Saturday 15 April 2017

মছলি বিবি

রে সেদিন এক কান্ড ! সক্কালবেলার নরম রোদ আর বেশ ঠান্ডা হাওয়ায় লোধি গার্ডেনে তো মোচ্ছব বসে গেছে । লোকজন  হুপহাপ  হুপহাপ করে হাঁটছে , ঝোপের ধারে একপাল নারী পুরুষ মাথার ওপর হাত তুলে হো হো করে হাসছে, সেই হাসির গমকে  ভয় পেয়ে এক ঝাঁক টিয়া  ছোলার দানাটানা  ফেলে ঝটপট উড়ে পালিয়ে গেলো , ওদিকে দুটো শালিক ,তিনটে পায়রা কাঠবিড়ালির সঙ্গে খুনসুটি করছে , বড়া গুম্বদের সামনে ইয়োগা ম্যাট বিছিয়ে আরেক দল ব্যায়াম করছে । কোথা থেকে আবার একটা বাঁশির  মধুর সুর ভেসে ভেসে আসছে । তাকে হ্যামলিন ভেবে নিয়ে আমি খুঁজতে বেরুলাম । বাঃ দেখেছ , এমন রসিকও আছে , সকালবেলায় বাঁশিতে ভৈরবী বাজিয়ে বাজিয়ে  লোধিদের এবং তাদের দাদা, পরদাদা, মৌলভি , মুন্সি যারাই মাটির তলার ঘুমিয়ে আছে তাদের ঘুম ভাঙাচ্ছে ! হঠাত এক লম্বা লাল গাউন আর স্যুট কোট  কোথা থেকে উদয় হয়ে নানান রকম ভঙ্গিতে ( সবটাই খুব নান্দনিক বলা যাবে না) ছবি তুলতে লাগলো । আস্তে আস্তে আরো চোখে পড়লো লেহেঙ্গা চোলি শেরওয়ানি । আমি চিরকালের বাঙাল , ধীরে ধীরে  বুঝলাম ফোটো তোলা হচ্ছে , প্রাক বিবাহ । ওই বাঁশি টা ওই প্যাকেজের মধ্যেই ঢোকানোঅতখানি গদগদ হবার কোন কারণই ছিল না ।  খানিক দূর এগিয়ে দেখি এক মিনিস্কার্ট স্ফীতোদরা  ঘুরে ঘুরে পোজ দিচ্ছেনইনি শিগগিরি মা হতে চলেছেন । সব কিছু ধরে রাখতে হবে যে  । কিছুই অমৃত নয় তবু চাই সব ।
একই রঙ্গমঞ্চে মাজি হাল মুস্তকবিল বা বিষ্ণু দে ধার করে  স্মৃতি সত্তা ভবিষ্যতের নাটক দেখতে দেখতে আমি একেবারে হাঁসেদের মধ্যে  বকের মতো গিয়ে হাজির হলাম । সেখানে একটা বুনো সোঁদা জোলো গন্ধ । একটা ঝোপঝাড় । আর সেইখানে একটা হাত , নগ্ন নির্জন নয় , গম রঙা , মেহেন্দি লাগানো , রুলি রুলি চুড়ি ,সোঁ করে কোনখান থেকে বেরিয়ে এসে আমার হাতটা চেপে ধরলদিল্লি খারাপ জায়গা সবাই বলে।  আমি ভয় পেলাম । খুব ভয় । মুখে  বললাম , মানে হিন্দিতেই বললাম

“ কি হচ্ছে কি? লোক ডাকবো ? দিনে ডাকাতি করবে নাকি? আমি কিন্তু বরিশালের মেয়ে। এমন দোবো না“? ফস করেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো, জানেন?
তাকিয়ে দেখি ধানি রঙের ওড়নায় মুখ ঢাকা ।ওড়নার ভেতর থেকেই বলল
জানি , আমিও অইখানকারি ।
ওমা , এযে বাংলা বলে ?
তুমি বাঙালি?
হ্যাঁ তো ।
তা আমি বাঙালি বোঝলা কি কইরা?
বোঝোন যায়মাছের গন্ধে ।
অ্যা ই , বাজে বোকো না ।  কি দরকার তাই বোলো , নাম কি ? কোথায় থাকো ? হাত টা চেপে ধরে আছ কেন?
আমার নাম মছলি বিবি , থাকি এখন লাল কেল্লায় । আপনার লগে কাম আসে, শোনেন না?
বাঁদরামি হচ্ছে ?  লাল কেল্লায় থাক? মছলি বিবি ? এই, তোমার মতলব কি বলতো? আমার আছে কোন পয়সা কড়ি নেই কিন্তু ।
শোনেন না , আপনি তো লখনউ যাচ্ছেন । আমার হাতের চুড়ি , এই দেখুন কেমন ভেঙে ভেঙে গেছে , যাবে না? কতো কতো দিন হয়ে গেলো!
আমি লখনউ যাবো তুমি কি করে জানলে ? আর চুড়ি  দিল্লিতে পাওয়া যায় না ? ন্যাকামি হচ্ছে ?
আমি কি জানি, আর কি জানি না  অত জিগাইবেন না । এই দ্যাহেন , এই এমন চুড়ি এখানে পাবেন না ।  এটা পাওয়া যায় গড়বড়ঝালায় ।
আবার বানিয়ে বানিয়ে  কথা? এই , সব কথা খুলে বল তো । হেঁয়ালি ছেড়ে সোজা সাপটা

সাপ টাপ আনেন কেন? আমাগো দ্যাশে তার বড় উৎপাত । ডর লাগে ।
উফ, আমাকে অফিস যেতে হবে , তোমার গুলতাপ্পি যা বলার বলে ফেলো । আর তাড়াতাড়ি আমাকে ছেড়ে দাও দিকি  ।

ধানি ওড়নার ফাঁকে সে মেয়ে বলতে থাকল তার কথা ।

সেদিন বাবার জন্য পান্তা ভাত , মাছ ভাজা একটা বাটিতে গুছিয়ে ঠাণ্ডা  গামছায় জড়িয়ে চাষের খেতে নিয়ে যাচ্ছিল সে । দূর থেকে সেই সবুজ ধানি মাঠে নদীর হাওয়া খেলে বেড়াচ্ছিল । দুলকি চালে  চলছিল , আলগা খোঁপা খুলে গিয়ে এক ঢাল চুল তার পিঠ ছাপিয়ে পড়লো , পা বুঝি সামান্য টাল খেলো , বুকটা কেন তিরতির । বাঁ চোখটা কেন কাঁপে!  চোখের সামনে একরাশ ধুলো । ধুলোর ঘূর্ণি । ঘোড়ার খুড়ের খটাখট । মাথার খোলা চুলে মুঠি পাকিয়ে কে যেন টানে ! কে যেন তুলে নেয় ঘোড়ায় ।  ছিটকে পড়ে মাছ ভাজা , পান্তা ভাত । কিছু মনে নেই । আর কিছু মনে নেই ।
একটা খুব সুন্দর মহল ।  যত্নের কোন অভাব নেই । তাকে বিশেষ তালিম দেওয়া হচ্ছে নবাবের জন্য । গান । মৌসিকি । ধীরে ধীরে নবাবের সঙ্গে আশনাই । মানুষটা বড় ভালো , কিন্তু খাবারের বড় কষ্ট । মাছ ছাড়া সে খেতে পারত না । এরা শুধু মাংস খায় ।
তাদের গ্রামে কত মাছ , ন্যাদোশ , পুঁটি , কালবোস , খলশে, শোল , চিতল মৌরলা দুটি ভাত মাছ এইতো ছিল  খাওয়া । স্বপ্নের মধ্যে মেঘ হয়ে ভেসে যায় তার গ্রামে । খড়ের চালে  দু ফোঁটা চোখের জল ফেলে আসে । এখানে নবাবের হুকুমে তার জন্য তালাও থেকে  মচ্ছি জোগাড় হয় । সে ভারি ঝঞ্ঝাট । এরা আবার রাঁধতে জানে না । পেঁয়াজ রসুন মশল্লায় ,মাগো! কান্না পায় । এরা শুধু জানে জায়কা , খুশবু আর পেশকারি । আর  তার মা এইটুকুনি তেলে কালো জিরে কাঁচা লংকা দিয়ে রাঁধত ,  যেন অমৃত
নবাব তাকে মজাক করে মছলি বিবি বলে ডাকে । মছলি বিবি ডাগর কালো চোখ এক ঢাল চুল আর  গমের মতো রঙ , গ্রাম বাংলার নয়নতারা ফুল এখন  নবাবের নয়নমণি ।  সে জেনেছে জায়গাটার নাম ফইজাবাদ । চারদিকে গোলাপের মেহেক  । কতো সুখ তার চারদিকে । একদিন নবাব তাকে খুব বড় একটা প্রাসাদের সামনে নিয়ে হাজির করে , বলে , দিলদার , চোখ তুলে দেখ ! মছলি বিবি দেখে প্রাসাদের গায়ে সুন্দর সুন্দর মাছের নক্সা ।
দেখ বিবি ,চোখ ভরে মছলি দেখ । তোমার জন্য আমাদের সব সব জায়গায় এই মছলি থাকবে । তোমাকে মনের মতো মাছ খাওয়াতে পারছি না , কিন্তু বুঝতে তো পারি তোমার কষ্ট ।

আমি মাঝপথে থামিয়ে বললাম , গুল দেবার জায়গা পাও না? মাছ একটা শুভ চিহ্ন । শুধু আমাদের কেন অন্য অনেক দেশে , অনেক ধর্মে ।  তা ছাড়া আমি তো পড়েছিলাম নবাব যখন নদী পার হচ্ছিলেন তখন তার কোলে দুটো মাছ ঝাঁপিয়ে পড়ে । তাকে শুভ মনে করেই এই কাজ । তাছাড়া নবাবরা এসেছিলেন ইরান থেকে , সেখানেও মাছকে শুভ মনে করা হয় ।
ধানি ওড়না  কিছু ক্ষণ চুপ করে রইল । তারপর আমার তাড়া খেয়ে বলল, যা যা পড় তার সবই সত্যি ? যা যা দেখ সবই সত্যি?  তাই কখনো হয় ? যে দেশ মাছের দেশ নয় সে দেশে মাছ উড়ে এসে জুড়ে বসল?  যে দেশ খাল বিলের নদীর নয় সে দেশের নিশানে মাছ এসে বসে গেলো? আসল কথাটা জানতে পেরে মেনে নিতে পারছ না ?
“ তা নয়, তবে খুব খটকা লাগছে তা , এখন বলে ফেলো কী বলতে এসেছিলে?”
“ রাজধানী চলে এলো ফইজাবাদ থেকে লখনউ । আমাদের খিদমত খাটত গফুর । সে আমাকে সরুসরু গালার চুড়ি এলে দিল । নবাবের সে  কী রাগ ! আমার কিন্তু ওই চুড়ি গুলো বেশ লাগত ।
আপনজন আপনজন লাগত। আদতে তো গরিব ঘরের মেয়ে ।
 এদিকে দিল্লির বাদশাদের সঙ্গে নবাবদের খুব খাতিরদারি শুরু হল দিন গড়িয়ে  চলল আর আমি হয়ে গেলাম খেলার মোহরা । গানের জন্য চালান হয়ে গেলাম মহম্মদ শাহ রঙ্গিলার কাছে। লখনউ ছেড়ে যাবার আগে গফুরকে দিয়ে কয়েক গাছি চুড়ি আনালাম আর নবাবের দিকে আড় চোখে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে  গাইলাম “অ্যায় মোহব্বত তেরে আনজাম পে রোনা আয়া” ।
“ ভ্যাট , এই গানটা  অনেক পরে লেখা হয়েছে । লিখেছেন শকিল বাদায়ুনি  বেগম আখতার ,আরো অনেকে গেয়েছেন।”
ধানি ওড়না বলল , আর কথা বাড়িয়ে কী ই বা হবে ? তুমি তো কোন কথাই বিশ্বাস করবে না ।  তুমি যদি  কয়েকগাছি চুড়ি  এনে দিতে পারো  তো দাও আমি এইখানে এসে নিয়ে নেব




সত্যিই মাছের নক্সায় ছয়লাপ লখনউ এর অপূর্ব সব বাড়িঘর । কেশর বাগ , নহবত খানা ,  বড়া ইমামবাড়া , ছোটা ইমামবাড়া , সাদাত আলির মকবারা ,আরও নানান জায়গা । নবাবের সরকারি মোহরে মাছ , পতাকায় মাছ । ভারি ইন্টেরেস্টিংকোথাও আবার উড়ুক্কু মাছ ! নাহ , মছলি বিবি মাছের গল্প শুনিয়ে নবাবকে পাগল করে ছেড়েছিল দেখছি !

আমি কিন্তু নিজের অজান্তেই দোকানে ঢুকে গালার চুড়ির কথা জিগ্যেস করি । কেউ বোঝে না । একেবারেই না ।  হাবিজাবি জিনিস বের করে এনে দেখায় । শেষে থামের পাশে বসা এক খুনখুনে বুড়ো বলল ওই রকম চুড়ি পেতে পারো একমাত্র গড়বড় ঝালায় । আমি চমকে উঠলাম । আরে! এটা তো শোনা নাম ! কেন এমন নাম ? আরে মোহতরমা , সারা দুনিয়ার লোক ওখানে বাজার করতে যায় । এর জিনিস ওর জিনিসে মিশে যায় । ভিড়ভাট্টা ঠেলাঠেলিতে সব গড়বড় । তাই তো গড়বড়ঝালা ।
মছলি বিবি খুব ভালবাসত ওখানকার চুড়ি । লোকটা বিড়বিড় করে বলে ।
কি বললে ? আবার বোলো ।
কেয়া  মোহতরমা? কুছ তো  কাহা নহি ।



তখন দিনের শেষ আলো মেখে হজরতগঞ্জ মায়ামদির রাস্তার দুপাশে সাদা কালো সাইনবোর্ড আর সারি সারি বাতিদান এখানকার সিগ্নেচার মার্ক । রেস্তোরাঁর কাঁচ থেকে আবছা ছত্তরমঞ্জিল । ওখানেই কোথাও হয়তো মছলি বিবি থাকত, পাশে বইছে শীর্ণ গোমতী । গরমকালে তয়খানায় শুয়ে শুয়ে মৌরলা মাছের টকের কথা ভাবত হয়তো ।  
মুরগ মখমলি , গালাউটি কাবাব আর উলটে তাওয়া কি পরাঠার  সুচতুর মশলার মিশেলে গলে গলে পড়ছে ফয়েজের গজল ।
“গুলো মে রঙ্গ ভরে / বাদ এ নওবাহার চলে / চলে ভি আও কে গুলশন কা কারবার চলে “ ।
গায়ক দরদ ঢেলে মেহফিল জমিয়েছেন । যেমন জমাতো মছলি বিবি ।
 দিন যত গড়িয়েছে মাছ তত বেশি বেশি  নক্সাদার হয়েছে । ওয়াজিদ আলি শাহ্‌র আমলে সে আরও সুন্দর । মাছ থেকে সে তখন মৎস্য কন্যা । সত্যি ভারি অদ্ভুত শিরশিরে লাগছে ভাবতে ।

দিন ফুরোয় । আমিও ফেরত আসি । গড়বড়ঝালায় যাওয়া হয় নি, আনা হয় নি লাল লাল সরু  সরু গালার চুড়ি । লোধি গার্ডেনে যাই । কিন্তু ভুলেও আর হাঁসেদের দিকে যাই না ।


“পাথর,অসাড় নয় ভালবেসে ছুঁয়ে দেখ, তাকে ।

পাথর, পাথর নয়  বিগত জন্মের যত কথা
একাকী পথিক হয়ে ঘোরে ফেরে মহলে মহলে

প্রতিটি খিলান আর গম্বুজের মায়াবী চূড়ায়
প্রত্নস্বর তুলে আনে আলো জ্বেলে যতখানি সুর
সমস্ত তোমারি কথা
দু হাতে উজাড় করে ঢেলে দেয় নীল-কুয়াশায়

পাথর, পাথর নয়  বিগত জন্মের যত কথা
একাকী পথিক হয়ে ঘোরে ফেরে মহলে মহলে



নওবত খানা


গেট বড়া ইমামবাড়া


গেট ছোটা ইমামবাড়া


নবাবের পতাকা

নবাবের সিলমোহর






কবিতা  রেহান কৌশিক
মাছের অলঙ্করণ শুভ জোয়ারদার
ছবি  লেখক/গুগল


No comments:

Post a Comment