Sunday 2 April 2017

বড়ো বাতাসা ছোটো বাতাসা

য়ে , মানে হরির লুটের কথা বলছি না । তবে কিনা এখনো এখানে অমলতাস আসেনি, জারুল আসেনি । হেঁয়ালি ভাবনেন না যেন । অমলতাস জারুলের সঙ্গে খুব কঠিন একটা ব্যাপার জড়িয়ে আছে । যত অমলতাস তত গরম । যত রোদের আগুন ঝলসে ঝলসে উঠবে তত অমলতাসের গনগনে হলুদ আর তার মাঝে মাঝে জারুলের বেগনি সোহাগ , ওহ সে যা একখানা দৃশ্য না! তারপর শুরু হবে জারুল আর বিশেষ করে অমলতাস নিয়ে এখানকার মানুষ জনের আদেখলাপনা । এটা কিন্তু আমার ঠিক হচ্ছে না । আমরাও পলাশ শিমূল নিয়ে বিস্তর মাতামাতি করি । ওটা তো আমাদের বাঁদরলাঠি ! ওসব নিন্দে করে লাভ কিছু নেই । দুটো ফুলই দুর্দান্ত সুন্দর । গতবার একটু অমলতাস করেছিলাম বলে কলকাতার লোকজনেরা বলেছিল ওখানে কি অমলতাস ফ্যান ক্লাব খুলেছিস নাকি রে
তাহলে আসল কথাটা হল গরম তেমন পড়েনি । এরপর তো দিনের বেলা বাইরে বের হওয়াই মুশকিল । তাতে কী এসে গেলো ? ছুটির দিনে দিব্যি ফ্যান চালিয়ে এসি চালিয়ে দরজা জানালা বন্ধ করে ঘোল খেয়ে পান্তা খেয়ে গুলতানি করা যাবে । কিন্তু সমস্যাটা হল বড় মন্ত্রী যেমন রাজকন্যার গুলিসুতো খেয়ে ফেলেছিল , তেমনি আমিও নিজের অজান্তেই খানকতক অদ্ভুত গুলি খেয়ে ফেলেছি। প্রত্নগুলি । গুলির নেশা ধরিয়ে দিয়েছে আরেক গুলিখোর দিওয়ানা কিসসাগো (গল্প বলিয়ে )সুফি আসিফ । নেশা ধরিয়ে দিয়ে কেটে পড়েছে ব্যাটা । আর নেশুড়ে জোনাকিগুলো ...fireflies in my head ..একেবারে যা তা কান্ড করে বেড়ায় । তাই শনিবার সকাল হলেই আমাকে গুলি খুঁজতে বেরুতে হয় । প্রত্নগুলি কথাটা ভালো শোনাচ্ছে না । আমি কবি রেহানের কাছ থেকে ধার করে বলছি প্রত্নগুলি নয় , প্রত্নস্বর ।
 
সেই স্বরের সর পুরিয়া খেয়ে জোনাকিরা শান্ত হয় ।
সেদিন নিজামুদ্দিন দিয়ে আসার সময় হঠাত চোখে পড়ল গেটের ওপারে ঠিক যেন মোঘলাই ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাংলো বা জিলা পরিষদের আপিস বা সার্কিট হাউস । আরে কি সুন্দর কি সুন্দর । গাড়ি থামাও । চল চল চল ।
বনবন করে ঢুকে যাচ্ছি । এক উরদিপরা বেয়াক্কেলে বেরসিক বত্তমিজ দারোয়ান কোথা থেকে হাঁ হাঁ করে ছুটে এসে ঘুসনা মানা , ভেতরে যাওয়া বারণ । বললাম কোথায় লেখা আছে ? লেখা আছে প্লাস্টিক প্যাকেট মানা হ্যাঁয়। প্লাস্টিক প্যাকেটের তো হাত পা গজায় নি । সেটা তো কোন মানুষের হাত দিয়েই ঢুকবে । সে তবু তার ভাঙা রেকর্ড বাজিয়েই চলেছে, ওসব জানিনা । ঢোকা বারণ ।ঢোকা বারণ । ঢোকা বারণ ।

আমি আমাদের দেশের প্রথা যথাযথ মেনে নিষেধের তোয়াক্কা না করে গট গট করে ডি এম এর বাংলোর দিকে এগিয়ে যাচ্ছি । এখখুনি গাউন পরা ডি এম সাহেব দুদ্দাড় করে নেমে এসে আমাকে ভেতরে নিয়ে যাবে , সেখানে চারটে শুঁটকো লোক বসে টানা পাখার বাতাস দিচ্ছে । পাঙ্খা পুলার । আর বাগানের গোলাপখাস আম কেটে কেটে মুনিরামের হাভেলি থেকে আনা বরফে ঠান্ডা করে আমার সামনে নক্সাদার মোরাদাবাদি থালায় করে রাখা হয়েছে । মেমসাহেব অরগ্যানে খুব একটা একঘেয়ে সুর বাজাচ্ছে আর আমার দিকে মিটি মিটি চাইছে , বাইরে ঘু ঘু ডাকছে , অমলতাস ঝরে ঝরে পড়ছে । ভেতরে খস ইত্বরের মাদকতা । ডি এম তার বাদামি গোঁফের আড়াল থেকে মিচকি হেসে বলছে , দুপুরে খানসামা শিককাবাব , মোতি পুলাউ...।


মেরা নোকরি চলা যায়ে গা । আপ ওয়াপস আইয়ে । সেই বত্তমিজ বেয়াক্কেলে বেয়াদব দারোয়ান টা নেশাটা বেমালুম ভেঙে দিল, এতো শয়তান ! আবার ড্রাইভারকে বলে কিনা ওনাকে এখানে আনলে কেন ? সে অমনি বলে বসে , আমি কোথায় এনেছি ? আমি জানিই না ছাই এসব এখানে আছে । উনিই আমাকে ধরে নিয়ে এসেছেন ।
 
চলে যাক তোর নোকরি , চুলোয় যাক তোর নোকরি । তোর এই ভাঙা বাড়ি দেখতে কে আসে রে? নেহাত তোর সাত পুরুষের কপাল ভালো যে কেউ একজন আগ্রহ দেখিয়েছে । চলেই যাচ্ছি । এই বলে যতখানি জ্বলন্ত দৃষ্টি দেওয়া যায় , সেটা ভালো ভাবে দিয়ে আমি চলে এলাম । বাইরে নাম লেখা আছে বাতাশেওয়ালা মহল । ছোটা আর বড়া ।
সেই ইস্তক আর তাকে ভুলতে পারছি না । বাতাশেওয়ালা মহল । কি আছে ওখানে ? কেন এমন নাম ?
ইচ্ছে থাকলেই উপায় হয় । ইমরান সাহাব , তার থেকে শরিফ সাহাব এই সব সাহাবদের মাজারে ঘুরে একদিন শনিবারের সকালে আবার সেই বাতাশেওয়ালায় আমি হাজির হলাম । গেট হাট করে খোলা । আস্তিন গুটিয়ে শরিফ সাহাব দাঁড়িয়ে । না মারবে না বোধহয় । মুখখানা হাসি হাসি ।
 
হঠাত শুনি, ইয়ে ম্যাডাম পেহলে ভি আয়ি থি , সেই বেয়াক্কেলে দারোয়ান টা না? কিন্তু আজ আমাকে পায় কে !
শরিফ সাহাবের সঙ্গে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলছি । গাছে গাছে ভরা ঠাণ্ডা জায়গা । চারকোনা মহল ।মহলের দরজা হাট করে খোলা । আমি ঢুকতে গিয়েই ভাবছি , আজ তো ডি এম সাহেব না খাইয়ে ছাড়বে না ,গিয়ে বলি গুড মর্নিং সাহেব , কলকাতা থেকে আনা দার্জিলিং চা আমার জন্যও এক কাপ । ম্যাডাম অরগ্যান বাজাবে না? আজ কিন্তু প্রাণ চায় চক্ষু না চায় বাজাতে হবে । আগের দিন কীসব একঘেয়ে বাজছিল। মিশিবাবারা সব কই ?
ওমা! একী ? এতো ডি এম কালেকটরের রেসিডেন্স নয় , বাতাসে তীব্র চামেলি সুবাস ।


হৃদয়ে আমার গন্ধের মৃদু ভার,
তুমি নিয়ে চলো ছায়ামারীচের বনে
স্থির গাছ আর বিনীত আকাশ গাঢ়
সহিতে পারিনা, হে সখি অলস মনে "

হঠাত কেমন ধুকপুকুনি । দিঘির জলের কাঁপন শুনি । এতো রুকসানার বাড়ি । খিলানে দেওয়ালে ছাদে কুলুঙ্গিতে অপূর্ব কারুকাজ । রুকসানার চামেলি গন্ধ । জালির ভেতর দিয়ে রোদের আলো । ঘরের কারুকাজ সে আলোয় অদ্ভুত মায়াময় । রুকসানার গোলাপি দোপাট্টার প্রান্ত মিলিয়ে গেলো ভুলভুলাইয়ার মধ্যে ।ভেতরে একটা ছোট ভুলভুলাইয়া । এক টা থেকে আরেকটা ঘরে পৌঁছে যাচ্ছি আর আমাকে ঘিরে ঘিরে ধরছে সেই সব অপরূপ নকসা । কক্ষ থেকে কক্ষান্তরে রুকসানার গান ভেসে আসছে বাঁধো না তরী খানি আমার এই নদী কূলে/ একা যে দাঁড়ায়ে আছি লহ না আমারে তুলে...। রুকসানা কি বাংলা গান গাইত ?
তানপুরার ষড়জের তার টং করে ছিঁড়ে গেলো ।

জল খাবেন ? শরিফ সাহাবের শরাফৎ । মনে মনে ভাবলাম এখন তো আমার জল খাবার কথা নয় , আমার জন্য থাকার কথা ছিল রুকসানার হাতে ধরা রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ
জানেন জনাব , আমার কেমন ঘোর লেগে যাচ্ছে ।
নিশ্চুপ সেই বনবীথির মধ্যে এক নিরালা মহল তার সর্বাঙ্গে মহার্ঘ অলঙ্কারে সেজে কার পথ চেয়ে আছে? সারা বাড়ি ঘুরে ঘুরে দেখি । চাতালে বসি , আবার দেখি ।
এবার আস্তে আস্তে কথা জিজ্ঞেস করি । বাতাশাওয়ালা মহল নাম কেন ? এখানে কি খুব বাতাস বইত ? ঠান্ডা মিঠে হাওয়া ? চারদিকে অনেক গাছপালা । নাকি সত্যি সত্যি হরির লুট হত ? জানতে পারলাম ব্রিটিশ ক্ষমতা দখলের পর এইসব নামগুলো এমনি এমনি দেওয়া হয়েছে । আর তথ্য বলছে এই ছোট্ট সুন্দর মহলটি আসলে একটা মকবরা । কোন মকবরা যদিও আমার চোখে পড়েনি ।
 
সম্রাট আকবরের জামাই মির্জা মুজাফফর হুসেন এখানে শায়িত । জামাই আদর বলে কথা! তথ্য আরো বলছে এটি সত্যই একটি সুন্দর স্থাপত্য । মূল কক্ষ কে কেন্দ্র করে আট খানা ঘর । হাশ্ত বেহেস্ত ,কোরানে উল্লিখিত স্বর্গের আট স্তর । আর এর জমকালো কারুকাজ ।
এই চৌহদ্দির মধ্যাই আছে ছোট বাতাশামহল । সেটা বেশি জীর্ণ ।
কিন্তু মূল্যবান কথাটা হলএই আগা খান ট্রাস্ট আর আরকিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া এর পুনরুদ্ধারের কাজ হাতে নিয়েছে । প্রধানত আগা খান ট্রাস্ট যে কাজ টা নিপুনভাবে করে চলেছে সেটা কাবিল এ তারিফ ।
 
সিমেন্ট এই কাজে ব্যাবহার হবেই না । চুনা পাথর ছেঁকে ছেঁকে তার মিহি পাউডার করা হয় । তারপর ছেঁকে ছেঁকে নেওয়া হয় যমুনার বালি ,তাতে মেশে গুড় , বেলের কাথ , বিউলির ডাল । এবারে এই মিশ্রণটাকে পেষাই করা হয় ,সেটা একেবার মিহি থেকে মিহিতর না হওয়া পর্যন্ত শ্রমিকদের হাত থামবে না । এইবার সেই লেই টা দিয়ে প্লাস্টার করা হবে । তারপর রঙ তৈরি । টালি তৈরি । সলতে পাকানোর কাজ দস্তুর মতো ব্যয় , শ্রম ও সময় নিংড়ে নেয় । এবং মাথাটাও ঘুরে যায় ।
তাই ভাল লাগার রেশ টুকু নিয়েই বেরিয়ে আসি । জালির পেছনে হয়তো রুকসানা তাকিয়ে ছিল । তানপুরার তারটা হয়তো জুড়েছে এতক্ষণে ।


হজরৎ নিজামুদ্দিনের খানকা খুব কাছে । একটু গিয়ে বসি । আজএকদমই কোন লোকজন নেই । একজন এসে হাতে কিছু একটা দিল । আমিও হাত পেতে নিলাম । একটা শাদা বাতাসা ।


ছবি : সুপর্ণা দেব 



Image may contain: tree, sky, plant, outdoor and nature

No comments:

Post a Comment