Monday, 11 March 2019

পূর্ণমিদং



নয়না চলে যাবে আজ ওর ফেয়ারওয়েল বিদায় সম্মিলনী আমাদের ব্যাচমেট।  আমার বাবারও বদলির চাকরি ছিল তখন বদলির অর্ডার এলে প্রায় সাত দিন বাড়িতে রাঁধা বাড়া হত না খাওয়াচ্ছে , খাওয়াচ্ছে আর গান শুনতে হতো , একরকম বাধ্যতামূলকভাবেই,  ভরা থাক স্মৃতি সুধায় বিদায়ের পাত্রখানিযে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা , এই লাইনটাতে ছোটোবেলায় একটু ধন্দে পড়ে যেতাম তখন তো মুভারস প্যাকারসের দল  ছিলোনা , গাদা গাদা প্যাকিং বাকসো , নারকেল দড়ি খড় দিয়ে জিনিশপত্র দশদিন আগে থেকেই বাঁধা শুরু হয়ে যেত মা মোড়াতে বসে তদারকি করতেন   রে রে করে মালপত্র লরিতে তোলা হত একা একা যাবার প্রশ্নই তো নেই !


রোদের জেদ  বাতাসের   তেজ বদলাচ্ছে দ্রুত তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে যায় বাতাস শিরশিরে শেষ রাতে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে শহর জুড়ে দেওয়ালির রোশনাই উৎসব আলোর ঝলমল করছে সব আনাচ কানাচ শুকনো ফল বাদাম পেস্তা কিশমিশ কাজুর ছোটবড় টুকরি তিলমাখানো গজক , মোতিচুর লাড্ডু , বালুসাই   রাস্তা জোড়া জ্যাম এই সময় খুব জ্যাম  হয় একবার জিগ্যেস করায় জেনেছিলাম , গিফট বাঁ টনা হ্যাঁয় না ? ইসি লিয়ে সবাই উপহার দিতে ব্যস্ত আলো জ্বালাতে ব্যস্ত নতুন পর্দা নতুন জামা কানের ঝুমকো , নতুন ডিনার সেট হাত ভরা মেহেন্দি কুনালজি আর জামার  অর্ডার নেবে না বলেই দিয়েছে আমার আসা যাওয়ার পথে সেই ছোট্ট ভাঙাচোরা ঝুল বারান্দায় মানিপ্ল্যান্টের গা ঘেঁসে লাল নীল টুনি বাতি

আমরা যাচ্ছি নয়নার ফেয়ার ওয়েলে রাস্তা জ্যাম অল্প রাস্তা তাও কত সময় লেগে যাচ্ছে দ্যাখো !



আমারো বদলির চিঠি এসেছে ,জানেন হঠাৎ নিজেরই ভালো করে মালুম হল না , ওদিকে প্রচুর ফোন আসতে শুরু করেছে  কবে আসছো ? কবে আসছেন ? কবে আসছিস রে ? যাক , ভালোই হল , কী বল ? কতদিন বাইরে বাইরে   ভাবে কি থাকা যায় ?

এতো ভালোবাসা  কি আগরওয়াল মুভারস প্যাকারস বাক্সো বেঁধে নিয়ে যাবে? একটা বদলির শারীরিক মানসিক ধকল কত,জানেন  ? আবার আমার যে সবকিছু লাগবে জয়পুরি ঝুল্লুরি , রঙদার কিলিম , হুনার হাটের ঘন্টা , রামানন্দের ছবি , পেতলের ঘড়া , মীরাবাঈ আঁকা সাইড টেবিল  আমি কিচ্ছু টি ফেলে আসব না কেউ প্রজাপতি এঁকে দিয়েছিল , কেউ ক্যায়ফি আজমি দিয়েছিল , কেউ রাগ করেছিল , খুচরো মজা , দেদার হাসি , কেউ ফোন তোলেনি , কলাপাতায় ভাপা ইলিশের ওম আর পাটিসাপ্টার জবজবে স্বাদ অনুপম  সরোদে রাগ কিরোয়ানি বাজিয়ে শুনিয়েছিল ,  অদিতির সাথে বুধাদিত্যর সুরবাহার , শৈলীর মায়ের কোমল স্নেহ আর এন্তার গানের গল্প  ,কামানি অডিটোরিয়ামের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে  আমি আর গীতালি ঝালঝাল মটর খেয়েছিলাম নন্দনার সঙ্গে  ছাতিমগাছের তলা দিয়ে হাঁটা , গীতালি আর  আসিফের সঙ্গে শিকারগাহ তে শীতের সকালগুলো  আর চিকেন স্যান্ডউইচ ,  পান্ডারা রোডের পুজোয় ধুনুচি নাচ , ছাতিম ফুলের ঘন গন্ধ , সব আমি ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবো
ঝড়ের মতো আমিও খেয়ে ফেল্লুম  ফেয়ার ওয়েল ডিনার, ফেয়ার ওয়েল লাঞ্চ  

এদিকে ফোন আসার শেষ নেই কবে গ্যাসের লাইন কাটবেন ?  আমাদের আবার পাইপের গ্যাস কি না   টেলিফোনের ?  বিজলির ? বাড়ি ছাড়ছেন কবে ? কবে? কবে? কবে? অফিসের কিছু ফারনিচার ছিল যে ফেরত দেবো কবে ? না কি নন্দনার বাড়িতে ঢুকিয়ে দেব একদিকে খালি হবে , অন্য দিকে ঠেসে ভরে যাবে

ম্যাডাম , আপনার এল পি সি , জিপিএফ,  ইনকামট্যাক্স ফাইল , ছুটির হিশেব  আমার কাছে আছে সব বুঝিয়ে দেব, কবে?
আমরা প্রায় এসে পড়েছি একটু দেরি তো হয়েইছে ভেতরে ঢুকছি আবার ফোন গীতা এবং লছমি ম্যাডামজি , থোড়া বাত কিজিয়ে না? আপনি ঘর ছাড়লে আমাদেরও সঙ্গে সঙ্গে  ছাড়তে হবে একটা ঘরের খবর আছে   মুম্বাই থেকে সবে এসেছে একটু কথা বলুন না দেওয়ালির আগে যদি কথাটা পাকা হয়ে যায় , তাহলে সাঁ বাবার ছবিটা ওই নতুন ঘরে ঢুকিয়ে দেবো ম্যাডামজি , এক সার্টিফিকেট ভি লিখ দিজিয়ে । একভি শিকায়ত 
 এখন কথা বলতে পারবোনা, গীতা  বাড়ি  ফিরিতারপর ফোন কেটে দি



বাতাস শিরশিরে , ন্যাতানো রোদ্দুর খসখস করে দু একটা হলুদ পাতা খসে পড়লো সবাই দাঁড়িয়ে ছিল অনেক লোক চুপচাপ কোন শব্দ ছিলোনা গাছের তলায় একটা বেদিতে নয়না শুয়ে আছে ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না একটা সুতোর নকশা তোলা চাদর ঢাকা কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম , জানিনা কেউ এসে আমার হাতে চাপ দিলো , কেউ কাঁধে হাত রাখলো বোধহয়

মুভারস প্যাকারস আমার সব মালপত্র নিয়ে কলকাতার বাড়ি ভরিয়ে ফেলবে গীতাজির সাঁ ইবাবা , ঘিয়ের প্রদীপ , ফ্যামিলি গ্রুপ ছবি , তোবড়ানো টি ভি  নতুন খুপরি ঘরে ঢুকে যাবে ব্যাঙ্কের পাশবই বাড়ির চাবি  অল্প কিছু গয়না আমি হাত ব্যাগেই রাখবো ক্যামেরা আর হার্ড ডিস্ক টাও
আমি এক শহর থেকে আরেক শহরে , গীতা লছমি এক খুপরি থেকে আরেক খুপরি ঘরে আর নয়না এক জগত ছেড়ে আরেক  ভিন জগতে একে একে চলে যাচ্ছে ওর সঙ্গে  অবিশ্যি কিছু নিয়ে যায় নি কিচ্ছু না চলে গেল, একা ।টিপি টিপি আলো আর শিরশিরে হাওয়া তাকিয়ে রইলো বেবাক  

গাড়িতে বসার পরে একটা মেসেজ এলো দেখলাম , পাঠিয়েছে আমাদের দরজি , কুনালজি   লিখেছে ম্যাডামজি , আপকা সপনা রেডি হ্যাঁয় , লে জাইয়েগা বুঝলাম মোবাইল ফোনের অটো কারেক্ট কপড়া কে সপনা টাইপ করে দিয়েছে ইশ ….




No comments:

Post a Comment