জল সইতে সইতে চলেছি ।
বড় একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে এলো । একটা আলোমাখা ছোট্ট শহর । জলছবির মতো । ফিরোজা রঙের
জলের ধারে ।
পুরোনো পুরোনো বাড়ি ।সেসব বাড়িতে আবার বাহারি রঙ । শীতের পাতাঝরা
ন্যাড়া গাছ । রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সেই সব রঙদার বাড়ি । ছোট্ট ধুকপুকি শহরের
মাঝখান দিয়ে তিরতির খালের জল বয়ে যায় । আর ছোট্ট ছোট্ট সেতু দিয়ে এদিক ওদিক এপার
ওপার খাল পারাপার করে । রাস্তায় যেমন সার বেঁধে সাইকেল বাইক গাড়ি দাঁড় করানো থাকে
, এখানে তেমনই ডাঙার গা ঘেঁসে বোট দাঁড়িয়ে আছে । অমুক বাড়ির বোট, তমুক বাড়ির বোট ।
জায়গাটার নাম মুরানো । ঠুনকো রঙিন বেলোয়ারি কাঁচের দেমাক । রঙিন কাঁচের শিল্পকর্মের জন্য একরত্তি
এই দ্বীপ বিখ্যাত । ভেনিস থেকে জল বাইতে
বাইতে এই বেলোয়ারি দ্বীপে এসে
পড়া গেলো ।
রঙিন কাঁচের নানান সামগ্রী । পথের ধারে ধারে ওয়ার্ক শপ । কোনোটাই
সস্তা নয় হে । মুরানোর জিনিশপত্রের দাম বেশ চড়া ।
দোকানপাট খুলছে । বেশির ভাগ দোকানেই মেয়েরা বসে আছেন । হ্যাঁ ,
জিনিশপত্র ভালোই । কিন্তু আহা উহু করার মতো কিছু নয় । ইওরোপ সমঝদার সেয়ানা জায়গা । আমার এইটুকু আছে , আমি এতো খানি করে দেখাবো । আমাদের মতো সেরা আর কেউ হতেই পারে না । ভাবখানা ভালো ।
আমাদের দেশের থেকে অন্তত ঢের ভালো ।
মুরানোর পাশে বুরানো । সেই মেয়ে আবার সারাদিন ধরে লেস বোনে । মুরানোর কাঁচ আর বুরানোর লেস । এই
নিয়েই দুই দ্বীপ কন্যা কত কত বছর ধরে ঘরকন্না করছে । এতো পথিকের আনাগোনা, এতো
প্রেমিকের ভালোবাসা তাদের আর বুড়ি হতে দিলো কোথায় ? মোটা মোটা সোনালি বেণী ঝুলিয়ে
ফিরোজা জলে পা ডুবিয়ে সেই কবে থেকে ,
হ্যাঁ তা প্রায় সাতশো আটশো বছর হবে , দুটিতে বসে লেস বুনছে আর কাঁচের জিনিশ
বানাচ্ছে ! ভাবা যায় !
মুরানো আর বুরানো ঘুরে আসার
কথা বলেছিল মিতিলা । মিতিলা অ্যাড্রিয়াটিক
সাগরে থাকে । অনেক অনেক গভীরে । মাঝে মাঝে পথ ভুলে গ্র্যান্ড ক্যানালে হাবুডুবু খায় । ছলাত
ছলাত জল ছিটিয়ে ভর সন্ধে বেলা যখন ভেনিসে নামলুম , কনকনে ঠান্ডা হাওয়া নাকের ডগা
জমিয়ে দিল আর কানের পাশে শনশন করে বয়ে যেতে যেতে বলল, মিতিলা মিতিলা মিতিলা । সেই
ডাক আমি আর অরো ছাড়া কেউ আর শুনতেই পেল না ।
মিতিলা আমাদের বুরানো আর মুরানো ঘুরে আসতে বলেছিল । ভেনিস থেকে ঘন্টা
খানেক । সেন্ট মার্ক এর সামনেই সান্তা জাক্কারিয়া । সেখান থেকে সব নৌকো , জল বাস , জল ট্যাক্সি ধরা যায় ।
আমরা ওকে জিজ্ঞেস করলাম তোমার
সঙ্গে কবে দেখা হবে ? মিতিলা মিলিয়ে যেতে যেতে বলেছিল , হবে হবে , শিগগিরি ।
মিতিলা র কথা মতো আমরা মুরানো আর বুরানো দেখতে বেরুলাম । মুরানোতে
একটা কাঁচের ওয়ার্ক শপে বসেবসে কাঁচের শৌখিন জিনিস বানানোর কৌশল দেখলাম । লম্বা
পাইপের মুখে ফুঁ দিয়ে নানান রকমারি নকশা
আর আকার তৈরি হচ্ছে ।
একটা পুরোনো সোঁদা বাড়ি । জলতরঙ্গের মতো ঠুং ঠুং বাজনা । মহার্ঘ শিল্প
দ্রব্য আর সেই ফুঁ ভেলকি দিয়ে জিনিশ বানানো দেখছি । নানান রঙে চুবিয়ে আগুনে
পুড়িয়ে পুড়িয়ে ফুঁ এর পর ফুঁ দিয়ে বানানো হোল একটি রঙিন টলটলে হৃদয় । তখনো গরম !এ
যেন এক টুকরো মেভলানা রুমি , I was raw , I was cooked , I was burnt । পুড়ে পুড়ে তবে
হৃদয়টি খাঁটি হোল । হৃদয় টি আবার রঙে নাস্তানাবুদ ! । রঙ যেন মোর মর্মে লাগে ! দেখতে ভারি সুন্দর । হৃদয়ের মূল্য অনেক । কোনো মানেই হয় না কেনার
! ঠুনকো হৃদয় । হাত থেকে পড়ে গেলেই ভেঙে
যাবে । তার চেয়ে আমরা গাদাগুচ্ছের ময়দা আর চিজ দিয়ে ফাটাফাটি লাঞ্চ করবো । কী বল ?
লেসের জিনিশগুলো কী চমৎকার
দেখতে । সুন্দর সুন্দর পোশাক , টুপি , টেবিল ঢাকা , কত শৌখিন ,কত বাহারি । মেয়ে মহিলারা বেশ আলাপি, বাড়ির ব্যাবসা চলেছে অনেক প্রজন্ম
ধরে । চিনের জিনিশে
ছেয়ে যাওয়া বাজারে এগুলো খাঁটি ইতালিয় । একসময় কাঁচ শিল্পের গুপ্তবিদ্যা
বাইরে নিয়ে যাওয়া যেত না । ব্যাবসার জন্য
নানান দেশে মালপত্তর নিয়ে যাওয়া হতো । কোন কারগর নাকি গিল্ড বা স্থানীয়
নিয়মানুযায়ী অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারতো না । কিন্তু ঐ যে , রাঁধুনি সব বলবে কিন্তু একটা
গুপ্তকথা থেকেই যাবে ।
রঙ বেরঙের বাড়ি , ঝিরঝিরে খাল , ছোট্ট ছোট্ট সাঁকো , গির্জা , লেস আর
কাঁচের দোকান , এই নিয়েই মুরানো আর বুরানো । আমরা আস্তে আস্তে হাঁটছি । হঠাত দেখি ১১১ নম্বর
বাড়ি ! আবার ১০১ নম্বর বাড়ি ! আশ্চর্য
ব্যাপার ! প্রচন্ড কৌতূহল ছটফট করছে !
কিন্তু কাকে জিগ্যেস করবো ? সামনে
একটা বাঁধানো খোলা চত্বর আর শুনশান গির্জা । এবং শুধু পিসার
হেলানো মিনার নয় মালুম হচ্ছে ইতালির সব গির্জার চূড়া একটু হেলে পড়া । ভালোভাবে ওলন
দড়ি ব্যাবহারই করেনি । কিন্তু হাল আমলের আমাদের কলকাতার সেই ক্লক টাওয়ারও কিঞ্চিত হেলানো । “ শ্যাম তুমি বাঁকা , বাঁকা তোমার মন” ।
আঙুর বালা গেয়েছিলেন গো !
এমন সময় দেখি একটা ছেলে, ফিটফাট বাবু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট
খাচ্ছে । আমরা অমনি সদলবলে গায়ে পড়ে , “হেঁ, হেঁ , এখানেই থাকেন বুঝি “ গোছের কথা
দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম । কোন এক জিপসি বেদের মেয়ে জোসনা ,মুজতবা
আলিকে বিদেশের কোন এক শহরে প্রায় জাপটে ধরে বলেছিল আমরা তো এক দেশের ! ইন্ডিয়ার ।
আমাদেরও দলের কোনো কোন সদস্য মনে করেছিল ঐ ১১১ এর গেরো থেকে না জানি কী রহস্য বের
হয় আর রাতের খ্যাঁটন টা তাদের ঘাড়ে চেপে খেলেই হয় ! তা সে ফিটফাটও বেশ আলাপি , সে বলল
হ্যাঁ এটা “এক” সংখ্যা । ওহ
তাই ? তোমরাও এভাবে এক লেখো ? তবে এটা এখন আর লেখেনা কেউ । এটা পুরোনো ,মানে বেশ
পুরনো ,মানে আমার ঠাকুরদা বা তার বাবা এরম লিখতেন ।
তোমরা খুব হেরিটেজ বাঁচিয়ে চলো , না?
এতো ক্ষণে বুঝলাম এই রঙ মশালি শহরের রহস্য ।
তা, যাতায়াত তো সবই ঐ জল বেয়ে বেয়েই করো , তাই তো ?
ফিটফাট বলল , হ্যাঁ , তাইতো । আমাদের তিনটে বোট আছে ।
তিনটে?
হ্যাঁ , একটা আমার , একটা বাড়ির, আরেকটা গার্ল ফ্রেন্ডের । কোনো প্রবলেম নেই ।
ওকে টাটা ।
আমরা এবার আমাদের অবস্থান
বুঝে গেছি । কোনো বেদের মেয়ে জোসনা যখন বেরুলোই না , তাই খাবারের সন্ধানে বের হলাম
। তারপর একটা দোকানে গিয়ে এক সুন্দরীকে বললাম এক লিখুন তো ! সে সরল মনে কোনো
প্রশ্ন না করে ভুরু না কুঁচকে ইংরেজি ওয়ান
লিখলো । আমি বল্লুম , না না আরেকটা এক আছে আপনাদের । সে বলল ওঃ , সে তো কেউ লেখেনা
এখন । সে টা খুউউব পুরোনো ।
মনে একটা খটকা রয়ে গেলো কিন্তু ফিটফাটের তথ্য যাচাই করে নিলুম এই বেলা
।
জলের ধারে একটা বাড়ির গায়ে মস্ত বড় একখানা ইংরেজি এস লেখা । সেই মারকো
পোলোর আমল থেকে বোধহয় । জলের ধারে বাড়ি , জলের দামে কিনে নিতে পারি কিনা জম্পেশ
করে ভাবছি । ভাবছি হেজেলনাট আর সিনামন কফি
আর কুড়কুড়ে স্কুইড ভাজা, দারুণ চলবে দোকান।। অমনি
আমার দলের বেয়াক্কেলে লোকজনেরা “এই জল বাস ( ওয়াটার বাস) এসে গেছে , এর
পরের টা অনেক দেরি । “ । দৌড় দৌড় দৌড় ।
বুরানো চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে । একটা নাবিক জেলে, সেই কবে কে জানে
বিয়ের ঠিক আগে আগে মাঝদরিয়ায় গেলো । তার
হবু বউ এর মুখ খানা মনে পড়ে । হঠাৎ উথালিপাথালি ঢেউ এর মধ্যে রাঙা আলো মাখা জলে ভুস করে মাথা তোলে এক মৎস্যকন্যা।
ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম নিবেদন করে । জেলে প্রেমিক টি তাতে একটুকুও গলে গেলো না । তার
চোখ জুড়ে হবু বউ এর মুখ খানা তারার মতো জ্বলে । মৎস্য কন্যা খুব আশ্চর্য হয় আবার
খুশিও । উপহার হিশেবে তার লেজের ঘূর্ণি তুলে সমুদ্রের ফেনা জমিয়ে জমিয়ে একটা
অদ্ভুত ফুরফুরে নকশা সে জেলেটির হাতে তুলে দিয়ে ভুস করে ডুবে যায় ।
সেই ভেজা নকশা রোদ্দুরের তাপে
, মিঠে হাওয়ায় আস্তে আস্তে শুকিয়ে
ওঠে । জেলে নাবিক বাড়ি ফিরে সেই ফেনা জমা
নকশা বউ এর হাতে তুলে দেয় । সেই মেয়েটি ভারি অবাক হয়ে যায় ! এতো সুন্দর একটা জিনিশ
।
এর নাম কী ?
মৎস্যকন্যার লেজ , জেলে উত্তর দেয় ।
সুতো দিয়ে সেই মেয়েটি নকশা বুনতে শুরু করে । বুরানোর লোকগাথা । সেই
লেস যা ইওরোপের ফ্যাশান আর স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এককালে ।
এই গল্প শোনার পর আমি বুঝলাম কেন মিতিলা আমাদের বুরানো মুরানো দেখতে
বলেছিল এতো করে । ভেনিসে নামলাম সন্ধের মুখে ।সান্তা জাক্কারিয়া । দোকান থেকে
কিনবো অনেক কিছু । তারপর কাশীর গলি বা উত্তর কলকাতার গলির গলি তস্য গলি দিয়ে বাড়ি
ফিরব । আর মিতিলা ? সে তখন অ্যাড্রিয়াটিকের গভীরে ট্রিনা ডেলে সাইরেন বানাচ্ছে ,
লেজের ঝাপট দিয়ে ।
No comments:
Post a Comment