আজ নয়না চলে যাবে । আজ ওর ফেয়ারওয়েল । বিদায় সম্মিলনী । আমাদের ব্যাচমেট।
আমার বাবারও বদলির চাকরি ছিল । তখন বদলির অর্ডার এলে প্রায় সাত দিন বাড়িতে রাঁধা বাড়া হত না । এ খাওয়াচ্ছে , ও খাওয়াচ্ছে । আর গান শুনতে হতো , একরকম বাধ্যতামূলকভাবেই,
ভরা থাক স্মৃতি সুধায় বিদায়ের পাত্রখানি … যে পথে যেতে হবে সে পথে তুমি একা , এই লাইনটাতে ছোটোবেলায় একটু ধন্দে পড়ে যেতাম । তখন তো মুভারস প্যাকারসের দল
ছিলোনা , গাদা গাদা প্যাকিং বাকসো , নারকেল দড়ি খড় দিয়ে জিনিশপত্র দশদিন আগে থেকেই বাঁধা শুরু হয়ে যেত । মা মোড়াতে বসে তদারকি করতেন ।
রে রে করে মালপত্র লরিতে তোলা হত । একা একা যাবার প্রশ্নই তো নেই !
রোদের জেদ
বাতাসের
তেজ বদলাচ্ছে দ্রুত । তাড়াতাড়ি সন্ধে হয়ে যায় । বাতাস শিরশিরে । শেষ রাতে ঠান্ডা ঠান্ডা লাগে । শহর জুড়ে দেওয়ালির রোশনাই । উৎসব । আলোর । ঝলমল করছে সব আনাচ কানাচ । শুকনো ফল বাদাম পেস্তা কিশমিশ কাজুর ছোটবড় টুকরি । তিলমাখানো গজক , মোতিচুর লাড্ডু , বালুসাই ।
রাস্তা জোড়া জ্যাম । এই সময় খুব জ্যাম
হয় । একবার জিগ্যেস করায় জেনেছিলাম , গিফট বাঁ টনা হ্যাঁয় না ? ইসি লিয়ে । সবাই উপহার দিতে ব্যস্ত । আলো জ্বালাতে ব্যস্ত । নতুন পর্দা নতুন জামা কানের ঝুমকো , নতুন ডিনার সেট । হাত ভরা মেহেন্দি । কুনালজি আর জামার
অর্ডার নেবে না বলেই দিয়েছে । আমার আসা যাওয়ার পথে সেই ছোট্ট ভাঙাচোরা ঝুল বারান্দায় মানিপ্ল্যান্টের গা ঘেঁসে লাল নীল টুনি বাতি ।
আমরা যাচ্ছি নয়নার ফেয়ার ওয়েলে । রাস্তা জ্যাম । অল্প রাস্তা । তাও কত সময় লেগে যাচ্ছে দ্যাখো !
আমারো বদলির চিঠি এসেছে ,জানেন । হঠাৎ । নিজেরই ভালো করে মালুম হল না , ওদিকে প্রচুর ফোন আসতে শুরু করেছে
। কবে আসছো ? কবে আসছেন ? কবে আসছিস রে ? যাক , ভালোই হল , কী বল ? কতদিন বাইরে বাইরে ।
এ ভাবে কি থাকা যায় ?
এতো ভালোবাসা কি আগরওয়াল মুভারস প্যাকারস বাক্সো বেঁধে নিয়ে যাবে? একটা বদলির শারীরিক মানসিক ধকল কত,জানেন ? আবার আমার যে সবকিছু লাগবে । জয়পুরি ঝুল্লুরি , রঙদার কিলিম , হুনার হাটের ঘন্টা , রামানন্দের ছবি , পেতলের ঘড়া , মীরাবাঈ আঁকা সাইড টেবিল
আমি কিচ্ছু টি ফেলে আসব না । কেউ প্রজাপতি এঁকে দিয়েছিল , কেউ ক্যায়ফি আজমি দিয়েছিল , কেউ রাগ করেছিল , খুচরো মজা , দেদার হাসি , কেউ ফোন তোলেনি , কলাপাতায় ভাপা ইলিশের ওম আর পাটিসাপ্টার জবজবে স্বাদ । অনুপম
সরোদে রাগ কিরোয়ানি বাজিয়ে শুনিয়েছিল ,
অদিতির সাথে বুধাদিত্যর সুরবাহার , শৈলীর মায়ের কোমল স্নেহ আর এন্তার গানের গল্প
,কামানি অডিটোরিয়ামের সামনে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে
আমি আর গীতালি ঝালঝাল মটর খেয়েছিলাম । নন্দনার সঙ্গে
ছাতিমগাছের তলা দিয়ে হাঁটা , গীতালি আর
আসিফের সঙ্গে শিকারগাহ তে শীতের সকালগুলো
আর চিকেন স্যান্ডউইচ ,
পান্ডারা রোডের পুজোয় ধুনুচি নাচ , ছাতিম ফুলের ঘন গন্ধ
, সব আমি ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যাবো ।
ঝড়ের মতো আমিও খেয়ে ফেল্লুম
ফেয়ার ওয়েল ডিনার, ফেয়ার ওয়েল লাঞ্চ ।
এদিকে ফোন আসার শেষ নেই । কবে গ্যাসের লাইন কাটবেন ?
আমাদের আবার পাইপের গ্যাস কি না ।
টেলিফোনের ?
বিজলির ? বাড়ি ছাড়ছেন কবে ? কবে? কবে? কবে? অফিসের কিছু ফারনিচার ছিল যে । ফেরত দেবো কবে ? না কি নন্দনার বাড়িতে ঢুকিয়ে দেব । একদিকে খালি হবে , অন্য দিকে ঠেসে ভরে যাবে ।
ম্যাডাম , আপনার এল পি সি , জিপিএফ,
ইনকামট্যাক্স ফাইল , ছুটির হিশেব
আমার কাছে আছে । সব বুঝিয়ে দেব, কবে?
আমরা প্রায় এসে পড়েছি । একটু দেরি তো হয়েইছে । ভেতরে ঢুকছি । আবার ফোন । গীতা এবং লছমি । ম্যাডামজি , থোড়া বাত কিজিয়ে না? আপনি ঘর ছাড়লে আমাদেরও সঙ্গে সঙ্গে
ছাড়তে হবে । একটা ঘরের খবর আছে ।
মুম্বাই থেকে সবে এসেছে । একটু কথা বলুন না । দেওয়ালির আগে যদি কথাটা পাকা হয়ে যায় , তাহলে সাঁ ই বাবার ছবিটা ওই নতুন ঘরে ঢুকিয়ে দেবো । ও ম্যাডামজি , এক সার্টিফিকেট ভি লিখ দিজিয়ে । একভি শিকায়ত
…
এখন কথা বলতে পারবোনা, গীতা
। বাড়ি
ফিরি,
তারপর । ফোন কেটে দি ।
বাতাস শিরশিরে , ন্যাতানো রোদ্দুর । খসখস করে দু একটা হলুদ পাতা খসে পড়লো । সবাই দাঁড়িয়ে ছিল । অনেক লোক । চুপচাপ । কোন শব্দ ছিলোনা । গাছের তলায় একটা বেদিতে নয়না শুয়ে আছে । ওর মুখ দেখতে পাচ্ছি না । একটা সুতোর নকশা তোলা চাদর ঢাকা । কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম , জানিনা । কেউ এসে আমার হাতে চাপ দিলো , কেউ কাঁধে হাত রাখলো বোধহয় ।
মুভারস প্যাকারস আমার সব মালপত্র নিয়ে কলকাতার বাড়ি ভরিয়ে ফেলবে । গীতাজির সাঁ ইবাবা , ঘিয়ের প্রদীপ , ফ্যামিলি গ্রুপ ছবি , তোবড়ানো টি ভি
নতুন খুপরি ঘরে ঢুকে যাবে । ব্যাঙ্কের পাশবই বাড়ির চাবি
অল্প কিছু গয়না আমি হাত ব্যাগেই রাখবো । ক্যামেরা আর হার্ড ডিস্ক টাও ।
আমি এক শহর থেকে আরেক শহরে , গীতা লছমি এক খুপরি থেকে আরেক খুপরি ঘরে আর নয়না এক জগত ছেড়ে আরেক
ভিন জগতে একে একে চলে যাচ্ছে । ওর সঙ্গে
অবিশ্যি কিছু নিয়ে যায় নি । কিচ্ছু না । চলে গেল, একা ।টিপি টিপি আলো আর শিরশিরে হাওয়া তাকিয়ে রইলো বেবাক ।
গাড়িতে বসার পরে একটা মেসেজ এলো দেখলাম , পাঠিয়েছে আমাদের দরজি , কুনালজি ।
লিখেছে ম্যাডামজি , আপকা সপনা রেডি হ্যাঁয় , লে জাইয়েগা । বুঝলাম মোবাইল ফোনের অটো কারেক্ট কপড়া কে সপনা টাইপ করে দিয়েছে । ইশ ….
No comments:
Post a Comment