভয় এমন গলা টিপে ধরত না ।
পরের দিন গ্রামের বাসে করে পাল পাল ছাগল,মুরগির সঙ্গে রওনা দিলাম । বেতুল এলে যেন মনে করে আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয় এই বলে বলে কন্ডাক্টরকে প্রায় পাগল করে আনছিলাম। কেউ কারুর ভাষা বুঝি না,তখন মোবাইলের চল ছিল না। বেতুলে না নামতে পারলে কী হবে? সারা জীবন ভাকরির রোটি আর চিঞ্চের আচার খেয়ে থাকতে হবে? তবে সে যাত্রা বেঁচে গেছিলাম ।
                                                                       
গরুর গাড়িতে বেতুল গ্রামে
 


কিন্নর সুন্দরীর নীল চোখের এক বিন্দু জলের মত হিমাচলের পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে আছে চন্দ্রতাল লেক । ইন্দো তিব্বত সীমানা বরাবর শীতল মরু অঞ্চলে আমাদের এক্সকারশন চলছিল । সব জায়গাতেই আমরা আশ্রয় ও আতিথ্য পেয়েছিলাম সেনা বাহিনীর কাছে ।  ট্রেকিং করে চন্দ্রতাল লেক যেতে হবেএদিকে আমার অবস্থা ছিল বেজায় খারাপ । অথরিটি কে জানান হল । আমাকে মকুব করা হল ট্রেকিং থেকে । না করে উপায় ছিল না কারণ ঘং ঘঙে কাশি আর শ্বাস কষ্ট নিয়ে আমি নিজেই একটা জলজ্যান্ত প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে ছিলাম।
সেই শীতল রুক্ষ মরু  অঞ্চলে যেখান থেকে  পুরো দলের সঙ্গীসাথী আমাকে টা টা বাই বাই করে রওনা দিল চন্দ্রতালের দিকে,সেই জায়গাটার  নাম বাতাল ।
বাতাল

  না পাতালের কাছাকাছি নয় ,প্রায় চোদ্দ হাজার ফুট উঁচুতে তার অবস্থান। সেখানে  চোখের মনের আরামের মত কিছু নেই, কিচ্ছুটি না । রুখু এবড়ো খেবড়ো মাটির রাস্তা,জায়গায় জায়গায় নোংরা কাদা মাখা বরফের তাল পড়ে আছে কর্কশ পাহাড় চারদিকে চোখ রাঙাচ্ছে । আর কথায় কথায় সূর্য পাহাড়ের কোলে ঢলে পড়ছে, চারদিক  আবছা অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছে আর হাড় কাঁপানো কনকনে হাওয়া । সবুজের নাম গন্ধ নেই। লোকজনেরও ।  পাথরের খাঁজে একটা ছোট্ট দোকান ।

 পাওয়া যায় চা আর ম্যাগি । সঙ্গী বলতে আমার দুর্বল শরীর অবসন্ন মন, ড্রাইভার আর তার হেল্পার,একজন ফ্যাকাল্টির স্ত্রী যে তার পুঁচকে মেয়েটাকে নিয়ে অকারণ ব্যতিব্যস্ত।  তার সঙ্গে কিছুক্ষণ পুরনো হিন্দি গান কতো ভাল আর আরবি (কচু,হিন্দিতে)র তরকারি কতো উপকারী,তোমাদের স্যারের কী বদ মেজাজ এই সব ঘন্টা খানেক আলোচনা করে, কেশে কেশে আর হাঁপিয়ে আমি আরো ক্লান্ত হয়ে পড়লাম । দলবল  কখন ফিরবে কে জানে, আপ ডাউন ষোল কিলোমিটার হেঁটে ফেরা(পরে জানা গেছিল আরো বেশি) ,এই ভৌগোলিক টোপোগ্রাফিতে, চাট্টিখানি কথা নয় । ফিরতে ফিরতে হয়ত বিকেল গড়িয়ে যাবে । কী করব এতোটা সময় ? ঠান্ডায় জবুথবু হয়ে যাচ্ছি । এমন সময় ড্রাইভারটি বলল “কুছ কাম করতে হ্যায়”।তাহলে খানিক টা ভাল লাগলেও লাগতে পারে । সে বলল “ম্যাডামজি, নিম্বুপানি বনাতে হ্যাঁয় ,চলিয়ে” এইবলে সে তার নিজের রসদ থেকে  বেশ কিছু পাতিলেবু  ,নুন ,চিনি আর দোকান থেকে হাড় হিম করা জল যোগাড় করে ফেলল । ব্যাপারটা খুব একটা খারাপ লাগল না কিন্তু এর সঙ্গে একটা মহৎ উদ্দেশ্যও জুড়ে দিলো “ মেড ইন বাতাল “লেমনেড টা বানানো হচ্ছে ট্রেকিং ফেরতাদের জন্য । শুধু বোতলে পোরা হবেনা। প্ল্যাস্টিকের গ্লাসে ঢেলে দেওয়া হবে। আমরা নিম্বু কাটছি,রস চিপছি,নুন চিনি জল মিশিয়ে  ঘুঁটছি আমাদের সঙ্গী সাথীদের জন্য একটা প্রতিকূল পরিবেশে   আমরা তিন জন এখন একে অন্যের খুব বন্ধু হাসি মজাক করতে করতে  বাতালের  শীতল শিলাভূমিতে  লেবুর শরবত তৈরি হয়ে গেল । উয়োলোগ কিত না খুশ হো জায়েঙ্গে –ড্রাইভারের মুখে চোখে পরম তৃপ্তি।
সন্ধে হবার মুখে একে একে সব ফিরতে শুরু করল, ধুঁকতে ধুঁকতে,পা ঘষটে ঘষটে  । রাস্তা নাকি ভয়ানক বাজে । খানা খন্দ আর বোল্ডারে ভর্তি। দূরত্বও নাকি অনেক বেশি। মোটেও আপ ডাউন ষোল নয় বরং তার দ্বিগুণ । বাস্তবিকই তাই।  এর মধ্যেই হাতে হাতে সাপ্লাই হয়ে যাচ্ছে বাতালের সেই ক্লান্তিহরা সঞ্জীবনী  । বন্ধুরা বিস্মিত ,খুব খুশি । ড্রাইভারের মুখে হাসি ধরে না । 
আমারদিকে এগিয়ে এল পরমার সিং । কি ব্যাপার তুমি তো গেলে না । তো দিনভর কেয়া কিয়া? ভাব খানা এমন যেন আমি ফাঁকি মেরে যাইনি ।
আমি বললাম কেন? আমরা নিম্বু পানি বানালাম । তোমাদের জন্যই তো বানালাম । কেমন ভাল লাগছে না?
গ্লাসের শেষ বিন্দুটা শুষে নিয়ে ভুরুটুরু কুঁচকে পরমার সিং বলে ওঠে,”তো কেয়া হুয়া”?  

Sunday, 27 July 2014

৩২ নম্বর গ্লেন


শিমলার সামারহিলে পাইন আর দেওদার গাছের ঘন জঙ্গলের মধ্যে লুকিয়ে আছে গ্লেন ভ্যালি । তিরতির করে বয়ে যাচ্ছে পাহাড়ি ঝরনা । বেশ খাড়াই পথ বেয়ে গ্লেন ভ্যালি যেতে হয় ।

এই উপত্যকার নামেই একটা বাড়ির নাম । তার ৩২ নম্বর ঘরে জীবনের  মূল্যবান দুটি বছর কাটিয়েছিলাম ।

 ট্রেনিং এ র সময় যে বাড়িটায় সবাই থাকত তার নাম  ইয়ারোজ(Yarrows)।  সারা গায়ে আভিজাত্যের আতর মেখে সে ছিল বাড়াবাড়ি রকমের দেমাকি আর শৌখিন । তাকে দেখভাল  করতেই একপাল অপোগণ্ড লোকের সারাদিন কেটে যেত । সেটাই তাদের রুজিরুটি । সে তুলনায় গ্লেন ছিল একেবারে বেখাপ্পা, দড়াম করে বেমক্কা উঠে দাঁড়িয়েছে। এটা নাকি অ্যাকাডেমির গেস্ট হাউস ।  নতুন হয়েছে। বনেদি ইয়ারোজের পাশে এমন একটা খাপছাড়া  প্রোলেতারিয়েত বাড়ির প্ল্যান যারা করেছে তাদের যে এতটুকু অ্যাস্থেটিক সেন্স নেই তা নিয়ে সিনিয়ররা খুব আলোচনা করতেন মনে আছে ।

গ্লেন

আমাদের দল টা আয়তনে বেশ বড় । এতো লোকের জায়গা তো ইয়ারোজে হবে না । অতএব ছজনকে চলে যেতে হবে গ্লেনে । সেই থেকে ৩২ নম্বর হল আমাদের ডেরা । একটা ঘরে দুজন ।

৩২ নম্বর গ্লেনে   ইয়ারোজের ঠাটবাটের বালাই  ছিল না ,মোম দিয়ে মেঝেও পালিশ হত না, ফায়ার প্লেসও ছিল না ।বাথরুমের দেওয়ালে  আদুরে প্রিম রোজও লতিয়ে উঠত না। তাতে আমাদের কিছু যায় আসত না । যা ছিল তাতেই আমাদের দিব্যি চলে যেত।  বেশ ছিমছাম আরামদায়ক মনে হত সবকিছু ।

 এই ঘরে  এমাথা থেকে ও মাথা কাঁচের জানালা ।    জানলার ওপারে ছিল এক স্বপ্নরাজ্য । পাইনের জমাট বন । দূরে হিমাচল ইউনিভারসিটি দেখা যেত । টয়ট্রেন হুইসল বাজিয়ে পাকদন্ডী ঘুরে ঘুরে নামত ।

এই কাঁচের জানালার ওপারে প্রকৃতির কতো রকম আমোদপ্রমোদের কতো বিচিত্র খেলা আমরা দেখেছি তা কয়েকটা শব্দ দিয়ে বলা যাবে না । চোখের সামনে একটা তীব্র নীল ক্যানভাসে একের পর এক তুলির টান দিয়ে চলছেন তিনি তাঁর নিজের খেয়ালে । কখনো রঙের খেলা  আর মায়াবী আলো  বেগুনি,লাল,কমলা,গোলাপি, কখনো মেঘ পাহাড়ের গল্প, কখনো বন আর বৃষ্টির মাতামাতি , কখনো ক্যানভাসে ওয়াশের কাজ, বা তুলির জোরালো টান । বাতাস বেয়ে বৃষ্টির সুবাস,দূরে কুহেলী পাহাড়ের সা রি । বৃষ্টি ধোওয়া আকাশজোড়া রামধনু ,উপত্যকার গভীর থেকে কুন্ডলী পাকিয়ে ওঠা মেঘ , ঝিরঝিরে সাদা তুলোর মত বরফ পড়া  ,আর রাতে পরিষ্কার   আকাশে মস্ত বড় চাঁদ যেন হাত বাড়ালেই ধরা যাবে ,ঝকঝকে তারা, যেন কার গয়নার বাক্স উলটে সব হিরে জহরত ছড়িয়ে পড়েছে । মনে আছে অনেক সময় আলো নিভিয়ে দিয়ে সেই সব দৃশ্য আমরা কাঁচের ওপার দিয়ে সিনেমার মত দেখতাম ।

৩২ নম্বরের বাসিন্দাদের ঠিক দলছুট বলা না গেলেও তাদের পছন্দ অপছন্দর ব্যাপারটা একটু জোরালো ছিল বৈকি ।  তারা একটা প্যারালাল কিচেন চালাত ওই ঘরের মধ্যেই ।সবাই যখন ইয়ারোজের ডাইনিং হলে  রবিবার দিন পন্ডিতজির হাতের রাজমা চাওল  আলুগোবি আর আচার খেত , ৩২ নম্বরে  হিটারে বানানো হত  ভাত,মুসুরির ডাল সেদ্ধ, ডিম আলু সেদ্ধ , সঙ্গে থাকতো ঝরনা ঘি,কাঁচা লঙ্কা। তার জন্য মাঝে মধ্যে  কিছু রসিকতা ,কটু কাটব্য শুনতে হত ইয়ারোজের এলিটদের কাছ থেকে । ৩২ নম্বর সে সব গায়ে মাখত না ।  

৩২ নম্বর উপচে পড়ত বই , ছবি আর গানে । বাগানের মরসুমি ফুলের হামেশাই আনাগোনা ছিল এই ঘরে । দেওয়াল জোড়া পোস্টারে সালভাদোর দালি থেকে যামিনী রায় সবাই হাজির ছিলেন। ৩২ নম্বরে রবীন্দ্রনাথের গান তো ছিলই    

এছাড়াও  রাতে  ডিনারের পরে ঝিরঝিরে  ঠান্ডা হাওয়ায় যখন গাছের  পাতাগুলো কাঁপত  ,  তারাগুলো মিট মিট করত, পায়ের  কাছে কম্বল টা  গুটিসুটি  পড়ে থাকত ,  ৩২ নম্বর থেকে আবিদা পরভিন গেয়ে উঠতেন    অ্যায় দিলনশী তালাশ তেরে কুবকু নহি  অথবা হর তরন্নুম মে মিলি হ্যায় তেরি আওয়াজ মুঝে , কখনো বা  ইয়ে ধুপ ছায়ো কা আলম রহা জুদাই না থি । আরো শোনা যেত  ফরিদা খানুম,মালিকা পুখরাজ আর তাহিরা সইয়দ ,রেশমার গলা, মেহদি হাসানের রঞ্জিসি সহি ,গুলাম আলি  আর জগজিত সিং । উও কাগজ কি কাস্তি উও বারিশ কে পানি ।

৩২ নম্বরের দিল বড় দরাজ ছিল । সেখানে বাংলা লোকগীতির পাশেই বাজত মারাঠি নাট্যগীতি আর আভংগ ।  ঢোলক বাজিয়ে পিঞ্জরেওয়ালি মুনিয়ার থেকে সুর অনায়াসে চলে যেত ক্লেডারম্যানের পিয়ানোয় , মোৎজারট, বিঠোফেন বাখের সিম্ফনিতে । বিটলস , বেলাফন্টে,জন ডেনভার ,কারপেন্টার   সলিল চৌধুরী, ,শচিন কত্তা এখনকার কবীর সুমনের পাশাপাশি দাপটের সঙ্গে থাকতেন যশ রাজ ,ভীম সেন জোশি ,বীণা সহস্রবুদ্ধে ,আশ্বিনি ভিদে দেশপান্ডে  ,শ্রুতি সাডোলিকর।  গিরিজা দেবী, শোভা গুরতুর কাজরি ,চৈতি আর হোরি –আজ বিরজ মে হোলি রে রসিয়া –যেন এখনো শুনতে পাই । ৩২ নম্বর একটা গানের আখড়া ছিল সে সময় । আর তার চরিত্র ছিল একেবারে   যাকে বলে গ্লোবাল ।

৩২ নম্বরের হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়াতো  জীবনানন্দ ,শঙ্খ ঘোষ ,শক্তি ,আয়ান রশিদ খান  এবং আরো অনেকের কবিতা । সে সময় আমরা খুব মজেছিলাম শের শায়েরিতে । গালিব ,বাহাদুর শাহ জাফর , মির তকি মির থেকে কৈফি আজমি র নজম গজলের সঙ্গে একাত্ম হয়ে যেত  বাড়ি থেকে বহু দূরে দুটো মানুষের মনের দুঃখ কষ্ট ,তাদের  নিজস্ব একাকিত্ব ,আরো অনেক না বলা কথা ।

এই ঘরের এক বাসিন্দা আজন্মকাল কবিদের দেখে দেখে বড় হয়েছে , কবির ঘরে তার জন্ম  । বাড়িতে বই আর লিটল ম্যাগাজিনের সমুদ্রস্রোতে তার মা চাল ডাল মুড়ি চানাচুর  বিস্কুট রাখার জায়গাও পেত না । সে একদিন জানতে পারে  তার  সঙ্গিনী টি কবিতা লেখে! তার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল   - কী আপদ! এখানেও রেহাই নেই ! এরা দেখছি শান্তিতে থাকতে দেবেনা । কবিতা শোনাতে আসবে না তো আবার ?

শুধু তাই নয়, এ আবার তার বাবার প্রাণের বন্ধুর ভাইঝি ! তবে নিজে থেকেই  একদিন সে বললো ,শোনা দেখি তোর কবিতা । পাহাড়ের তলায় একটা সমুদ্র বয়ে যায় ,  কোথা থেকে  সেখানে আসে একটা  জাহাজ ,নির্জনে । এ রকমি একটা কবিতা ছিল সেটা ।  তার বেশ  ভাল লাগে ।  কেমন অন্য রকম । আরো শোনা তোর কবিতা ।  সে শুনতে থাকে । আর ভাবতে থাকে এর হবে । এতোটা কাল কবি বাবার কাছে লালিত পালিত হয়ে যদি এটকু না বুঝতে পারে তাহলে আর হলোটা কী ? সেই থেকে ৩২ নম্বর একালের এক নামজাদা কবির আঁতুড়ঘর না হলেও কর্মশালা ছিল বলা যেতেই পারে ।

পাহাড়ি পথে ওঠা নামা হাঁটা চলা ,  ক্লান্তি ,পরিশ্রম , অনেক নতুন কিছুর সঙ্গে আপোষ করা , মানিয়ে নেওয়া , অনেক ছোটখাট তুচ্ছতা, ভুল বোঝাবুঝি, মান অভিমান   সব কিছু মুছে দিত , লুকিয়ে রাখত ৩২ নম্বর গ্লেন । দিনের শেষে আমরা জানতাম, টেবিল ল্যাম্পের নরম আলো মেখে সে আমাদের জন্য অপেক্ষা করে আছে । তার কাঁচের জানালার ওপারে বসে আছে অজস্র মথ আর প্রজাপতি । বাথরুমে মজুত করা আছে জুগনুর ( হিটারের মত,মাঝে মাঝে গিজার খারাপ হয়ে যেত) মধ্যে গরম জল ।   ঘরের  উষ্ণতার মধ্যে ওম হয়ে বসে আছে একটা অদ্ভুত শান্তি । ঠিক  যেন  মায়ের  মতো।   সেন্টেড মোমবাতির হালকা সুগন্ধ , ছাদ গড়িয়ে কুয়াশা নামছে আর দুটো কাপে  হিটারে বানানো সুইট কর্ণ সুপ থেকে ধোঁয়া উঠছে ।

আর সে সব এফ আর এস আর , ব্যালেন্স শিট, ফান্ড ফ্লো, ক্যাশ ফ্লো, প্রফিট অ্যান্ড লস আকাউন্ট, পেনশন রুল , ড্রাফট প্যারা , অডিট  ডেবিট ক্রেডিট তাদের কি হল? তারা কেউ জানালা দিয়ে উড়ে গেছে,কেউ কার্পেট চাপা পড়েছে, আর বাকিদের হয়ত টেকচাঁদ পুরন চাঁদ করমচাঁদের দল ঝাড়ু মেরে বিদায় করেছে ।

 কোন কিছু আগের মত থাকেনা ।  ৩২ নম্বর গ্লেন ও নেই । তার  যে সব এলোঝেলো সাদাসিধে ভালমানুষ গোছের ব্যাবস্থাপনায় আমরা বেশ খুশিই ছিলাম, তার একটাও আজ আর নেই ।  সে আজ  ভীষণ কেতা দুরস্ত ।  কর্পোরেট । প্রফেশনাল । ফিটফাট । সে  যে কোন  পাঁচতারা হোটেলের ঘরের সঙ্গে পাল্লায় নামতে পারে । তার দেওয়ালের  এমাথা ওমাথা জুড়ে যে বিরাট জানালাটা  ছিল সেটা অনেক  ছোট করা হয়েছে । কিন্তু এখনও তার ভেতর দিয়ে আকাশটা সে রকমই নীল । পাইন বন জুড়ে সেই রকমই স্তব্ধ শান্তি ।
নতুন জানালা - গ্লেন

আর ৩২ নম্বরের সে দুজন বাসিন্দা । তারাও কি আগের মতন আছে? সব কিছুই কি গেছে ? ওই নীল আকাশটার  মতো , নিরালা পাইন বনটার মতো কিছুই কি নেই বাকি?
সেই  দুজনার  ছবি 
যশোধরা - সুপর্ণা

এবং  এই  গানের  লিংক টা  Yesterday Once More - Carpenters


Thursday, 3 July 2014

চিত্রা ঘোষ

চিত্রা ঘোষের নিজস্ব কিছু স্টাইল স্টেটমেন্ট ছিল । তবে স্টাইলিশ মহিলা বলতে যে ছবিটা আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে  চিত্রা   কিন্তু তার থেকে শত যোজন দূরে ছিলেন। বিশেষ ব্যক্তিত্বের অধিকারীদের যেমন সিগনেচার মার্ক থাকে যেমন  গান্ধিজির গোল চশমা , রবীন্দ্রনাথের আলখাল্লা ,ফিদা হোসেনের খালি পা , ঊষা উথথুপের কপালে ক তেমনি চিত্রা ঘোষও সারাজীবন ধরে তার  কতগুলো স্টাইল ধরে রেখেছিলেন। সিমি গারেওয়াল কে তিনি জানতেন কিনা জানা নেই তবে  সারাজীবন তার শাড়ির রঙ ছিল সাদা , সঙ্গে সরু পাড়  ওটা মাস্ট । তা নাহলে সে শাড়ি তিনি পরবেনই না।  শাড়ি থাকত ভাঁজহীন টানটান ,পাট পাট গুছিয়ে পরা। প্রসাধন বা বিলাসিতার বালাই ছিল না। মাথায় ঠাসা কাঁচা পাকা চুল দিয়ে তিনি একটা গোল খোঁপা করতেন । গয়না গাটি প্রায় পরতেন না বললেই চলে। মোটা ফ্রেমের চশমা । পায়ে পাতলা চটি,হাতে গোব্দা কালো ব্যাগ ,এই ছিলো তার চিরকালের সাজ । বিয়ে বাড়ি থেকে শ্রাদ্ধ বাড়ি,অফিস থেকে বন্ধুর বাড়ি,বাজার থেকে বেড়াতে যাওয়া সর্বত্র তিনি একই রকম থাকতে পছন্দ করতেন । ঘুমোতে যাবার আগে পর্যন্ত তিনি হাতে ঘড়ি পরে থাকতেন । দফায় দফায় নানা কাজ করতেন ঘড়ি ধরে।

তার মধ্যে একটা প্রধান কাজ ছিল বিভিন্ন মানুষ কে নিয়ে তার নিরন্তর চিন্তা । চিন্তা না বলে দুঃশ্চিন্তা প্রবাহ বললে ঠিক বলা হয়। এর মধ্যে পরমাত্মীয় ,আত্মীয়,অনাত্মীয় সবাই থাকতো । তিনি চিন্তা করতে ভালবাসতেন। কেন এত অকারণ চিন্তা কর? এর উত্তরে সবসময় ই বলা হত -কি আর করতে পারি আমি? সকলের ভালমন্দ চিন্তায় উচাটন হয়ে থাকতো তার মন। আন্তরিক ভাবে । ভীষণ আন্তরিক ভাবে ।
অবসর সময়ে তার আর একটা প্রধান কাজ ছিল বই পড়া। নানা পত্র পত্রিকা আর বই তার সব সময়ের সঙ্গী ছিল। বই ছাড়া তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ে না।
তার কালো জাব্দা ব্যাগ টার মধ্যে থাকতো অনেক রকম মুখশুদ্ধি আমলকী , যোয়ান , হজমি গুলি। এটা  একটা বড় আকর্ষণ ছিল কচিকাঁচাদের মধ্যে।

চিত্রা ঘোষ কখনই খালি হাতে কারুর বাড়ি যেতেন না । ন মাস ছ মাসের সৌজন্য সাক্ষাৎ নয় । ঘনঘন কোথাও গেলেও খালি হাতে কদাপি নয় । সামান্য হলেও তার হাতে  কিছু না কিছু থাকবেই । তার পছন্দের মিস্টির দোকান গাঙ্গুরাম,ভীম নাগ বা দ্বারিক । জামাকাপড় উপহার দিতে হলে খাদির দোকান ।এর অন্যথা বড় একটা দেখিনি ।  এটাই ছিল তার দস্তুর । ফ্রিডম ফাইটার পেনশন নেবার জন্য আমাদের অফিসে আসতেন,সঙ্গে একটি নয় দুটি মিস্টির প্যাকেট নিয়ে, একটা আমার আরেকটা আমার সহকর্মী বান্ধবীর । আগে বলেছি না চিত্রার আপন পর ভেদ টা বড় কম ছিল ।

বরিশালের মেয়েদের এমনিতেই মধুরভাষিণী বলে কোনদিন  সুখ্যাতি ছিল না। চিত্রা  ঘোষ তার ব্যাতিক্রম ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে কি  ছোটবেলায় আমি এই মহিলাকে একটু এড়িয়ে চলতাম । ওনার চাঁচাছোলা কথাগুলো আমার বিশেষ পছন্দ ছিল না। বেশ অনেক দিন পর্যন্ত বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান হবার জন্য যে আদর ও পুতুপুতু ব্যাপারটা আমাকে নিয়ে চলত তাতে তিনি অনেক সময় মতামত দিয়ে থাকতেন। আমাদের তিনি ভাল বাসতেন তো বটেই কিন্তু কোন আদিখ্যেতা বা দেখনধারি ভাব তার ধাতে সইত না।  তবে বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা ঘোষ কে দেখার ও বোঝার ধরন টাও ক্রমশ বদলাতে থাকে

তার রাজনীতিবোধ ছিল প্রখর । খুব তীব্র ও তীক্ষ্ণ ভাবে তিনি তার রাজনৈতিক মতামত দিতেন । তার ওই  সাদা ভাঁজ হীন শাড়িটার মতই  ভানহীন ছিল তার চরিত্র । রাজনীতিসচেতন ছিলেন কিন্তু ডিপ্লোম্যাসির ধার পাশ দিয়ে কোনদিন হাঁটেন নি ।
সাংসারিক দায়দায়িত্ব পুরোদস্তুর পালন করেও চিত্রা কিন্তু সেভাবে সংসারী ছিলেন না। একটা বড় ব্যাপ্তির মধ্যে যেন নিজেকে খুঁজে পেতে চাইতেন । বাড়াবাড়ি রকমের ভ্রমণ বিলাসী ছিলেন । ভারতবর্ষের হেন জায়গা নেই যেখানে তার পদধূলি পড়েনি । বার্ধক্য এবং নড়বড়ে শরীরও তার মনকে দমাতে পারে নি। শরীরের ওপর ভাঙচুর হয়েছে প্রচুর । সত্যি বলতে কি তার এই অদম্য প্রাণশক্তি আমাদের তাজ্জব করে দিত । মাঝে মাঝে ওঁর সামনে নিজেদের খুব ছোট বলে মনে হত।
ছোঁয়াছুঁয়ি বাছবিচার নিয়ে মাথা খারাপ করার মত মানুষ তিনি ছিলেন না। পরিস্থিতি যেমন হত তিনি তেমন মানিয়ে নিতেন।

তার দুই পুত্র সন্তান মুক্তিস্বপ্ন আর বিপ্লবঅগ্নি  কিশোর আর যুবক বয়সেই অকালে বিদায় নিয়েছিল।
শোক যে কতো সম্ভ্রান্ত,নিভৃত আর ব্যক্তিগত হতে পারে চিত্রার সুদীর্ঘ জীবন তার প্রমাণ । কোনদিন তাদের প্রসঙ্গ ওঠেনি ,সবার সামনে কোনদিন চিত্রা চোখের জল ফেলেন নি,সহানুভূতি নিতে চান নি কারুর  শুধু আমরা জানতাম ও বাড়িতে ভাইফোঁটা  হয় না, চিত্রা কে কোথাও খেতে  ডাকলে জেনে নিতে হয় তিনি কীকী খান না কেন না ছেলেদের সব পছন্দের খাবার তিনি বর্জন করেছিলেন ।আর ও জানতাম চিত্রার বুকের মধ্যে একটা প্যাকেট  থাকে ,তার মধ্যে দুই ছেলের ছবি-শুধু শোবার সময় প্যাকেটটা  বের করে রাখেন।

অন্যায়ের সঙ্গে আপোষ না করা আর অপ্রিয় সত্যভাষণ চিত্রার এই দুই সিগ্নেচার মার্ক নিয়ে প্রচুর ঘটনা আছে ।
আমার  পরিষ্কার     মনে আছে ভি আই পি রোড দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে । চিত্রার সঙ্গে আছে তার ছোট মেয়ে ।উল্টোডাঙ্গার কাছে এসে চিত্রা দেখলেন একটা লরির ড্রাইভার পুলিশকে টাকা দিচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে চিত্রা বলে ওঠেন,আমি কিসু কমু । মেয়ে ধমক দেয়, না কিছু বলবে না তুমি ।  যথারীতি ট্রাফিকজ্যামে গাড়ির গতি কমলো, চিত্রা মোক্ষম সুযোগ পেয়ে তার ঈষৎ ধারালো সরু গলায় জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে পুলিশ টাকে বলে ওঠেন  ঘুষ নিচ্ছেন ? লজ্জা করে না আপনার? বেয়াদ অ অ প...।

একবার তার এক খুব ঘনিষ্ঠ জন তার মামার বাড়ি যাবে । চিত্রা তার মেয়েকে জানান,  অমুকে মামার বাড়ি যাইতে চায়।
 তা বেশ তো যাবে ।
কিন্তু তার মামা আছে কোন দিন শুনি নাই তো ,সত্য কথা কইতাসে না”’
তোমার অত জানার দরকার নেই । তুমি বলবে ,মামার বাড়ি যাবে? তা বেশ তো ,ঘুরে এস। তারপর টাকা দিয়ে বলবে মিস্টি কিনে নিয়ে যেতে ।তারপর আরও বলবে যে মামাদের  যেন আমাদের বাড়ি আসতে  নেমন্তন্ন করে ,কি মনে থাকবে তো?”
মেয়েকে খুব একটা চটাতে চান না চিত্রা ।তারা তার মত কট্টরপন্থী নয়। তাকে বুঝতেও পারেনা ।
যথারীতি চিত্রা টাকা দিলেন, মেয়ে যা বলতে বলেছিল সব ই বললেন। এইবার যেই পর্দা সরিয়ে ঘনিষ্ঠটি ঘর থেকে বেরুতে যাবে চিত্রা আর থাকতে না পেরে তার সেই ট্রেডমার্ক গলায় বলে ফেলেন, তা  তোমার মামা আছে কোন দিন শুনি নাই তো !

চিত্রার নন কনভেনশনাল চরিত্রের আর  একটা  মন্ত্র ছিল আপন হতে বাহির হয়ে বাইরে দাঁড়া ,বুকের মাঝে বিশ্বলোকের পাবি সাড়া। সে কারণেই তার একমাত্র ভাইপোর স্কুলে নেতাগিরিতে ভাই এর বউ যখন ভয়ানক শঙ্কিত ,চিত্রা রায় দেন বাইরের পৃথিবী ডাকলে  বাঁধিয়া রাখতে পারবা?”
একই তাগিদে ছুটে গিয়েছিলেন মেধা পাটকরের নর্মদা বাঁচাও আন্দোলনে ,শুধুমাত্র  তাকে সমর্থন জানাবার জন্য। খোলা আকশের নিচে বোল্ডারের ওপর ত্রিপল বিছিয়ে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন তিনি ।তখন তার বয়স সত্তর পেরিয়ে গেছে।

চিত্রা ঘোষের চেহারার মধ্যে নজরকাড়া কোন ব্যাপার ছিল না । আর পাঁচজন গড়পড়তা বাঙালি মেয়ের মতই ছোটখাটো,মাজা রঙ , সামান্য ভারি শরীর । ভিড়ের মধ্যে হারিয়ে যাবার চেহারা।  কিন্তু  চিবুকে,ঠোঁটের রেখায় আর নাকের গড়নের মধ্যে ধরা ছিল তার ব্যক্তিত্ব। একটা  চাপা তেজ ।  প্রায় এক খানা শতাব্দী জুড়ে তাঁর জীবন । আর  সেই জীবনের পরতে পরতে কতো কিছু যে তিনি শিখিয়ে গেছেন ,কখন যে সেই আটপৌরে গেরস্থ জীবনটাকে অনায়াসে টপকে গেছেন তিনি হয়ত তা নিজেও জানতেন না ।
বরিশালের হেড মাস্টারের মেয়ে ছিলেন তিনি । খাঁটি স্বদেশী পরিবার । মেয়েরা ছোরা খেলত,পিকেটিং করত। চরকা কাটা  হত । সারাদিনের কাজের শেষে তার মা ,বাড়ির মেজবউ, বাড়ির বাচ্চাদের লেখাপড়া শেখাতেন।অশ্বিনী কুমার দত্ত,মুকুন্দ দাসের মত স্বদেশপ্রেমীরা বাড়িতে আসতেন ।  বিয়েও হয়েছিল বরিশালে । পাত্রপক্ষ বড়লোক ,ব্যাবসায়ী । পাত্রটি স্বদেশী করত । অনুশীলন সমিতি। জেল খাটা ও নজরবন্দী হওয়া ,ছদ্মবেশ পরে  মাঝি সেজে নৌকো বাওয়া, সব রকম অভিজ্ঞতাই তার হয়েছিল। 

যতদূর জানা যায় বাপের বাড়িতে চিত্রা বেশ গায়ে হাওয়া লাগিয়েই ছিলেন। বিয়ের পর ঘরকন্না সামলানোর  দায়িত্ব তার ওপর এসে পড়ে । রান্না বান্নায় অসাধারণ পারদর্শিতার সূচনা এই সময়েই। অনেকটাই তার খাদ্যরসিক স্বামীর তত্ত্বাবধানে । এই ভাবেই দিন কাটছিল । বাপের বাড়িতে চিত্রার যাওয়া মানেই  এলাহি ব্যাপার । প্রচুর উপহার । চকলেট ল্যাবেঞ্চুস । ছোটদের পোয়াবারো । হাতে পয়সাকড়ি থাকত অনেক ।
দেদার বিলিয়েছেন । হৃদয় টা ছিল সোনা দিয়ে বাঁধানো
কিন্তু  ঘাতক কখন যে নিঃশব্দে এসে দাঁড়াবে তা তো তিনি বুঝতে পারেন নি ।
বন্যার জলে খড়কুটোর মত ভেসে গেল পরিবার । এল দেশভাগ আর ছিন্নমূল হবার অভিশাপ । ব্যাবসা উঠল লাটে । যে কঠিন বাস্তবটার সামনে স্বামী সন্তান নিয়ে চিত্রা দাঁড়ালেন তা হল দারিদ্র। চিত্রার একমাত্র ছোটভাই বিস্মিত হয়েছিল যখন সে দেখে তার বড়লোক দিদি তাকে বলছে হ্যাঁরে, তোর কাছে দশ  টাকা হবে?
টাকাটা সে দিয়েছিল । আর সারা রাস্তা হেঁটে বাড়ি ফিরেছিল।

শুরু হল আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার কঠিন লড়াই। আলো দেবার জন্য প্রদীপ যেমন জ্বলে,গন্ধ দেবার জন্য ধূপ পোড়ে,মাটির সঙ্গে ঘসা খেয়ে যেমন চাকা দৌড়োয় তেমনি ঘসা খেয়ে জ্বলে পুড়ে তৈরি হচ্ছিলেন চিত্রা, তৈরি করছিলেন আমাদের সামনে এক জ্বলন্ত উদাহরণ।
ঘরের বাইরে এলেন তিনি । খুব সাধারণ মানের একটি চাকরি পেলেন । সম্মানের সঙ্গে মাথা তুলে বেঁচে থাকার প্রথম পদক্ষেপ ।   চার ছেলেমেয়ের মা তিনি । ম্যাট্রিক পর্যন্ত পড়েছেন । অক্লান্ত পরিশ্রম তখন তার সঙ্গী  যতদিন দিন গেছে শানিত হয়েছে তার ব্যক্তিত্ব,বলিষ্ঠ ও ঋজু হয়েছে তার মেরুদণ্ড ।  বুঝেছিলেন ওই জায়গায় পড়ে থাকলে চলবে না। নিজের বড় মেয়ের সঙ্গে বি এ পাশ করেন তিনি । ধীরে ধীরে চাকরিতে উন্নতি হয় । কর্তব্যনিষ্ঠায় সমীহ আদায় করেছেন সহকর্মীদের ।


তার সম্পূর্ণ জীবন টাই একটা শিক্ষা যার মর্ম একালের সিন্থেটিক মেয়েরা বুঝতেই পারবে না।

নারীবাদের কোন ধ্বজা তুলে নয়,নারীত্বের শ্রেষ্ঠত্ব, তার শক্তি , প্রখর আত্মসম্মান,সাহস , তেজ,কর্তব্য নিষ্ঠা তার ছিল ষোলআনার উপর আঠার আনা । 


চিত্রা ঘোষ তাই অনন্য । চিত্রা ঘোষ আমার মেজ পিসি।