Wednesday 6 March 2019

গ্রাফিত্তি ইতালিয়া : মুরানো বুরানো



ল সইতে সইতে চলেছি । বড় একটা ঢেউ এসে ভাসিয়ে নিয়ে এলো । একটা  আলোমাখা ছোট্ট শহর । জলছবির মতো । ফিরোজা রঙের জলের ধারে
পুরোনো পুরোনো বাড়ি ।সেসব বাড়িতে আবার বাহারি রঙ । শীতের পাতাঝরা ন্যাড়া গাছ । রোদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে সেই সব রঙদার বাড়ি । ছোট্ট ধুকপুকি শহরের মাঝখান দিয়ে তিরতির খালের জল বয়ে যায় । আর ছোট্ট ছোট্ট সেতু দিয়ে এদিক ওদিক এপার ওপার খাল পারাপার করে । রাস্তায় যেমন সার বেঁধে সাইকেল বাইক গাড়ি দাঁড় করানো থাকে , এখানে তেমনই ডাঙার গা ঘেঁসে বোট দাঁড়িয়ে আছে । অমুক বাড়ির বোট, তমুক বাড়ির বোট ।









জায়গাটার নাম মুরানো । ঠুনকো রঙিন বেলোয়ারি কাঁচের দেমাকরঙিন কাঁচের শিল্পকর্মের জন্য একরত্তি এই দ্বীপ বিখ্যাত ।  ভেনিস থেকে জল বাইতে বাইতে এই বেলোয়ারি দ্বীপে এসে পড়া গেলো ।  
রঙিন কাঁচের নানান সামগ্রী । পথের ধারে ধারে ওয়ার্ক শপ । কোনোটাই সস্তা নয় হে  মুরানোর জিনিশপত্রের দাম বেশ চড়া ।
দোকানপাট খুলছে । বেশির ভাগ দোকানেই মেয়েরা বসে আছেন । হ্যাঁ , জিনিশপত্র ভালোই । কিন্তু আহা উহু করার মতো কিছু নয় । ইওরোপ সমঝদার  সেয়ানা জায়গা আমার এইটুকু আছে , আমি এতো খানি করে দেখাবো । আমাদের মতো  সেরা আর কেউ হতেই পারে না । ভাবখানা ভালো । আমাদের দেশের থেকে অন্তত  ঢের ভালো ।
মুরানোর পাশে বুরানো । সেই মেয়ে আবার সারাদিন ধরে  লেস বোনে । মুরানোর কাঁচ আর বুরানোর লেস । এই নিয়েই দুই দ্বীপ কন্যা কত কত বছর ধরে ঘরকন্না করছে । এতো পথিকের আনাগোনা, এতো প্রেমিকের ভালোবাসা তাদের আর বুড়ি হতে দিলো কোথায় ? মোটা মোটা সোনালি বেণী ঝুলিয়ে ফিরোজা জলে পা ডুবিয়ে  সেই কবে থেকে , হ্যাঁ তা প্রায় সাতশো আটশো বছর হবে , দুটিতে বসে লেস বুনছে আর কাঁচের জিনিশ বানাচ্ছে ! ভাবা যায় !   

 মুরানো আর বুরানো ঘুরে আসার কথা বলেছিল মিতিলা । মিতিলা  অ্যাড্রিয়াটিক সাগরে থাকে । অনেক অনেক গভীরে । মাঝে মাঝে  পথ ভুলে গ্র্যান্ড ক্যানালে হাবুডুবু খায় । ছলাত ছলাত জল ছিটিয়ে ভর সন্ধে বেলা যখন ভেনিসে নামলুম , কনকনে ঠান্ডা হাওয়া নাকের ডগা জমিয়ে দিল আর কানের পাশে শনশন করে বয়ে যেতে যেতে বলল, মিতিলা মিতিলা মিতিলা । সেই ডাক আমি আর অরো ছাড়া কেউ আর শুনতেই পেল না ।

মিতিলা আমাদের বুরানো আর মুরানো ঘুরে আসতে বলেছিল । ভেনিস থেকে ঘন্টা খানেক । সেন্ট মার্ক এর সামনেই সান্তা জাক্কারিয়া । সেখান থেকে  সব নৌকো , জল বাস , জল ট্যাক্সি ধরা যায় ।
আমরা ওকে  জিজ্ঞেস করলাম তোমার সঙ্গে কবে দেখা হবে ? মিতিলা মিলিয়ে যেতে যেতে বলেছিল , হবে হবে , শিগগিরি ।
মিতিলা র কথা মতো আমরা মুরানো আর বুরানো দেখতে বেরুলাম । মুরানোতে একটা কাঁচের ওয়ার্ক শপে বসেবসে কাঁচের শৌখিন জিনিস বানানোর কৌশল দেখলাম । লম্বা পাইপের  মুখে ফুঁ দিয়ে নানান রকমারি নকশা আর আকার তৈরি হচ্ছে ।
একটা পুরোনো সোঁদা বাড়ি । জলতরঙ্গের মতো ঠুং ঠুং বাজনা । মহার্ঘ শিল্প দ্রব্য আর সেই ফুঁ ভেলকি দিয়ে জিনিশ বানানো দেখছি । নানান রঙে চুবিয়ে আগুনে পুড়িয়ে  পুড়িয়ে ফুঁ এর পর ফুঁ দিয়ে  বানানো হোল একটি রঙিন টলটলে হৃদয় । তখনো গরম !এ যেন এক টুকরো মেভলানা  রুমি ,  I was raw , I was cooked , I was burnt পুড়ে পুড়ে  তবে হৃদয়টি খাঁটি হোল । হৃদয় টি আবার রঙে নাস্তানাবুদ ! রঙ যেন মোর মর্মে লাগে !  দেখতে ভারি সুন্দর ।  হৃদয়ের মূল্য অনেক । কোনো মানেই হয় না কেনার !  ঠুনকো হৃদয় । হাত থেকে পড়ে গেলেই ভেঙে যাবে । তার চেয়ে আমরা গাদাগুচ্ছের ময়দা আর চিজ দিয়ে ফাটাফাটি লাঞ্চ করবো । কী বল ?







লেসের জিনিশগুলো কী  চমৎকার দেখতে । সুন্দর সুন্দর পোশাক , টুপি , টেবিল ঢাকা ,  কত শৌখিন ,কত বাহারি । মেয়ে মহিলারা  বেশ আলাপি, বাড়ির ব্যাবসা চলেছে অনেক প্রজন্ম ধরে  চিনে জিনিশে ছেয়ে যাওয়া বাজারে এগুলো খাঁটি ইতালিয় । একসময় কাঁচ শিল্পের গুপ্তবিদ্যা বাইরে  নিয়ে যাওয়া যেত না । ব্যাবসার জন্য নানান দেশে মালপত্তর নিয়ে যাওয়া হতো  কোন কারগর নাকি গিল্ড বা স্থানীয় নিয়মানুযায়ী অন্য দেশে গিয়ে বসবাস করতে পারতো না । কিন্তু ঐ যে , রাঁধুনি সব বলবে কিন্তু একটা গুপ্তকথা থেকেই যাবে ।

রঙ বেরঙের বাড়ি , ঝিরঝিরে খাল , ছোট্ট ছোট্ট সাঁকো , গির্জা , লেস আর কাঁচের দোকান , এই নিয়েই মুরানো আর বুরানো  আমরা আস্তে আস্তে হাঁটছি । হঠাত দেখি ১১১ নম্বর বাড়ি ! আবার ১০১ নম্বর বাড়ি !  আশ্চর্য ব্যাপার ! প্রচন্ড কৌতূহল ছটফট করছে  !  কিন্তু কাকে জিগ্যেস করবো ?  সামনে একটা  বাঁধানো  খোলা চত্বর আর শুনশান গির্জা । এবং শুধু পিসার হেলানো মিনার নয় মালুম হচ্ছে ইতালির সব গির্জার চূড়া একটু হেলে পড়া । ভালোভাবে ওলন দড়ি ব্যাবহারই করেনি । কিন্তু হাল আমলের আমাদের কলকাতার   সেই ক্লক টাওয়ারও কিঞ্চিত হেলানো   । “ শ্যাম তুমি বাঁকা , বাঁকা তোমার মন” । আঙুর বালা গেয়েছিলেন গো !


এমন সময় দেখি একটা ছেলে,  ফিটফাট বাবু দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছে । আমরা অমনি সদলবলে গায়ে পড়ে , “হেঁ, হেঁ , এখানেই থাকেন বুঝি “ গোছের কথা দিয়ে ভাব জমানোর চেষ্টা করতে থাকলাম । কোন এক জিপসি বেদের মেয়ে জোসনা ,মুজতবা আলিকে বিদেশের কোন এক শহরে প্রায় জাপটে ধরে বলেছিল আমরা তো এক দেশের ! ইন্ডিয়ার । আমাদেরও দলের কোনো কোন সদস্য মনে করেছিল ঐ ১১১ এর গেরো থেকে না জানি কী রহস্য বের হয় আর রাতের খ্যাঁটন টা তাদের ঘাড়ে চেপে খেলেই হয় ! তা সে ফিটফাটও  বেশ আলাপি , সে বলল 

হ্যাঁ এটা “এক” সংখ্যা । ওহ তাই ? তোমরাও এভাবে এক লেখো ? তবে এটা এখন আর লেখেনা কেউ । এটা পুরোনো ,মানে বেশ পুরনো ,মানে আমার ঠাকুরদা বা তার বাবা এরম লিখতেন ।

তোমরা খুব হেরিটেজ বাঁচিয়ে চলো , না?

ঠিকই ধরেছ । এই যে বাড়িগুলো , খুব পুরোনো । জলটল লেগে হেজেমজে গেছে , নোনা ধরা ।  কিন্তু যে পরিবার যে রঙ ব্যাবহার করতো সেই রঙই লাগানো হয়ে আসছে । একেকটা রঙ একেকটা ফ্যামিলির ।

এতো ক্ষণে বুঝলাম এই রঙ মশালি শহরের রহস্য ।  

তা, যাতায়াত তো সবই ঐ জল বেয়ে বেয়েই করো , তাই তো ?
ফিটফাট বলল , হ্যাঁ , তাইতো । আমাদের তিনটে বোট আছে ।

তিনটে?

হ্যাঁ , একটা আমার , একটা বাড়ির,  আরেকটা গার্ল ফ্রেন্ডের । কোনো প্রবলেম নেই ।

ওকে টাটা ।
 আমরা এবার আমাদের অবস্থান বুঝে গেছি । কোনো বেদের মেয়ে জোসনা যখন বেরুলোই না , তাই খাবারের সন্ধানে বের হলাম । তারপর একটা দোকানে গিয়ে এক সুন্দরীকে বললাম এক লিখুন তো ! সে সরল মনে কোনো প্রশ্ন না করে ভুরু না কুঁচকে  ইংরেজি ওয়ান লিখলো । আমি বল্লুম , না না আরেকটা এক আছে আপনাদের । সে বলল ওঃ , সে তো কেউ লেখেনা এখন । সে টা খুউউব পুরোনো ।
মনে একটা খটকা রয়ে গেলো কিন্তু ফিটফাটের তথ্য যাচাই করে নিলুম এই বেলা ।












জলের ধারে একটা বাড়ির গায়ে মস্ত বড় একখানা ইংরেজি এস লেখা । সেই মারকো পোলোর আমল থেকে বোধহয় । জলের ধারে বাড়ি , জলের দামে কিনে নিতে পারি কিনা জম্পেশ করে ভাবছি । ভাবছি  হেজেলনাট আর সিনামন কফি আর কুড়কুড়ে স্কুইড ভাজা, দারুণ চলবে দোকান।। অমনি  আমার দলের বেয়াক্কেলে লোকজনেরা “এই জল বাস ( ওয়াটার বাস) এসে গেছে , এর পরের টা অনেক দেরি । “ । দৌড় দৌড় দৌড় ।






বুরানো চোখের বাইরে চলে যাচ্ছে । একটা নাবিক জেলে, সেই কবে কে জানে বিয়ের ঠিক আগে আগে  মাঝদরিয়ায় গেলো । তার হবু বউ এর মুখ খানা মনে পড়ে । হঠাৎ  উথালিপাথালি ঢেউ এর মধ্যে রাঙা  আলো মাখা জলে ভুস করে মাথা তোলে এক মৎস্যকন্যা। ইনিয়েবিনিয়ে প্রেম নিবেদন করে । জেলে প্রেমিক টি তাতে একটুকুও গলে গেলো না । তার চোখ জুড়ে হবু বউ এর মুখ খানা তারার মতো জ্বলে । মৎস্য কন্যা খুব আশ্চর্য হয় আবার খুশিও । উপহার হিশেবে তার লেজের ঘূর্ণি তুলে সমুদ্রের ফেনা জমিয়ে জমিয়ে একটা অদ্ভুত ফুরফুরে নকশা সে জেলেটির হাতে তুলে দিয়ে ভুস করে ডুবে যায় ।
সেই ভেজা নকশা রোদ্দুরের তাপে  , মিঠে হাওয়ায়  আস্তে আস্তে শুকিয়ে ওঠে ।  জেলে নাবিক বাড়ি ফিরে সেই ফেনা জমা নকশা বউ এর হাতে তুলে দেয় । সেই মেয়েটি ভারি অবাক হয়ে যায় ! এতো সুন্দর একটা জিনিশ ।
এর নাম কী ?
মৎস্যকন্যার লেজ , জেলে উত্তর দেয় ।  
 সুতো দিয়ে  সেই মেয়েটি  নকশা বুনতে শুরু করে । বুরানোর লোকগাথা । সেই লেস যা ইওরোপের ফ্যাশান আর স্ট্যাটাস সিম্বল ছিল এককালে ।
এই গল্প শোনার পর আমি বুঝলাম কেন মিতিলা আমাদের বুরানো মুরানো দেখতে বলেছিল এতো করে । ভেনিসে নামলাম সন্ধের মুখে ।সান্তা জাক্কারিয়া । দোকান থেকে কিনবো অনেক কিছু । তারপর কাশীর গলি বা উত্তর কলকাতার গলির গলি তস্য গলি দিয়ে বাড়ি ফিরব । আর মিতিলা ? সে তখন অ্যাড্রিয়াটিকের গভীরে ট্রিনা ডেলে সাইরেন বানাচ্ছে , লেজের ঝাপট দিয়ে ।







No comments:

Post a Comment