Monday 22 August 2016

বেজে গেছে কখন, সে টেলিফোন

ঞ্চ কাঁপিয়ে আলো আর শব্দের তোলাবাজির দাপট তখন প্রায় সহ্যসীমার বাইরে । কোনাকুনি ডান দিক বাঁ দিক ওপর সব দিক থেকে নানান আলোর চরকি ঘুরপাক খাচ্ছে । সেই সঙ্গে বাজনদারদের শব্দঝঙ্কার । আলো বলে আমাকে দ্যাখ , শব্দ বলে আমাকে শোন । ডুয়েট না হয়ে এ যেন ডুয়েল হচ্ছে ।
 এখনো গায়িকা প্রবেশ করেন নি । তিনি স্টেজে আবির্ভূত হবার উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি হচ্ছে । যাত্রাপালা শুরুর আগে যেমন জগঝম্প হয় শ্রেয়া ঘোষাল দৃষ্টিনন্দন এবং শ্রুতি নন্দন দুটোই । কিন্তু হলে হবে  কি, এতো নন্দনতত্ত্বের চাপ আমি নিতে পারলাম না । সারাদিন অফিস করার পর এই আলো আর আওয়াজ আরো যেন ক্লান্ত করে দিল ।  সিরি ফোরট অডিটোরিয়াম ছেড়ে বেরিয়ে এসে  রাজীবকে ডাকতে যাব , দেখি সে প্রচন্ড জোরে টার্ন নিয়ে ঘ্যাঁচ করে আমার সামনে গাড়ি থামিয়ে দড়াম করে দরজা বন্ধ করে প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে আমার দিকে আসছে । আমি তো হতবাক । সে কি , এখনো তো ওকে ডাকিই নি । রাজীব এসেই ওর ঘেমো চিটচিটে মোবাইলটা আমার সামনে তুলে ধরে  দম টম আটকিয়ে  কতগুলো শব্দ বের করল , বাত কিজিয়ে, জলদি জলদি , মা জি, মা জি কলকত্তা । “ এমনিতেই “মা জি কলকত্তা” শুনলেই আমার মূলাধার থেকে সহস্রার পর্যন্ত উৎকণ্ঠার  কুলকুণ্ডলিনী তড়াক করে ফনা তুলে ওঠে । ফোনটা ধরা মাত্রই আমার মায়ের গলা খুব বিরক্তির সঙ্গে  বেজে উঠলো , কি ব্যাপার? তুমি আমার ফোন ধরছিলে না কেন? আমি এতোবার ফোন করলাম , ফোন না ধরলে কি রকম দুশ্চিন্তা হয়, দিল্লির মতন শহরে একা একা ইত্যাদি ইত্যাদি বলে মা তাঁর বক্তব্য শেষ করলেন । আমিও দেখলাম গোটা দশ বারো মিসড কল ।  আর এদিকে শব্দের অত্যাচারে প্রায় বিকল স্নায়ু , মোবাইলের ভাইব্রেশনও বুঝতে পারে নি ।  অগত্যা এই বিপর্যয় ।
কিন্তু রাজীবের কাছে মায়ের ফোন গেল কি করে? আমাকে ফোনে না পেয়ে মা প্রথমে ঠিক করেন তাঁর পুত্রকেই জিজ্ঞেস করবেন। কেন মেয়েটা ফোন ধরছে না ?  সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর মাথায় এলো তাঁর অতি ঠান্ডা মেজাজের পুত্র  কোন স্বর কম্পন না করে যে নিমপাতা বা কালমেঘের বড়ির মত উত্তর দেবে (যেমন –একটু পরে করব মা? অথবা আমি কলকাতায় বসে কি করে বলি বলতো?) সেটা তাঁর সেই মুহূর্তের উত্তেজনার পারদকে নামাবে তো না বরং আরো বাড়িয়ে দিতেও পারে ।  সব ভেবে চিন্তে তিনি তাঁর জামাতাকে ফোন করলেন। এ যেমন রসগোল্লা রাবড়ি দেবে না আবার নিম পাতাও দেবে না । সে হল মঝঝিম পন্থা । এর কাছে কিছু আশ্রয় প্রশ্রয় পাবার চান্স আছে ।  সে শুনে বলল “ কোথাও গেছে বোধহয় , বাজার হাট । ফোনটা শুনতে পাচ্ছে না । আপনি চিন্তা করবেন না।“ কাজ হল না । মা বললেন, বলো কি? দশ বারো বারও শুনতে পেল না ? দিল্লির মতো শহরে একা একা । মঝঝিম পন্থা বলে ওঠে, না মানে, হয়তো  কোনো কারণে শুনতে  পাচ্ছে না । এতো  বেশি ভাববেন না । “ ব্যাস এই কথাতেই কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে পড়ল । মা এবার তাঁর অসুস্থ শরীরে যত টুকু তেজ ছিল তাই নিয়ে বেশ জোরেই বলে ফেললেন “ তুমি না ওর স্বামী ? কোন চিন্তা নেই ,হেলদোল নেই , কোন দায়িত্ববোধ নেই তোমার ?দশটা ফোনকলের একটাও সে ধরেনি ।  একটা মেয়ে দিল্লির মতন শহরে একা একা”এই হুমকি শুনে মঝঝিম পন্থা আরো গুরুতর বিপদ এড়াবার জন্য রাজীবের নম্বর মাকে দেয় , রাজীবও মায়ের প্রচন্ড দাপটে অগ্র পশ্চাৎ বিবেচনা  না করে সোজা আমাকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়ে ।
আমি ভাই মা বাবা এই চারজনের মধ্যে ফোন একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিল । এমনো অনেক সময় গেছে যখন দুই ছেলেমেয়ের সঙ্গে ওই টেলিফোনটুকুই ভরসা ছিল । মা আরো দুর্বল হলেন গৃহবন্দী হলেন, আরো বেশি করে  মোবাইল আঁকড়ে ধরলেন ।  অফিসেও ভাই সবসময় ফোন ধরত,হয়ত বেশি কথা বলার সময় থাকত না । এমনই একদিন প্রচন্ড ব্যাস্ততার মধ্যে মায়ের ফোন । ভাই বলতে যাবে একটু পরে করছি, তার আগেই মা বলতে শুরু করল শোন জয় , আজ আমার মনটা  ভীষণ খারাপ । সকালের চা টা ভালো হয় নি । তুই খেতে পারলি না , দেখতে পেলাম ।
ওগুলোতো শুধুই নিছক ফোন কল নয়, মাইলের পর মাইল  পাড়ি  দেওয়া সাতটা রঙের তরঙ্গ । কোনো তরঙ্গ নিয়ে আসছে মায়ের গন্ধ, উত্তাপ, রাগ অভিমান , ছেলেমানুষি, অসম্ভব উৎকণ্ঠাঅলস দুপুর ঘুঘুর ডাক লেবুর শরবত, লালশাক চিংড়ি , নারকেলপোস্ত বাটা। সন্ধেবেলার পুজোর ঘন্টা, লক্ষ্মীপুজোর গুজিয়া ,শীতকালের পালং সুপ, বিট মাটন রোল,মায়ের প্রিয় গান মহাবিশ্বে মহাকাশে,  বহে নিরন্তর অনন্ত আনন্দধারা ...। সঅঅব ভেসে ভেসে আসত ।
ওই ফোনটা নিয়েই মা তাঁর জবরদস্ত পাবলিক রিলেশন চালাতোকলের মিস্ত্রি , রঙের মিস্ত্রি কাঠের মিস্ত্রি, ইস্তিরিওয়ালা , জগা ইলেকট্রিশিয়ান , বাদল জমাদার , বিশ্বনাথ মুদি ,রিনা দরজি   চালওয়ালা, গ্যাস , মুচি মুটে মজুর সব্বাই হাতের মুঠোর মধ্যে জো হুকুম হুজুর  হয়ে থাকত । তবে মা তো মোটেও  কড়া মানুষ ছিলেন না, সব্বাই তাই মাসিমা জ্যাঠাইমা কাকিমা বলে বলে আসত, সব্বাই জল চা মিস্টি খেত আর মাকে বিস্তর ঠকাতো ।
  একবার পুজোর সময় আমরা সব একসঙ্গে আছি ক’টা দিন ভাই গেছে বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে । রাত হয়েছে । আমি মায়ের সঙ্গে শুয়ে পড়েছি। মা জানেন জয় এখনো বাড়ি আসেনি । অথচ মেয়েকে জিজ্ঞেস করলে সেই নিমপাতা উত্তর পেতে হবে , মা মঝঝিম পন্থাকে মোবাইলে ফোন করলেন, সে পাশের ঘরেই  টিভি দেখছে । ফোনটা পেয়ে একটু অবাকই হলসান্ত্বনা দিল ,পুজোর সময় তো একটু এরকম হবেই মা । মা সেখানেই শান্ত হলেন না , তিনি এবার ছেলেকে ফোন করতে শুরু করলেন, সে একসময়  জানালো শ্রীভূমি স্পোর্টিং এর ঠাকুরের জন্য গাড়ি প্রায় চালাতেই পারছি না , তুমি এভাবে ফোন করলে অ্যাকসিডেন্ট করে ফেলব কিন্তু । একটা নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাবার পর ছেলে ফিরছে না দেখে মা তাঁর অসুস্থ শরীর টেনে  নিয়ে সোজা মঝঝিম পন্থার দোরগোড়ায় । আদেশ হল,শোনো, আমাদের এখখুনি পুলিশে খবর দিতে হবে কারণ...।

এখন আর সেই ফোন গুলো আসে না, যেগুলোকে অনেক সময় মনে হত, উফ মা পারেও বটে, জানো আজ একটু হলেই শান্টু অ্যাকসিডেন্ট করছিল তোমার ফোনের গুঁতোয় ।
  সকালে না, দুপুরে না , সন্ধেয়  না, রাতে না । কেউ পথ চেয়ে বসে থাকে না ।
  কখন ফিরলাম, কি খেলাম ,মন খারাপ করছে কি না, গলাটা খুস খুস করছে কিনা  কেউ খবর নেয় না । কলকাতায় ফিরলে যত রাত্তিরই হোক সেই মিস্টি গলায় “ওয়েলকাম হোম”  কেউ বলে না । আমাদেরও তড়িঘড়ি কাউকে কিছু  জানানোর কোন প্রয়োজন নেই । এস এম এস এ একটা দুটো ছুঁড়ে দেওয়াই   যথেষ্ট ।
এখন তো কেবল “বুকের মধ্যে ধূ ধূ মরু ঢুকে পড়ে হঠাৎ দুপুর/তখন শুধু আকুল বিকুল দিখির জলের কাঁপন শুনি...”

মোবাইলটা ছিল শেষদিকে মায়ের একমাত্র খোলা জানালা । ওই মোবাইলটা দিয়েই ঠিক তিনবছর আগে মা প্রথম আঁচ করে ফোন করেছিল “এই শোন, একটু আয় তো, তোর বাবার শরীর টা মনে হয় ভালো নেই”
ভেবেছিলাম মার সঙ্গে মোবাইলটা দিয়ে দেব । অন্যরা রাজি হল না । তবে মা এখনো ফোন করে, ফোনগুলো বেজে বেজে বন্ধ হয়ে যায় । আমরাই শুনতে পাই না ।

কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ
কিছু মিছু রাত পিছু পিছু টান অবিকল
আলো আলো রঙ জমকালো চাঁদ ঝলমল
আজও আছে গোপন ফেরারি মন
বেজে গেছে কখন সে টেলিফোন
গুঁড়ো গুঁড়ো নীল রঙ পেন্সিল জোছনার জল
ঝুরো ঝুরো কাঁচ আগুন ছোঁয়া আজ ঢেকেছে আঁচল
আহা ফুটপাথ এ ভিড় জাহাজের ডাক ফিরে চলে যায়
আহা হা আহাহা
কথা ছিল হেঁটে যাব ছায়াপথ




2 comments:

  1. মনটা আমারও মায়ের জন্য কেমন করে উঠল।তিনিও এইরকমই ব্যস্ত হয়ে উঠতেন আমার জন্য ।এই আবহমান ।ভালো থাকুন ।

    ReplyDelete
  2. কি আর বলি ? আপনিও ভাল থাকুন ভাই

    ReplyDelete