সেদিন সাত সক্কালে মিহির সর্দার এসে হাজির । পারমাদান । ওর বাড়ি ওখানে ।
সেখানে নাকি কেবলই হরিণ চরিতেছে । আমি অবিশ্যি কখনো যাই নি । তবে মিহির সর্দার বলল
, চারধারেই হরিণ , বাঁকা বাঁকা শিং , ছিটছিটে শরীর , কাজল পরা ছটফটে দুটো চোখ ।
আহা , দিদি একবারটি চলেন । সে নাহয় হল ,তা তোমার হাতে ওই সব কি ঝুলিতেছে? মিহিরের
সে কি হাসি! খেতের বেগুন ক’খানি নিয়ে এলুম দিদি ।
দেখলাম নধর , তেল চুকচুকে গাঢ় বেগুনি
রঙের বিটা ক্যারোটিনে ভরপুর রাশি রাশি বেগুন ফলিতেছে । মিহির সর্দার নাম
শুনে আবার ডাকাত সর্দার মনে করবেন না যেন । বড্ড ভালোমানুষ । প্রাইমারি ইস্কুলের
মাস্টার । সব সাবজেক্ট পড়াতে হয় । ছাত্র ছাত্রী কয়জনা গো ? একশ কুড়ি খাতায় কলমে।
গড়ে সত্তর জনা আসে মোটামুটি । মিড ডে মিল দাও ? হ্যাঁ, তাতো দিতেই হবে। একদিন ভাত
আর আলু ডালের ঝোল , একদিন ডিম আর একদিন খিচুড়ি , এটাই আবার ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়
। শীতের সবজি সস্তা । তাই মিহির সব্জিও খাওয়াতে চায় ।
ছাত্র এতো কম কম আসে কেন? কি আর বলব দিদি?
জিজ্ঞেস করলে বলে মাঠের কাজ ছিল । আবার মেয়েরা বলে মা মামার বাড়ি গেছিল, বলল ঘরদোর
দেখবি, ভাই বাপকে খেতে দিবি , রাঁধবি । এই সব তো লেগেই আছে । তাই একদিন মায়েদের
মিটিং ডাকা হল , একচল্লিশ জন এলো ,
সব্বাই গালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে পড়ল ।
আমরা মাস্টাররা যতই যা বলি যেন তাদের কানেই যাচ্ছে না । আমি এবারে বল্লুম ওই টিভি
সিরিয়াল আর পটলকুমার গানওয়ালা না দেখে ছেলেমেয়েগুলোকে নিয়ে একটু বসতে পারেন তো
বউদিরা । শুনে তাদের কি হাসি , এ ওর গায়ে টিভি সিরিয়ালের নাম শুনেই ঢলে পড়লো ।
এইসব নিয়েই চলছে আমাদের ।
আমি প্রসঙ্গ বদলে নিতান্ত আকাঠের বললাম আচ্ছা
হরিণের মাংস খেয়েছ? আপনা মাংসে হরিণা বৈরী । কেমন তা খেতে?
মিহির
বলল ভালো না , ছিবড়ে ছিবড়ে খেতে । ও ,তাই বোধহয় মাটিতে
রেখে একটু পচিয়ে খায় ।
একবার দুটো শিং ওয়ালায় খুব মারপিট হচ্ছিল । আমরা
তখন বেশ ছোট । দূর থেকে দেখছিলাম । হঠাত দেখি একটার শিং আরেকটার পেটের ভেতর ঢুকে
গেছে । সে কি ছটফটানি । খানিক পরে সেটা মরেই গেলো । এদিকে বনবাবুদের কানে খবর চলে গেলেই
তো সব মাটি । গ্রামের সবাই আমরা চুপ করে রইলাম । তারপর কাঠ কুটো দিয়ে ভালো করে
ওটাকে ঢেকে রাখা হল । তারপর সন্ধে হলে গাঁয়ের জোয়ান রা সব গিয়ে হরিণ টাকে লুকিয়ে
নিয়ে এলো । মাংস কেটে বাড়ি বাড়ি সব বিলি করা হল । আমি আবার ওকে থামিয়ে বললাম
হরিণের চামড়া টা ? ওটার কি হল? সে তো সব মাটি চাপা দিয়ে দেওয়া হয়েছিল । কোন কিছুই
ফেলে রাখা হয় নি । তবে খেতে ভালো নয়, এটুকু মনে আছে ।
আরেকবার কি হল জানেন? ইছামতীতে বান এলো । বাপরে
কি ভয়ানক বান । সব ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে । দেখি একটা শিং ওয়ালা হরিণও সাঁতরে চলেছে ।
আমরা কজনা ছেলে ওটাকে বড় করে ঘিরে ধরলাম । ওরে বাবা কি লাফ টাই মারল । আমরা
একেবারে বেসামাল হয়ে গেলাম । চারদিকে জল আর জল । তার মাঝখানে একটা দুটো ঢিবি মাথা
উঁচিয়ে আছে । প্রায় কাছাকাছি এসে কি দেখি জানেন ? দেখে আমরা তো তাজ্জব হয়ে গেছি ।
দেখি একই ঢিবিতে শেয়াল হরিণ সাপ ব্যাং,গোরু সব এক সঙ্গে । কেউ কাউকে খাচ্ছে না,
কামড়াচ্ছে না , বিরক্ত করছে না । এমন দৃশ্য এতোদিনেও ভুলিনি ।
মিহির সর্দার এতো রোমাঞ্চকর গল্প শুনিয়ে চলে যাবার পর ভাবলাম এই রাশি রাশি বেগুন দিয়ে এখন কি করি? ভাবতে ভাবতে মনে হল
পারমাদানের বেগুন দিয়ে তুর্কি লেবাননের বাবাগানুশ বানাই । বেগুনটা পোড়াতেই হবে ।
তারপর তিল আর অলিভ অয়েলের মসৃণ মিশেলে ( যাকে বলে তাহিনি) ঝলসানো বেগুনের নরম
শরীরে সামান্য রসুন কুচি আর বেশ খানিকটা লেবুর রসের খুনসুটি দিয়ে এক জম্পেশ কাহিনি বানানো হবে , বাবাগানুশ । পুরো ব্যাপারটাকে গ্রাইন্ডারে
দিলে আলতো ছোঁয়ায় একটা মোলায়েম সিল্কি এফেক্ট । রুটির সঙ্গে শীতের রাতে পারফেক্ট ।
নুন নেবু নঙ্কার পরিমান নিজের মতো মিশিয়ে নিতে হবে । এই বাবাগানুশ
খেয়েই না জালালুদ্দিন রুমি অত ভালো ভালো মনোহারী কথা দিয়ে মসনভি লিখে গেছিলেন ।
বাঙ্গালির রসনা আন্তর্জাতিক । আজকাল এইসব মেলায়
টেলায় নানারকম বিদেশি লোকজন এসে বিক্রিবাটা করে । হোয়াট ইস দিস? হোয়াট ইস দিস?
ভুরু তুলে সে ব্যাটা খুব একখানা কায়দার উত্তর দেয় , বাকলাভা , টারকিশ সুইট ।
এই খোদ কলকাতায় ইহুদি নাহুম রা কতদিন ধরে বাকলাভা
বিক্রি করে আসছে !
আমিও আর পিছিয়ে থাকি কেন? গরম রুটির মধ্যে দরাজ
হাতে বাবাগানুশ মাখিয়েছি আর চলেছি বসফোরাসের
মাঝ বরাবর , জলে ছিটিয়ে উঠছে ফেনিল স্রোত । একদিকে
এশিয়া,
অন্যদিকে ইওরোপ আমার দুদিকে লুটিয়ে আছে ।
আহা পারমাদানের বেগুনের কি গুণ! দিশি বলে হেলা ফেলা করো না ।
ছবিটা কি বাবাগানুশের?
ReplyDeleteyessssss. Homemade
Delete