Sunday 2 April 2017

কবি আমলা


পিপুল গাছের পাতার ওপরে জমাট কালো মেঘ । পাশের তালাও এ মেঘের কালো ছায়া । রসুইঘরে দুধি হালুয়া । পিপুল গাছের পাতার ভেতর থেকে পিউ কাঁহা ,ডাকছে অবিরাম । বৃষ্টি এলো বলে । ছোট ফোঁটা বড় ফোঁটা ঝমঝম ঝমঝম । চারদিক ঝাপসা । পাথরের উঠোনে আছড়ে পড়ছে জল , ছেঁড়া ফুল , পাতা । 
আজ দরবার দেরিতে বসবে ।
শাওন আওয়ন কহিগে , শ্যাম সুজান
অজহু ন আয়ে সজনী , তরফত প্রাণ ।।
রহিমন একমনে লিখে চলেছেন দোহা । পূর্ব মাগধী ব্রজ ভাষা , খাড়ি বোলি । তাঁর বড় মধুর লাগে । আর সবচেয়ে ভালো লাগে যখন তিনি এই ভাষায় তাঁর প্রিয় কৃষ্ণের কথা লেখেন । তিনি যে কৃষ্ণের দাসানুদাস ।
আরেকটি দোহায় লিখলেন গরিবের ব্যথা যে বোঝে সেই তো মহান , তা না হলে সুদামার কী যোগ্যতা যে তিনি কৃষ্ণের সখা হলেন?
আবার লিখলেন ,ওগো পথিক , তাঁর পা ধরে আমার মিনতি জানিও/ মোহন ,তোমাকে ছাড়া আমি বাঁচি কি ভাবে?
তাঁর হৃদয় জুড়ে কৃষ্ণ । কৃষ্ণ যশোদার কবিতা যেন এক একটা ছবি , কৃষ্ণের মুখের ননীর স্বাদও যেন পাঠক অনুভব করে ।তবে শুধু কৃষ্ণ নয় রামায়ণ মহাভারত পুরাণ গীতা সব কিছুর জৌলুস নিয়ে তাঁর কবিতা উজ্জ্বল । হিন্দি খাড়ি বোলি আরবি ফারসি শিখেই তাঁর তৃষ্ণা মেটেনি । সংস্কৃত এলো তাঁর দখলে । লেখা হল কবিতা । বিভিন্ন ভাষার মিশেল দিয়ে করলেন নানা পরীক্ষা । ছন্দ মাত্রা নিয়ে পরীক্ষা , কবিতায় একাধিক ভাষার ব্যাবহার । তুলসীদাস তাঁর সমসাময়িক । দুজনের মধ্যে কথা হত ওই কবিতার মধ্য দিয়ে । সে এক অপূর্ব ছান্দসিক মুহূর্ত । অনুবাদ হল রামায়ণের ।
না আর দেরি করা বোধ হয় ঠিক হবে না । রহিমন উঠে পড়েন । তৈরী হলেন , রাজদরবারের জন্য । গায়ে উঠল শোভন পোশাক , ফটকে দাঁড়িয়ে সাজ পোষাক পরে তাঁর ঘোড়সওয়ার । রক্ষী । 
কে এই রহিমন ? তিন দিন ধরে যাকে নিয়ে দিল্লির ইন্ডিয়া হাবিট্যাট সেন্টারে উৎসব । কবি রহিমন হলেন আব্দুল রহিম খান ই খানান । একজন মুঘল যোদ্ধা , রাজনীতিবিদ , মন্ত্রী । সম্রাট আকবরের নব রত্নের এক রত্ন ।

নয় সংখ্যা টা নাকি হিন্দু মুসলমান দুজনের কাছেই পয়া । শোনা কথা । আল্লাহ্‌র নিরানব্বই নামের এক নাম রহিম । হজরত মহম্মদেরও নিরানব্বই টা নাম । নয়ে নয়ে আঠেরো । আট আর এক যোগ করলে সেই নয় । বিষ্ণুর একশো আট নাম । ওই আট আর এক যোগ করলে সেই নয় । কিলা এ মুবারাক মানে লাল কেল্লা নয় বছরে তৈরি হয় । নবরস। নবগ্রহ । নবরাত্রি । নবরত্ন । 
 
আব্দুল রহিম খান এ খানান ছিলেন নবরত্নের এক রত্ন । স্ত্রী মাহ বানুর জন্যও তার তৈরি মকবারা মুঘল আমলে পত্নীর জন্যও সমাধি বানানোর প্রথম নিদর্শন ।
ইতিহাস তাঁর রাজনীতির চাল , মন্ত্রণার কূট জাল , যুদ্ধের জয় রক্তপাত মনে রাখে নি । মনে রেখেছে এক যুগান্তকারী কবিকে । তাঁর মনীষা , বৈদগ্ধ আর উদারতাকে ।

অনেক অনেক লিখেছেন তিনি । তুর্কি ভাষায় লেখা বাবরের জীবনী ফারসিতে অনুবাদ করেন । বাৎসল্য , ভক্তি ,শৃঙ্গার রসে সিক্ত তাঁর অজস্র কবিতা বিশেষ করে দোহা ।
আব্দুল রহিমের মকবারা জরাজীর্ণ । পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে জনস্রোত । দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় এই মকবারায় এখন সংরক্ষনের কাজ পুরোদমে চলছে । এর এক কিলোমিটারের মধ্যে আছে দুই মহীরূহ কবির সমাধি । হজরত আমির খুসরো এবং মির্জা গালিব । এদের আলোর ছটায় ম্লান নিষ্প্রভ হয়েছিল এতোদিন এই মকবারা ।
সময়ের থেকে অনেক অগ্রগামী ছিলেন তিনি । শোনা যায় তাঁর সমাধিটির জাঁক জমক কিছু কম ছিল না । এমনও শোনা যায় যে সেখান থেকে দামি দামি পাথর খুলে নিয়ে সফদরজং মকবারায় লাগানো হয়েছিল । 
 
তরবারির থেকে কলম শক্তিশালী । আব্দুল রহিম তার অকাট্য প্রমাণ ।








No comments:

Post a Comment