Friday 23 June 2017

কমলালেবুর রস ও স্বপ্নমায়া

কমলা লেবুর রস
“ চালো , জালদি চালো “
আন্তালিয়ার  সকাল । কী রোদ্দুর ! পুদিনা শশা গাজর লেবু চাকা চাকা করে জাগ ভর্তি জলে মেশানো । টাটকা কমলা লেবুর রস । হঠাৎ শুনি এক সহাস্য বদন কানের কাছে এসে বলছে চালো, জালদি ।
এর নাম হামদি ।  আন্তালিয়ায়   আমাদের এখানে ওখানে নিয়ে যাবে । একগাল হেসে বলল ইন্ডিয়া পাকিস্তানের ট্যুরিস্টরা নিজেদের মধ্যে যখন কথা  বলে তখনই এই কথাটা  খুব বলে , চালো জালদি চালো ,  আমি  তাই শিখে নিয়েছি ।
মনেমনে ভাবলাম শিখেই শুধু নাও নি , মোক্ষম লাগিয়েছও বটে ।
হামদি নিজের গাড়ি নিয়ে এসেছে ।
আর কারা কারা যাবে ?
ও, দুটো ছেলে , ওদের তুলে নেব , চলুন ।
আন্তালিয়া একেবারে ঝলমলে উদ্দাম সুন্দরী । ভীষণ । রোমান সেলজুক অটোমান টার্ক দের ফেলে যাওয়া অতীতের ওপর সে বড় হয়েছে । তার নীল শিফনের অ্যাসিমেট্রিকাল পোশাকে সমুদ্রের ঢেউ , তার সোনালি চুলে সমুদের নুন , গলায় শঙ্খ মালা , চোখের নীল মাসকারায় কুচি কুচি অভ্র , তার হাতে ধরা মস্ত বড় একটা নীল ছাতা  । ছাতার ওপর রোদ্দুরের পায়রা উড়ছে ।  হাতে কাঁচের গেলাসে টলটলে তাজা কমলা লেবুর রস ।  দামাল মেয়ে ।






এমন রূপসী শহরের ভেতর দিয়ে চলেছি । মনটাও বেশ ফুরফুর করছে । প্রকৃতি পরিবেশের প্রভাব । সুদৃশ্য গলির মধ্যে খানিক খুঁজে টুজে হামদি ঘোষণা করল , ওই দুটো ছেলে মাতাল হয়ে বেহুঁশ হয়ে আছে । কাজেই ওরা আসবে না । হে হে হে , তোমাদের ভালোই হল।  কি বল ?
তাতো ভালোই হল । আমরা সমুদ্রের তটে ,বিভিন্ন  ঝর্নার ধারে এলিয়ে ঝেলিয়ে ঘুরতে লাগলাম । ইন্ডিয়া বা  ইন্দিস্তান থেকে  আসছি শুনলে সব্বাই খুব আন্তরিক ভাবে প্রায় বুকেই টেনে নেয় । ব্রাদার সিস্টার সব আমরা । হামদি যখন এ গলি সে গলি ঘুরছিল দেখলাম বেশ পুরোনো ধাঁচের দোতলা বাড়ি চারদিকে । হামদি বলে ওগুলো সব অতোমান হাউস । এরকম অটোমান বাড়ি প্রায় হাজার তিনেক । বাড়িগুলো এখন হোটেল , ক্যাফে , দোকান এইসব করে ব্যাবহার করা হচ্ছে ।



অটোমান সাম্রাজ্যের কফিনে  শেষ পেরেকটা ঠুকে দেন মুস্তাফা কেমাল আতাতুরক । খলিফাতন্ত্রের অবসানে আধুনিক তুরস্কের জন্ম তার  হাতে । মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ হয়েও সে দেশ সেক্যুলার হল পর্দা সরে গেল মেয়েরা পেল গনতান্ত্রিক অধিকার । আতাতুরক না থাকলে এই দীপ্ত , বহমান ও প্রাণবন্ত  তুরস্ককে হয়তো আমরা পেতাম না ।
হামদি খুব ভালোরকম আতাতুরক সমর্থক । উনি খুব মডার্ন , খুব  প্রগতিশীল , আজকে আমরা তো এখানে এসে দাঁড়িয়েছি ওনার জন্যই । আই হ্যাভ  গ্রেত  রেস্পেকত । গ্রেত রেস্পেকত

তুরস্কের ঝাঁকি দর্শন করে একটা বেশ লাভ হল । আনাতোলিয়া থেকে মেডিটেরানিয়ান , মেডিটেরা নিয়ান থেকে ইজিয়ান , ইজিয়ান  থেকে  মারমারা বোসফরাস কৃষ্ণ সাগর । মানুষের সামাজিক ধর্মীয় অবস্থান , তাদের চিন্তা ভাবনার সূত্র কেমন বদলিয়ে বদলিয়ে যাচ্ছিল লক্ষ করছিলাম  ।

কাপাদোসিয়া তো ভীষণই আধুনিক চিন্তা ভাবনার দিক থেকে ।  তুরস্কে খ্রিস্ট ধর্মের আদিএবং শক্তিশালী  কেন্দ্র । আমাদের ট্যুর গাইড মেসুট ( মাসুদ) এরকানকে ধর্ম কর্ম নিয়ে সাবধানী প্রশ্ন করাতেই উত্তর এলো, আমি কিন্তু মোটেই কনজারভেটিভ নই । আমাকে একজন টিপিক্যাল টার্কিশ ভেবে বসবেন না যেননা, আমি রমজান করি না ।
হ্যাঁ আমি আতাতুরকে নিয়ে গর্বিত । হ্যাঁ , আমি নাজিম হিকমত খুব পছন্দ করি । না, অনুবাদের থেকে মূল টার্কিশ কবিতাগুলো অনেক বেশি ভালো ।
এখানে মেয়েদের  হিজাব তুলনামূলক ভাবে অনেক কম দেখলাম । কোনিয়াতে আবার পোশাকে রক্ষণশীলতা ভালই চোখে পড়লো । ধরা পড়লো আহমেট , আমাদের গাইডের কথাতেও । সে আধুনিকও হতে চায় আবার রক্ষণশীলতাও পুরোদমে  চায় । গাছেরও খাবো তলারও কুড়ুবো ।  আর এবার আন্তালিয়ায় তো সবই দখিন দুয়ার খোলা ।
সমুদ্রের নীলে গাং চিলের খেলা , নরনারীর সুখ দুঃখের বিলাস , সাদা চামড়া ট্যান হচ্ছে , মাতোয়ারা শ্যাম্পেন ওয়াইন । নীল জলের সাদা ফেনার ভেতর থেকে মৎস্য কন্যার মত অপ্সরার মতো সুন্দরী মেয়েরা , হাতে শরবত পাশে কবিতার বই ,
ঝর্নার উদ্দাম খেলা, রঙিন কাকাতুয়া পিঠে নিয়ে যুবকের পথ চলা, বাচ্চা কাচ্চার হুতোপাটি , দেদার সেলফি আর সেলফি স্টিক ,জীবনের সমুদ্র সফেনের কোলাজ । আমাদের হাতে টাটকা কমলালেবুর রস ।







 হামদি বলে দেয়  ঝর্নার ধারে ক্যাফেতে খাওয়া সেরে নিন এইবেলা  । রংচঙে এথনিক সোফার ঢাকা , পাশে রাখা হুঁকো বা শিশা । তুরস্কের  নারী পুরুষ সবাই বেশ ভালো ধূম্রপায়ী ।   ধোঁয়া ছাড়তে দু পক্ষই সমান ওস্তাদ । চালু রেস্তোরাঁয় চটপট কাজ হয় । পাশে বসে অর্ডার মতো নানান কিসিমের  রুটি বেলছে একজন মহিলা । তারপর তাওয়া চড়বে । অলিভওয়েল ব্রাশ করা হবে । এরপর   পড়তে থাকবে  কিমা কুচি , পুদিনা , জাতার , সুমাক ,দিল , পার্সলে , রোজমারির ছিটে , টমাটো অলিভ কুভি , দেদার চিজ ,অর্ডার মতো পরোটা নিপুন হাতে বেলা হচ্ছে । আমরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই ভিন দেশি মহিলার রুটি বেলা দেখছি । হঠাত শুনি হামদি আমার কানের কাছে এসে বলছে ,ওকে ডাকো আর বলো  বাবান্নে , বাবান্নে ।
বলা নেই কওয়া নেই এইসব ডেকে মারধোর খাই আর কি ! বললাম আগে বল কথাটার মানে কি ? মানে হল গিয়ে ঠাকুমা ।
বাবা মানে বাবা আর আনা মানে মা । বাবার মা ।
দেখো ঠাকুমা বলে ডাকলে কিরকম খেপে যাবে ।
আমি বললাম , তুমি ডাকো গে যাও ।
হামদি সত্যি সত্যি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকতে থাকল  ঠাকুমা ঠাকুমা  আর ওই মহিলাও কপট রাগ দেখিয়ে কাঠের খুন্তি তুলে মারার ভঙ্গি করতে লাগলো । ভারি  রগড় । আশ্চর্য কথা , বেশ খানিকটা আসার পরেও হামদি আবার গলা তুলে রীতিমত চিৎকার করে ঠাকুমা... বলে গাড়িতে উঠে পড়লো ।

তুরস্কের এইগুলো ভারি মজার । এশিয়া ইওরোপের মেলামেলিতে ইওরোপীয় ঠাটবাটের সঙ্গে ঘোরতর দেশজ ব্যাপারগুলো মিলে মিশে নৌটঙ্কি একেবারে জোরদার । লোকজন যথেষ্টই চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে কথা বলে , আবেগের পাত্র একেবারে উথলে উঠছে । টিপিক্যাল পশ্চিম ইওরোপীয় হলে কল্পনাই করা যেত না ।

হামদির সঙ্গে  ঘুরে বেড়ানোর সময় দেখলাম বিশাল বিশাল ফার্ম । প্রচুর চাষবাস হছে । ফল সবজি একেবারে উপচে পড়ছে । সবই খুব আধুনিক ধাঁচে । হামদি বলল কমলা লেবু বেদানা কলা বেগুন  এখানে খুব বেশি হয় । এগ্রিকালচার এখানে প্রধান জীবিকা । হাতের কাছে টুকটুকে কমলালেবুর থোলো , নীল সমুদ্র আর নীল রোদালো আকাশ ,মাতাল হতে আর কিছু বাকি আছে কি?
পরেরদিন এয়ারপোর্টে যাবার জন্য ট্যাক্সি হাজির । আমরা একঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে যাবো ইজমির । সেখানে দেখব এফেসাস ।
ড্রাইভার মোটে ইংরেজি জানে না । কিন্তু গল্পে আদরে সোহাগে একেবারে ফেটে পড়তে বাকি আছে ।  সে তার ভাষায় কথা বলছে অনর্গল , আমরাও বকে চলেছি নন স্টপ । সে যা বোঝাতে চাইলো তার সার মর্ম হল আন্তালিয়া স্বর্গের মতন জায়গা । কোনো কিছুর অভাব নেই । ইস্তানবুল ! বাপরে কি ভিড় ! আচ্ছা তোমারা তো ইন্দিস্তানি ।
হঠাৎ প্রচন্ড চেঁচিয়ে কোনো একটা কিছুর দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো আতাতুরক আতাতুরক ।
আমরা চোখ তুলে দেখলাম আতাতুরকের একটা বিশাল বড় ছবি ঝুলছে ।
সে উত্তেজিত হয়ে হাত পা ছুঁড়ে বলতে লাগল জান, জান । অর্থাৎ আতাতুরক তার হৃদয়ে । আমরাও প্রবলভাবে বোঝাতে চাইলাম আমরাও আতাতুরক কে ভালবাসি , আমাদের শহরে আতাতুরকের নামে রাস্তাও আছে ।
বোঝানোর কৌশল টা যদিও খুব সহজ ছিলনা , প্রতি মুহূর্তেই  অ্যাকসিডেন্টের চান্স ছিল শতকরা আশিভাগ । কিন্তু লোকটা এত্ত খুশি হল যে তার প্রার্থনার তসবি টা পর্যন্ত আমাদের দিয়ে দিল । আর এই প্রথম তার মুখ দিয়ে একটা মোক্ষম ইংরেজি বাক্য বেরুলো আই লাভ আতাতুরক । 




স্বপ্ন মায়া


কাশ , তুরস্কের ফিরোজা উপকূলে একটা ছোট্ট বন্দর । তুর্কি ভাষায় কাশ  মানে  ভুরু । মাত্র ২০ মিনিটের ফেরি নিয়ে যাবে আরেকটা অন্য  দেশে ,ছোট্ট একটা অন্য  দ্বীপে , তার নাম মেইস । গ্রিসের দ্বীপ । গ্রিক ভাষায় যার মানে চোখ । ভুরুর নিচে দীঘল নীল চোখ । ভুরু আর চোখ ,  দুই দেশের দুটো দ্বীপের নাম মাত্র ২০ মিনিটের ফেরি ।  কি কাছাকাছি, পাশাপাশি ,তাই না ? আমাদের সঙ্গে গ্রিসের কতো মিল ! বাকলাভা কারা  বানিয়েছিল ? তুর্কি না গ্রিক ? তুমি কি এটা নিয়ে ফালতু তর্ক করবে না আরেক টুকরো বাকলাভা খাবে বলে প্লেট এগিয়ে দেবে , বল?
আর মুসাকা ? খাওয়া দাওয়া, গান বাজনা সবেতেই তো মিল!  নীল রঙা ইভিল আই ওরাও ব্যাবহার করে, আমরাও । রাকি আওজু ? সেই মৌরি গন্ধী কড়া মদ ? গ্রিসে যা আরো হালকা করে খায় ? আমার কি মনে হয় জানো , যত দিন ধরে আমরা ঝগড়া করছি তার অনেক অনেক বেশি সময় আমরা অতীতে পাশাপাশি একসাথে ছিলাম ।
ওপরের কথাগুলো বলছিল মেসুট এরকান । আমাদের গাইড । ইজিয়ন সমুদ্র থেকে ঠান্ডা হাওয়া বুনো ল্যাভেন্ডারের গন্ধ মেখে ভেসে আসছিল যেন । এতো চেনা এই কথাগুলো ।ভেতরটা কেমন শিরশিরিয়ে উঠলো । ছোটবেলায় বাবা শিখিয়েছিল সুভাষ মুখুজ্জের কবিতা  “ আমরা যেন বাংলাদেশের চোখের দুটি তারা / মাঝখানে নাক উঁচিয়ে আছে থাকুক গে পাহারা/দুয়োরে খিল টান দিয়ে তাই খুলে দিলাম জানলা/ এপারে যে বাংলাদেশ ,ওপারে সেই বাংলা”।  আজ চারদিকে সব উত্তাল । দেশ বিদেশ সর্বত্র । জাতি ধর্মের ঝগড়া । কতদিন ধরে চলছে গ্রিস তুরস্ক মন কষাকষি  ।  কতো মৃত্যু কতো রক্তপাত ! পপুলেশন এক্সচেঞ্জের সময় গ্রিকরা  তুরস্কের ভিটে মাটি ছেড়ে চলে গিয়েছিল গ্রিসে ।

 কোথাও দেওয়াল নেই,কাঁটাতার নেই,পর্দা নেই ,সীমানা নেই
এমন একটা বাড়ি একটা দেশের কথা ভাবত সে
তার চারদিকে ঝুঁকে পড়ত বিষণ্ণ অন্ধকার, মানুষের তৈরি
সে পকেটে হাত ঢুকিয়ে একরাশ জোনাকি তুলে এনে
ছুঁড়ে দিত চুমকির মতো, ঢুকে পড়ত তারা
মানুষ জনের ঘর সংসারে চিন্তা ভাবনায়...(বাসুদেব দেব)
  
ইজিয়নের সেই নীলচে হাওয়ায়  বুনো ল্যাভেন্ডারের  গন্ধের ভেতরে মেসুটের চারদিকে তার স্বপ্নের জোনাকিরা জ্বলে উঠল দেখতে পেলাম । আমরা চলেছি মেরিয়াম আনা , মেরিয়ামানা  ।ইজিয়নের ধারে মেরিয়ামানা । ইজিয়ানের ধারে এফেসাস ।প্রাচীন গ্রিক রোমান বন্দর শহরের ধ্বংসাবশেষ।   জেরুসালেম থেকে এফেসাস কদ্দূর ? প্রায় ২০০০ কিলোমিটার এখনকার হিশেবে ।
ম্যাপল গাছের মধ্যে দিয়ে আঁকাবাঁকা  পাথুরে রাস্তা ।  উঁচুনিচু । কিছু আয়েসি পর্যটক ঘোড়ার গাড়ি নিয়ে বেড়াচ্ছেন । আকাশ মেঘে ঢেকে যাচ্ছে , টিপিটিপি বারিষ । ম্যাপল গাছের পাতা থেকে বিন্দু বিন্দু ঝরে জল ,শ্যামল বনান্তভূমি করে ছলছল । এসেছিলে তবু আসো নাই ,সমুখের পথ দিয়ে পলাতকা ছায়া ফেলে



একটা ছোট্ট ঘরে সন্ন্যাসিনী শুয়ে আছেন । প্রায় চলতে ফিরতে পারেন না । দুর্বল ক্ষীণ শরীর । আজীবন রুগ্ন । বিছানার সঙ্গে লেপ্টে থাকেন অ্যানা কাথেরিনা এমেরিচ । ঘোর লাগে  তার । আজ থেকে নয় ,অনেক ছোটবেলা থেকে ঘোর লাগে । সেই ঘোরের মধ্যে প্রভু যিশু আসেন তার কাছে । তাঁর দেশ জার্মানির বাইরে তিনি কোথাও কোনো দিন যান নি।
উপরন্তু তার শরীরে ছিল বিশেষ কিছু চিহ্ন । stigmata ..
ঠিক যেন কেউ পেরেক পুঁতেছে ,সেই রকম দাগ । ফুলে ওঠে , রক্তও পড়ে । ডাক্তার দেখে যায়আবার কিছুদিন পরে একই রকম ব্যথা , যন্ত্রণা , রক্ত পড়া । অ্যানা স্বপ্নের মধ্যে , ঘোরের মধ্যে একটা পাথুরে বাড়ি দেখতে পান । চারকোনা পাথুরে বাড়ি , পাহাড়ের ওপর । সরু পাথুরে রাস্তা । ঝোপঝাড় । সব তিনি দেখতে পান ।এলাকাটা কি রকম তা তিনি স্পষ্ট দেখতে পান ।  দেখতে পান মাতা মেরি যিশু মারা যাবার পর সেন্ট জনের সঙ্গে এই বাড়িতে চলে এসেছেন  । কিন্তু বাড়িটা কোথায় , জায়গাটা কোথায় পুরোটাই ধোঁয়াটে থেকে গেলো যে  । ১৮২৪ সালে অ্যানা মারা যান ।  





জেরুসালেমে যিশু ক্রুশবিদ্ধ হলেন খুব অশান্ত সময়ে । ইহুদি পুরোহিত তন্ত্র,  রোমান শাসকদের ঈর্ষা ষড়যন্ত্র । অন্ধকার বিভীষিকা । ঠিক সেই সময়ে এফেসাসের পরিস্থিতি ছিল একেবারে আলাদা । এফেসাস তখন খ্রিস্টানদের শক্ত ঘাঁটি । বাইজানটাইন আনাতোলিয়া যিশুর জীবদ্দশায় তাঁর ধর্মকে গ্রহণ করেছিল ।  জেরুসালেম যখন ধর্মীয় রেষারেষিতে অস্থির সেই সময় কতো দূরে এশিয়া মাইনরের এই অঞ্চল আঁচল পেতে যিশুকে গ্রহণ করেছিল । নতুন খ্রিস্টানরা জেরুসালেমে মোটেও স্বস্তিতে ছিলো না , কাজেই ধরে নেওয়া যেতে পারে ছেলের মৃত্যুর পর মা মেরি কাউকে সঙ্গে নিয়ে এফেসাসের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে এসেছিলেন । যিশু , জনের হাতে মায়ের দায়িত্ব দিয়ে গেছিলেন । তাই জনের সঙ্গেই মা মেরি এখানে চলে আসেন ।
এরপর ঝঞ্ঝার মতো আছড়ে পড়ে ক্রুসেড । আনাতোলিয়া চলে যায় মুসলমান অটোমান টার্ক দের অধীনে ।  কিন্তু এই এফেসাস আর তার আশেপাশের ভিটেতে  খ্রিস্টানদের প্রভাব থেকেই  যায় ।    বহু বছর পরে ১৮৯১ সনে অ্যানার স্বপ্নকথা শোনার পর  এক ধর্মযাজক ভয়ানক কৌতূহলী হয়ে পড়েন । জায়গাটা এমনিতেই পাথুরে, পাহাড়ে ।  আন্দাজ করে খুঁজতে খুঁজতে তিনি পাহাড়ের মাথায় একটা চারকোনা পাথুরে বাড়ির সন্ধান পেলেন । সেখানে প্রাচীনপন্থী উপাসনা চলছিল কয়েকশ বছর ধরে । তারপর হৈ চৈ , হট্টগোল , বিশ্বাস অবিশ্বাসের গলিঘুঁজি পেরিয়ে ভ্যাটিকান রোমের মহামান্য  মোহর এসে পড়লো, যে ঘটনাটি সত্য । তারপর ষাটের দশকের পর থেকেই মেরিয়ামানা সারা পৃথিবীর খ্রিস্টানদের পবিত্র ভূমি । তবে এখানে খ্রিস্টান এবং ইসলাম দুই ধর্মের মানুষরাই আসেন । বাইবেলের থেকে নাকি কোরআনে মা মেরির বেশি উল্লেখ আছে । মেরিয়াম । আরবিতে মূর্তির নিচে কিছু লেখাও আছে , ঠাহর হল
গাছপালা ঢাকা ভিজে ঘাসে ঘাসে সবুজ পথ পাকদণ্ডী বেয়ে বেয়ে উঠে গেছে । বেশ প্রশস্ত জায়গা । প্রচুর গাছপালা । গাছের নিচে দাঁড়ালে বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে লাগছে না । সেই বর্ষণ স্নিগধ প্রাক মধ্যাহ্নে কোরেসস পাহাড়ের ওপর  একটা সাদাসিধে চারকোনা এবড়ো খেবড়ো পাথুরে দু কামরার ছোট্ট সহজ সরল  ঘর আমাদের বিহ্বল করে রাখলো বেশ কিছুক্ষণ । ভেতরে ছবি তোলা বারণ । বড় শান্ত পরিবেশ । সাদা লেসের পোশাক পরে এক সন্ন্যাসিনী মালা জপছেন । মুখে একটা আলগা হাসি প্রথম ঘরটি মাঝারি, পরের ঘরটি আরেকটু ছোট , মনে হয় রান্নাঘর । জানলা গুলো বেশ উঁচুতে ।  ব্যাস এইটুকুনই । 







আরকিওলজিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে বাড়িটা খ্রিস্টিয় প্রথম 
শতকে তৈরি কাজেই প্রমাণের দিক থেকেও তথ্য টি জুতসই । অনেকে মোমবাতি জ্বালাচ্ছে, বোতলে জল ভরে নিচ্ছেঝর্না থেকে বয়ে আসা এই জল নাকি খুব জোরালো । অসুখ বিসুখ সেরে যায় । বাইরে সুন্দর বসার ব্যাবস্থা । খোলা আকাশের নিচে বসে বসে প্রার্থনা করা যায় ।
উইশিং ওয়ালে লোকজনেরা মনের কথা টিসু পেপারে লিখে বেঁধে দিচ্ছে , যেমন আমাদের দেশে মানত করে, সুতো বাঁধে , ঢিল বাঁধে । এই কাগজে পাতলা কাপড়ে মনের কথা লেখার ব্যাপারটাকে নাকি শামান প্রথা বলে । তুর্ক রা ইসলাম হবার আগে নাকি শামান ছিল । এ ব্যাপারে বিশদ জানা নেই অবিশ্যি । খ্রিস্টান ,ইহুদি ,ইসলাম কতো নামের বাইরের বাহারি  আচ্ছাদন পরে মানুষ এখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে, প্রার্থনা করছে  । আর আমি ভাবছি চুয়ান্ন বছর বয়সী এক মহিলার কথা । কতটা পথ পাড়ি দিয়ে কতো ধকল সয়ে  ,মাটি থেকে ১২০০ ফুট উঁচু এই জঙ্গলে নিভৃতচারী হয়ে কাটিয়েছেন জীবনের শেষ কয়েকটা বছর ।
 কেমন আছো মা ?  ইজিয়ন সাগর ধুয়ে দিচ্ছে তোমার পা । ম্যাপল  পাতা ছড়িয়ে আছে মাথার ওপর ।কেমন আছো  মোমবাতির আলোয় অজস্র ফুলে ফুলে ঢাকা এই নির্জন আবাসে?

আলতো মোমবাতি নিভে যাচ্ছে
বিস্মৃতির কোন চিহ্ন ছাড়াই ,
কুয়াশা- বাতাস ছড়িয়ে দিচ্ছে
মাঝ রাতের ঘন ক্যাফেইন

এই নির্জন অন্ধকারে
হয়তো ধ্যানই ছিল আমার একমাত্র গন্তব্য,
তবু ক্রমাগত ভেসে চলেছি জলে
পুরনো মাছের মতো

একটা বিশাল পুরাণ ঘুমিয়ে পড়ছে
আমার বুকের ভেতরে,
আমি ফিসফিসিয়ে জানতে চাইছি-
সভ্যতা ভালো আছে কিনা !




কবিতা প্রমিতা ভৌমিক


2 comments: