Tuesday 19 March 2019

Nondano Soprano sojourn


Switzerland : Interlaken : Thun Lake:

জারবাইজানের বাকুতে নন্দানো একটা ন’তলা বাড়ির সাত তলায় পুবমুখো ফ্ল্যাটে থাকতো । আর ঠিক তার দুটো তলা নিচে থাকতো আমার আরেক বন্ধু ফারিদা । অবশ্য ফারিদা আমাকে মাঝে মাঝেই মুচকি হেসে বলতো যেমন তুমি সবজি sauté করো , আমার নাম টাও কিন্তু তেমনি ,ফারিদে । বাড়ি ছেড়ে আসা ইস্তক নন্দানো বেশ মনমরা হয়ে থাকতো , আমিই ফারিদার সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দি । ফারিদাদের ওই ন’ তলার বাড়ির সামনে প্রত্যেক শনিবার একটা হুলুস্থুল লেগে যেত । একটা টালটোল খাওয়া সোভিয়েত রাশিয়ার বানানো জিগুলি , অনেকটা আমাদের দেশের ফিয়াটের মতো, এসে হাজির হতো।

আর তার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতেন এক মহিলা , বয়স ষাট পেরিয়েছে । কিন্তু খুব চনমনে । তিনি ঘটাং করে গাড়ির ডিঁকি খুলে দড়াম করে একটা বড় ট্রাঙ্ক মাটিতে নামাতেন । নিজেই । তারপর খটাং করে ট্রাঙ্কের ঢাকা খুলে ছাড়তেন একখানা ফলসেটো “সুদ ভার , গাটিইইইইইইইগ “ ( দুধ , দইইইইইইই)। দই দই ভালো দই ।

ফারিদারা ওনাকে আদর করে দইওয়ালি না বলে , সুদ সাতান খালা ( দই বেচা মাসি ) বলে ডাকতো ।
আজেরি তুর্ক ভাষায় গাতিগ মানে দই ,সুদ মানে দুধ ,আর তুর্কি ভাষায় সু মানে জল । মানে ওই দুধে জল মেশানোর ব্যাপারটা ভাষা গত ভাবেই জড়িয়ে সাপটে আছে । তা , দই মাসির হাঁক শুনে ফ্ল্যাট বাড়ির সব লোকজন নানান সাইজের পাত্র নিয়ে টাটকা দই নিতে আসতো । ফারিদাও আসতো । তারপর আবার দর দস্তুর চলতো । বড্ড বেশি বলছো , আরেকটু দাম কমাও । এইসব যখন শুরু হতো তখন দইমাসি রুটির দিব্যি ( আজারবাইজানিরা ঠাকুর দেবতা বাপ মা নয়, রুটির দিব্যি দেয়) দিয়ে মাথা নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলতো “আমার দই এক্কেবারে নিজের হাতে বাড়িতে বানানো , কোনো রকমের বাইরের জিনিশ মেশানো হয় না। । দাম মোটেই বে শি নিচ্ছি না, বাপু “ । তারপর দামটাম চুকিয়ে ফরিদারা সবাই সেই ঘন জমাট দই নিয়ে যে যার বাড়ি ঢুকে যেত । সেই দই এরও তেল চুকচুকে ক্রিমের মতো ফুটিফুটি একটা মাথা থাকতো , দই এর মাথা । ফারিদা আবার সেটা খেতে খুব ভালোবাসতো ।
দোভঘা আর আইরান না হলে আজেরিদের ভাত হজম হবে না । এবং তা বানাতে দই লাগবেই ।

নন্দানো প্রথমটায় অত দই ভালো বাসতো না । বিশেষ করে টক দই । কিন্তু ফারিদার সঙ্গে মিশে মিশে ও আস্তে আস্তে দই মাহাত্ম্য বুঝতে শিখল ।
এত ক্ষণ ধরে দই দই করছি কেন তাই বলছি ধীরে ধীরে । সেবারে আমি আর নন্দানো ইন্টারলাকেনে গেছি । কার যেন একটা চিলেকোঠার ঘরে আমাদের দয়া করে থাকতে দেওয়া হয়েছে । ভেতরটা বাপু ভালোই , গরমটরমের ব্যাবস্থা আছে । খাওয়া দাওয়া নিজেদের । ঘর টা যে পাওয়া গেছে , সেই বা কম কি । কিন্তু সকাল থেকে বরফ পড়ছে । আমাদের সে কী মন খারাপ !
বাইরে বেরুতে পাচ্ছি না । রোদ ওঠে নি মোটে । নন্দানো বলল , সোপ্রানো ঘরে শুধু দই , বেগুন আর চিকেন কিমা পড়ে আছে । আরে দুচ্ছাই ! রোদের দেখা মিলছে না । স্লেটের মত ছাইছাই আকাশ । হলই বা সুইটজারল্যান্ড । দই এর নিকুচি করেছে । বললে বিশ্বাস করবেন না । এরপর একটা ঘটনা ঘটলো । এই ইন্টারলাকেনের আশেপাশেই দিলওয়ালে দুলহানিয়ার শুটিং হয়েছিল । আর সেই ফিলিমে ,মানে সব সুপারহিট সিনিমার মতো কিছু তোলপাড় করা ডায়ালগ ছিল।




অগর ইয়ে তুঝে পেয়ার করতি হ্যাঁয় তো ইয়ে পলট কর দেখেগি...পলট...পলট “ ,আর সিমরনও ট্রেনে ওঠার আগে পলট ...পলট । ঠিক সেই ভাবে বিবস্বান বসু পলট করে আলো খেলিয়ে দিলেন । বরফের ওপর ঝিকঝিকিয়ে উঠল ভালোবাসার আলো । আর নন্দানো , চল সোপ্রানো বেরিয়ে পড়ি, বলেই চশমা মুছতে লাগল ।
নন্দানো , বাইরে খাওয়া যাবে না কিন্তু । রেস্ত নেই । কি করা যায় ?
খুব চটপট আমরা বেগুনগুলোকে ছাল ছাড়িয়ে টুকরো করে ভেজে হালকা পিটিয়ে দিলাম । ঘন থকথকে দই এ মিশিয়ে দিলাম রসুন কুচি ভাজা আর কিমাটাকেও একটু ফারিদের মতো করে sauté করে টিপিনকারিতে পুরে “ যা সিমরন যা ,জি লে অপনি জিন্দাগি “, ওই সিনিমাটার আরেকটা ডায়ালগ হয়ে স্রেফ হাওয়া হয়ে গেলুম মাউন্ট টিটলিস ।
আমরা কেবল কারে করে ধীরে ধীরে ওপরে উঠছি । বাড়িগুলো ছোট্ট ছোট্ট খেলনার মতো দেখাচ্ছে । টিটলিসের ওপরে কী ঠান্ডা । শনশন করে হাওয়া । মাথার টুপি প্রায় উড়ে যায় । এর হাইট দশ হাজার ফিটেরও বেশি । কিন্তু আমাদের তখন দারুণ ফুর্তি । চারদিকে আল্পসের ভ্যানিলা আইসক্রিমের ফ্যাক্টরি । একটু চকোলেট সস হলেই হয় ।

জরা সা ঝুম লু ম্যায় /আরে নারে নারে না/জরা সা ঘুম লু ম্যায়/ আরে নারে নারে না।/ ম্যায় চলি বনকে হাওয়া...”। আমরা তখন হাওয়া হয়ে গেছি ।
বাতাসে ঘুরে ঘুরে পাক খেয়ে এসে পড়েছি থুন লেকের ধারে । এবারে আমরা খাবো । বাড়িতে বানানো সেই স্ম্যাশড এগপ্ল্যান্ট উইথ চিকেন কিমা অ্যান্ড গারলিক ইয়োগারট । দই কিমা বেগুনের ঘ্যাঁট বললে চলবে না বস !
থুন লেক !
  



নীল কপোতাক্ষ । টলটলে । আলপাইন বন । সুইশ আল্পসের মাথায় বরফ জমে আছে । নির্ভেজাল সুন্দরী । সে সুন্দরী বসেছিল নন্দানো সোপ্রানোর জন্য । আমরা ব্যাগ মাটিতে ফেলে দৌড়ে তার কাছে চলে গেলাম । ছবিতে দুটো ব্যাগ দেখা যাচ্ছে । ধুমসোটা আমার , ওর মধ্যে ওই ঘ্যাঁট থুড়ি স্ম্যাশড ইত্যাদি আছে । আমরা চুপ করে বলে থাকলাম । ছোট্ট ছোট্ট ঢেউ উঠছে জলে । মৃদু বাতাসে তিরতির করে সেই জল কাঁপছে । স্বর্গের হাঁসেরা মা সরস্বতীর কাছ থেকে ছুটি নিয়ে দু দন্ড খেলে বেড়াচ্ছে । আমরা কথা ভুলে গেছি । খাওয়া ভুলে গেছি ।

নন্দানো স্প্যানিশ ভাষায় কী ভাবছে জানিনা । আমার ভেতর ছেঁচে উঠে আসছে “ তোমার খোলা হাওয়া লাগিয়ে পালে টুকরো করে কাছি ,আমি ডুবতে রাজি আছি , আমি ডুবতে রাজি আছি ...”







একবার আমি আর নন্দানো হায়দ্রাবাদে ঘুরছিলাম । না, না শশধরবাবুকে সেদিন আর ডাকিনি । নন্দানো বার বার বলছিল , সোপ্রানো, আমি এখানে আইস্ক্রিম খেয়েছিলাম,ওপরটা মুচমুচে ক্রিস্পি আর ঠোকা মারলেই ঠান্ডা আইস্ক্রিম বেরিয়ে আসছে । চল সেটা খাই । কিন্তু নিজামদের শহর ছাপ্পা ছাপ্পা ঘুরেও সে আইস্ক্রিম দেখতে পেলুম না । কিন্তু একটা অদ্ভুত আইস্ক্রিম আমাদের জন্য অপেক্ষা করে বসেছিল । ম্যাসকটি আইস্ক্রিম । ম্যাসকটে এই আইস্ক্রিম পাওয়া যায় কি না, জানিনা বাপু। দু ধরনের আইস্ক্রিম নিয়ে পিটিয়ে পিটিয়ে , আজ্ঞে হ্যাঁ , পিটিয়ে পিটিয়ে একটামিশ্রণ বানিয়ে বেশ একখানা ছড়ানো ফুলের মতো বিস্কুটের কাপে ঢেলে খেতে দেয় । এই পিটিয়ে বানানোর রহস্যটা সত্যি এখনো ধরতে পারিনি । তবে আমার ঐ বুদাপেস্টের সোপ্রানি কফিশপে চিমনি কেক আইস্ক্রিম রাখছি আজকাল । খোলটা গরম মুচমুচে গুঁড়ো চিনিলাগানো রুটি ,পাতলা পাতলা ,আর ভেতরে উমম মম আইস্ক্রিম । দেখুন দেখুন ছবি দেখুন। কফিশপ থেকে বুদাপেস্টের ছবি । আর ছবি দেখতে দেখতে চিমনি আইস্ক্রিম। বুদাপেস্ট গেলে আমার দোকানে যাবেন কিন্তু।










এই প্যাঁচালো রাস্তাটা আরো দুবার পাক খেয়ে যেখানে শেষ হয়েছে সেখানে নন্দানোর বাড়ি । নন্দানো আগে স্প্যানিশ ছাড়া কোনো ভাষাই ভালো করে বলতে পারতো না । এখন ইংরেজি আর একটু একটু বাংলা বলে । তাছাড়া ও নাইরোবিতে জন্মেছিল আর সোয়াহিলি আয়ার কাছে মানুষ । সোয়াহিলি ভাষায় বাবাকে বলে বাবা ,তুর্কিদের মতোই, কি আশ্চর্য! মা কে মামা আর ফুল কে উয়া । নন্দানো সেগুলো আগেই শিখেছিল । তারপর অবিশ্যি রিকি মারটিনের মারিয়ার ভাষা উন দোস ত্রেস ,ওটাই ওর প্রধান ভাষা হয়ে দাঁড়ায় । আর সেই কারণেই আমাকে প্রথম থেকেই ও সোপ্রানো বলেই ডাকে , মানে ওতে ওর উচ্চারণের সুবিধে হয় আর কি! সোপ্রানোর সঙ্গে গানের একটা নিবিড় সম্পর্ক আছে । তাই আমার ভালই লাগে । নইলে নিজের নামকে বিকৃত করতে কেই বা চায় !

যা বলছিলাম , ওই রাস্তাটা শেষ হয়েছে জঙ্গলের ধারে , সেখানে দূর থেকে নীল পাহাড় দেখা যায় । প্রচুর সাদা কাকাতুয়া গাছে গাছে বসে থাকে । সব চেয়ে বড় কথা ওখানে নন্দানোর অনেক প্রতিবেশী থাকে । তারা মাঠে বাস্কেট বল খেলে , ফ্যামিলি নিয়ে ঘোরাঘুরি করে , লুকিয়ে প্রেমট্রেম করে , উদাসীন ভাবে বসে পদ্যটদ্যও লেখে কেউ কেউ । রেগে গেলে তক্কাতক্কি তো বটেই হাতাহাতিও হয় । মানুষকে বিশেষ পাত্তা দেয় না । মানুষরাই বরং একটু সমঝে চলে ওদের । সেবারে ওর বাড়িতে গেছিলাম । ঝিলের ধারে বসে লাঞ্চ করেছিলাম । আর হেমন্তের অরণ্যে প্রচুর ক্যাঙ্গারু দেখেছিলাম । নন্দানো বানিয়েছিল চিকেন পেরিপেরি । বেশ ঝালঝাল । নন্দর(Nando) রেসিপি । নন্দর টাইটেল ঘোষ কি না জানিনা তবে এদেশেও তার দোকান খুলেছে । কনট প্লেসে দিল্লিতে । তবে ওই পিরিপিরি ,বিটকেল ঝাল আফ্রিকান লংকার সস দিয়ে ঝলসানো চিকেন , রসুন মাখন টোস্ট আর ব্ল্যাক ফরেস্ট পেস্ট্রি আমরা সেদিন ব্লু মাউন্টেনের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খেলুম । সব বাড়িতে বানানো । আর চারধারে ক্যাঙ্গারুরা খেলা করছিল । আমাদের খাওয়াও শেষ হোল আর বাপ মা বাচ্চার একটা ছোট্ট সুখি পরিবার রাস্তা পেরিয়ে জঙ্গলে চলে গেল ।



A Nandano Soprano endeavour to discover Bong link in the ruins of Pompeii ,

রোমের চারদিকে গিজগিজে বাঙালি । আরে বাঙাল , কাঠ বাঙাল । আমি আর নন্দানো দুজনেই বরিশালের। কিন্তু নন্দানো তো জন্মেছে আফ্রিকায় , বাংলার বদলে সোয়াহিলি ভাষায় ওর কথা বলা শুরু ।প্রথমে বলতে শিখেছিল মাজি । মা নয়, মাইজি নয়। মাজি মানে জল । তারপর স্প্যানিশ ভাষা , যেটা তে ও সবচেয়ে স্বচ্ছন্দ । এই হালে একটু বাংলা বলতে পারে ।
আমরা এতো বাংলা শুনছি রোমে যে আর বলার নয় । রোম থেকে আড়াইঘন্টার পথ পম্পেই তে গিয়ে আমরা সেই লাভায় পুড়ে যাওয়া মৃত শহরে খানিকটা বেবাকের মতো ঘুরছিলাম ।নন্দানো বলল সোপ্রানো , দেখ দেখ চারদিকে কত কিছু লেখা । আগুনে পুড়ে গেছে সব, অক্ষর পোড়ে নি ।
অক্ষর ব্রহ্ম । চারদিকে লাটিন ভাষায় লেখা গ্রাফিতি । শ্লীল অশ্লীল , চুটকি , মজাদার কৌতুক , রাজনীতি কী নেই । কে বলবে মৃত নগরী । হাজার হাজার সাধারণমানুষের গলা কে ভিসুভিয়াসের গলন্ত লাভা গিলতে পারেনি । নন্দানো বলে, কলকাতার পাড়াগুলোর মতন না ? চারদিকে খালি লেখা আর লেখা ।
পম্পেই তে সর্বত্র গ্রাফিতি, । একটা গ্রাফিতির সামনে আমরা নীরবতা পালনের মতো দাঁড়িয়ে গেলাম।

“দেওয়াল , আমি আশ্চর্য হচ্ছি এই ভেবে যে এই বোকা বুদ্ধুদের লেখার ভারে তুমি এখনো কেন ভেঙে পড়ছো না ?”



ছবিছাবা ঃ লেখক

দেয়ালের রঙ ঘন নীল। তার সামনে  কমলালেবুর ঢিপি ।  সেই  লেবু থেকে টাটকা  কটকটে কমলা রস বড় একটা কাঁচের জারে জমা হচ্ছে আর সেখান থেকে  উঁচু করে ঢালা হচ্ছে  দুটো বড় গেলাসে । আমাদের  সামনে দুটো জমাট রঙ , ঘন নীল আর ঘন কমলা । পায়ের ফাঁকে ঘুরঘুর করছে দু তিনটে সাদা কালো পাঁশুটে বেড়াল । নীল আকাশে গোলাপি ছোপ । বিকেল গড়াচ্ছে । পাশেই মাটির চুলায় গনগনে আগুন । পোড়া মাটির টাজিনে চিড়বিড় করে ফুটছে কুমড়ো বিচি । বাদাম পোড়া গন্ধ ।  মাঝে মাঝে ফটাস ফটাস করে ফেটে উঠছে ।  আজ নীল মুক্তোর দেশে আমাদের শেষ দিন । নন্দানোর ঝুরো চুলে হালকা রোদ্দুর । মুখে হালকা চিন্তা । কমলালেবুর রসে চুমুক দিয়ে খুব আস্তে আস্তে বলল

 “ আচ্ছা সোপ্রানো , আমি কি সত্যি সত্যি যাবো ? “

“ হ্যাঁ , যাবি না কেন ? বারবার তো এখানে আসা হবে না “?
“না, তা হবে না । কিন্তু ...”

যারা নন্দানোকে জানে তারা  বেশক জানে সে কতটা ভালো ! এতো ভালো বোধহয় হতে নেই । সেবারে কী একটা কাজে আমি আর নন্দানো হায়দ্রাবাদ গেছিলাম । ওমা ! দেখি কী বিপদ!  শশধরবাবুও ঝোলাঝুলি খাতা কলম  নিয়ে হাজির ! তা আমরা তিনজনেই সকালবেলা খাবার ঘরে যাচ্ছি । শশধরবাবুর যা স্বভাব , তিনি ঘোষণা করতে করতে চললেন “আমি বাটার টোস্ট খাবো , হালকা খাওয়াই ভালো , বাটার টোস্ট , ডিমের কুসুমটা খাবো না । সাদাটা খাবো “। খাবি তো খাবি , এতো ঘোষণা করার কী ই বা দরকার । আমারও রোখ চেপে গেলো , বল্লুম আমি ইডলি খাবো । ওটাও হালকা ।

অমনি শশধরবাবু কী একটা কমেন্ট করে বসলেন । ঝগড়া প্রায় লাগে লাগে । নারদ নারদ । কিন্তু ডাইনিং হল  এসে  গেলো । আর  ঝগড়া  করা হোল না । আমরা তিনজনে একসঙ্গেই খেতে বসলাম । নন্দানো কিন্তু কোনো কথা বলে নি এতো ক্ষণ । আমি ওর প্লেটের দিকে তাকালাম , দেখলাম একটা বাটার টোস্ট আর একটা ইডলি । আমার তো খাওয়া প্রায় বন্ধ । সমঝোতা র এমন নীরব অথচ ভয়ানক সরব প্রমাণ দেখে শশধর বাবুও কিঞ্চিত লজ্জিত ।

সেই ভালো মানুষ নন্দানো ফিসফিস করে বলে উঠলো “ এসে গেছে, দ্যাখ”। আমরা তো একটু উঁচু জায়গায় বসে ছিলুম , দেখলাম টুকটুক করে দুজন মহিলা জোব্বাজাব্বা পরে ওপরে উঠে আসছে । আসলে আমরা মাত্র দুদিন আগে ট্যাঞ্জিয়ের থেকে শেফশাউহেন এসেছি ।  কালকেই  আমরা মরক্কো ছাড়ছি ।

শেফশাউহেন শহরটা কে যেন কেউ রবিন ব্লু এ ডুবিয়ে দিয়েছে । আকাশের নীল সমুদ্রের নীল আর নীলরঙা শহর  একেবারে মস্ত কলন্দর করে মারছে আমাদের । নীলের আবার কত রকম শেড । পুরোনো শহর  বা মেদিনা , আর তার গলিঘুঁজি, নকশা কাটা টাইলস । আমাদের চারদিকে আয়েসের আরব্য রজনী । মুর , আরব  আর স্পেন থেকে পালিয়ে আসা ইহুদি এখানে আস্তানা গেড়ে বসেছিল । শহরের এই ঘোরতর নীলিমাপ্রীতির সঠিক কারণ কেউ ই বলতে পারে না । কেউ বলে মশা তাড়াবার জন্য নীল রঙ খুব যুতসই । আমাদের দেশে এখোনো অনেক বাড়ির দরজায় নীল রঙের বোতল ঝুলিয়ে রাখে রাস্তার কুকুর তাড়াবার জন্য !

এতো খাশ খবরে সময় নষ্ট না করে আমরা এখানকার খাশ খাবারে  খোশ মেজাজে কবজি ডুবিয়েছিলাম । চিজ স্যালাড ।ছাগলের দুধের চিজ তাতে কিশমিশ আর আমন্ড বাদাম  । সব মেদিনা গুলোতে কয়েকটা কমন ব্যাপার থাকবেই , যেমন একটা বাজার বা সুক , মাদ্রাসা , মসজিদ , কমিউনিটি তন্দুর , পাঞ্জাবে যাকে বলে সাঞ্ঝা চুলা ,  মেয়েরা এই সাঁঝ  বিকেল বেলা বেশ খানিকটা আটা ময়দা বাজরা রাগি জোয়ার , দই মিশিয়ে পুদিনা কুচি কালো সাদা তিল দিয়েঠেসে মেখে লেচি বানিয়ে দুই হাতে চেপেচুপে রুটি গড়ে তন্দুরের গায়ে লাগিয়ে  দিয়ে গাল  গল্প করে , মাথার ওপর ঘন নীল আকাশে হিরের কুচির মতো তারা ফোটে তখন । আর যে ব্যাপারটা প্রতিটি জায়গায় থাকে তাকে  বলে হাম্মাম ।

কমিউনিটি হাম্মাম । মেয়ে পুরুষদের আলাদাসময় ।  এই হাম্মাম আর সাঞ্ঝা চুলা হোল পাক্কা গসিপ করার জায়গা ।

কাল আমি হাম্মামে গেছিলাম আর নন্দানো তখন একটা নীল রঙা সিঁড়ির ওপর তিনটে পাঁশুটে বেড়ালের সঙ্গে বসেছিল । কিছুতেই ভেতরে  ঢুকলো না । পরে আমি বললাম , বারবার তো আমরা শেফশাউহানে আসবো না , নন্দানো । একবার ঘুরেই আসিস বরং । যে কথাটা চেপে গেলাম সেটা হোল হাম্মামের ওই জোব্বা মহিলাদের আড়ং ধোলাই । আমি  যেন ওদের হাতে একটা ময়লা কার্পেট । দুরমুশ দুরমুশ দুরমুশ । না, নন্দানো কে ধরে পেটানো হোক সেটা আমি কখনোই চাইনি । এরমধ্যে ওই দুই জোব্বা আমাদের কাছে এসে গেছে , থলের ভেতর হাত বের করে আনছে আইসক্রিমের  স্কুপের মতো অলিভ ওয়েলে তুপতুপে সাভোন বেলদি ,গায়ে মাখার বদলে মুখে পুরে দিতে ইচ্ছে করে , থলে থেকে আরো বেরুলো লাভা মেশানো ধুনোর টুকরোর মতো ঘাসুল । ওটা আসলে শ্যাম্পু । ঘাসুলের চেহারা দেখে নন্দানো একটু ঘাবড়ে গেলো । জোব্বা রমণী রা স্প্যানিশ ফ্রেঞ্চ আরাবিকের  একটা চ্যবনপ্রাশ তৈরি করে হেসে হেসে  নন্দানোকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে গেলো । স্প্যানিশ বললে নন্দানোর সুবিধেই হয় ।  আমি সন্ধে নামা পাহাড়টিলায় কুমড়োর বিচি ভাজা খেতে লাগলুম । নন্দানো বেশ কিছুক্ষণ পরে হাসি হাসি মুখে একটা সাদাকালো বেড়ালকে ঘাড়ে ঝুলিয়ে এসে পাশে বসলো ।

“বুঝলি সোপ্রানো , গিয়ে বেশ ভালোই লাগলো , যত খিটকেল ব্যথা ছিল এখন আর বুঝতেই পারছি না যে সেগুলো  কোনোদিন ছিল । আর ঘাসুলটা মোটেই  ইটের টুকরো মতো নয়রে , বেশ মোলায়েম হয়ে যায় , দ্যাখ চুলগুলো কী রকম ফুরফুরে হয়ে গেছে ।"

আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করে উঠতে পারলাম না ওকে কার্পেট না বেড কভারের  না চাদরের মতো কেচেছিল

শুধু হাঁফ ছেড়ে বললাম , যাক 




আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিলো নিক । ভালোই বয়স হয়েছে । গ্রিসের লোক । মোটা সোটা ।  আমুদে ।

নিজের দেশ ছেড়ে এতো দূরে ? কবে এসেছো এখানে ?

বৃষ্টি আর আর ভিজে হাওয়া আছড়ে পড়ছে গাড়ির কাঁচে । ওয়াইপার চলছে ঘনঘন । পেরিয়ে যাচ্ছি একেকটা স্বপ্নের মতো বাঁক । পাশে পাশে কোঁকড়া চুলের দামাল জলরাশি উড়িয়ে আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে এক স্বর্গীয় সুপুরুষ । কখনো তার কাঁধ থেকে পিছলে পড়ছে মেঘ ছেঁড়া মাখন নরম রোদ্দুর । আমাদের থেকে দ্রুত তার গতি । আমাদের থেকে আগে পৌঁছনো তার জেদ । তার পেশল বাহু আর  লম্বা আঙুল । মধ্যমায় ফিরোজা রঙের আংটি ।

“ডিপ্রেশন “

“হ্যাঁ ডিপ্রেশন তো বটেই । এই মেঘ বৃষ্টি আর এবেলা ছাড়বে না ।“

“নো , আয়াম টকিং অ্যা বাউট  দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন অফ ইওরোপ, যা আমাকে ঘরছাড়া করেছিলো  । তিরিশের মন্দা । অর্থনীতি ধসে পড়েছিল । কাজ ছিল না। খাবার ছিল না । কতই বা  বয়স আমার তখন , আঠেরো হবে । কাজের খোঁজে ঘর ছাড়তে হলো । দলে দলে লোক ইওরোপ ছেড়ে বেরিয়ে পড়লো । আমিও সেই দলে ছিলুম । সেই থেকে অস্ট্রেলিয়ায় , এই মেলবোর্নে । “

তিরিশের মন্দাতে ব্রিটিশ ভারতের অর্থনীতিও বেজায় মার খেয়েছিল ।   মুনাফা লোটার জন্য দেশের চাষিদের দিয়ে ক্যাশ ক্রপ ফলানো হতো, খাদ্যশস্য নয় । বাজার অর্থনীতি ভেঙে পড়লে সেই বানিজ্য শস্য মুখ থুবড়ে পড়েছিল , দেশে সেই সব কেনার লোক ছিল না অথচ খাবার নেই ।

কোথায় ছিলো তোমার  বাড়ি , নিক ?  

একটা বড় পাহাড় ঘুরে নিক তেরছা করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে বলল , এখানে নামতে পারো । খুব ভালো ভিউ পাবে ।




ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টি । নেমে দাঁড়িয়ে দেখলাম , সমুদ্র ফেনার মতো চুল গুলো ঝুঁটি করে বেঁধে সেই স্বর্গীয় সুপুরুষ সাঁ করে বেরিয়ে গেলো , যাবার আগে একটা তেরছা চোরা চাউনি দিতে ভুললো না , দেখলাম ।

গাড়ির দরজা বন্ধ করতে করেতে নিক বলল , 
“আমার বাড়ি লেসবস দ্বীপে , ভারি সুন্দর জায়গা । ওহ  তুমি ভাবতে পারবে না ।এতো সুন্দর! প্রেমের দেবতা অ্যাফ্রোদিতির দেশ । ইজিয়ন সমুদ্রের ধারে “।

এই বলে নিক একটু মুচকি হাসল । বলল , “লেসবিয়ান কথাটা ওই লেসবস দ্বীপ থেকে ই এসেছে । জানোতো !”

আমিও হাবুলচন্দ্রের মতো বলে উঠলাম,  হ্যাঁ হ্যাঁ ওই বোহেমিয়া থেকে যেমন বোহেমিয়ান এসেছে । সে রকম , তাইতো ?  এই আমি যেমন বোহেমিয়ান । আমাদের স্টাইলকে বলে বোহো স্টাইল । হি হি হি ।
আমরা তো সেই সকালে মেলবোর্ন থেকে গ্রেট ওশন রোড ধরে চলেছি । প্রায় ২৮০ কিলোমিটার । চার ঘন্টা তো লাগবেই গন্তব্যে পৌঁছুতে । তবে মুসাফিরদের তো পথেই আনন্দ । রাহ গুজর ।  রাস্তায় এক জায়গায় কফি খেয়েছি । ফিশ অ্যান্ড চিপস খেয়েছি । ভদ্রতা করে  নিক ই আমাদের কফি খাইয়েছে ।  সেখানে বড় বড় সাদা কাকাতুয়া নন্দানোর হাতে বসেছিল ।  বৃষ্টি মাখা বাতাসে নন্দানোর নাক সুড়সুড় করছিল , চোখ ছলছল করছিল । ধরা গলায় নন্দানো আস্তে আস্তে বলল, সোপ্রানো তুই যে অর্থে বোহেমিয়ান বলছিস সেটা কিন্তু  ফ্রেঞ্চ শব্দ “

যাক , নিক কিছু বুঝতে পারে নি  কারণ নন্দানো বাংলায় বলেছিল   এখন ভালোই বাংলা বলে  

নিক বলল ,”স্যাপফো আমাদের দেশের কবি । স্যাপফো একজন মেয়ে , জানোতো ?  প্রেমের কবি । দুই নারীর মধ্যে যে ভালোবাসা হয়, তার কবি । সে অনেক কাল আগের কথা  । ক্রাইস্টের ও আগে । “
আমি হাঁ করে কথা গুলো শুনি । ঝোড়ো বাতাসে এলোমেলো উড়ছে  লেসবস , স্যাপফো ,আফ্রোদিতি,  দুই নারীর প্রেম।  

নিক বলে চলে “দেশছাড়া তো বহুদিন । তোমরা নতুন করে সব  মনে পড়িয়ে দিলে । এই স্যাপফো মেয়েদের নিয়ে তাদের সৌন্দর্য নিয়ে তাদের প্রেম নিয়ে , ব্যাথা নিয়ে লিখে গেছেন । খুব বেশি লেখা উদ্ধার করা যায় নি । মেয়েদের ভালোবাসতেন তিনি ।  

ঘন সবুজ রেইন ফরেস্ট । পাতা থেকে মুক্তোর মতো ঝুলে আছে জলবিন্দু । পথের পাশে ফুলগাছের নিচে নিঃসঙ্গ সমাধি , একাকী লাইট হাউস । স্যাপফো কি এরকম একাকী ছিলেন?

নিক বলল একটু পরেই  আমরা নামব । রেডি হয়ে নাও ।

আমরা নামলান । হু হু করে বাতাস উড়িয়ে নিচ্ছে চুল ।  প্রায় দাঁড়াতেই পারছিলাম না ।
দিগন্ত বিস্তারি নিঃসীম জলরাশির মধ্যে ধ্যানমগ্ন বারো সন্তের পাথর । টুয়েলভ আপোস্টলস  অফ ক্রাইস্ট  স্থবির প্রার্থনা । লাইমস্টোনে অবিরাম বাতাস ঘর্ষণে বারোটি প্রাকৃতিক ভাস্কর্য । এ দৃশ্য অপার্থিব ।  উত্তাল জলরাশি  কেবল উথাল পাথাল ।  জানা গেলো দু তিনটে  ভক্তর সলিল সমাধি হয়েছে ।





সমুদ্র ফেনার মতো উদ্দাম চুল গুলো বাঁ হাত দিয়ে মুঠি করে  ধরে আয়ত নীল চোখ তুলে সেই স্বর্গীয় সুপুরুষ ,সারা রাস্তা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে আসা সেই  পেশল প্রশান্ত মহাসাগর ডান হাত দিয়ে আমার হাতের তালুতে এক মুঠি বরফ কুচি রাখল ।  আর শনশন করে বয়ে চলে গেলো মুহূর্তের মধ্যে , কাঁধ থেকে পিছলে পড়ছে মাখন রঙা রোদ। তবে  যাবার আগে সেই তেরছা চোরা চাউনি দিতে ভুলল না ।

আমার হৃদপিণ্ড যেন বন্ধ হয়ে আসবে । আমি নন্দানোর হাতে সেই বরফ কুচি তুলে দিই , নন্দানোর হাতে সেই বিন্দু বিন্দু জলে মেঘ কাটা রোদ্দুরের সাত রঙ ঝিলকিয়ে ওঠে  । সেই রঙ মাখা জলবিন্দু থেকে উড়ে গেলো স্যাপফোর কবিতা  ারো সন্তের মাথা ছুঁয়ে দিগন্তরেখায়  বিলীন । আমাদের জন্য সেই স্বর্গীয় প্রেমিকের উপহার ।

O soft and dainty maiden, from afar
I watch you, as amidst the flowers you move,
And pluck them, singing.

More golden than all gold your tresses are:
Never was harp-note like your voice, my love,
Your voice sweet-ringing. 
Sappho with her friends listening to poetry from a poet 

Australia Photo : Suparna 





No comments:

Post a Comment