Sunday 2 April 2017

যেথায় তুমি লুকিয়ে প্রদীপ জ্বালো


মাঝরাতে ঘরে জ্বলে একটিমাত্র তেলের প্রদীপ । চারদিক নিকষ কালো । সাধনার মায়াবী অতীন্দ্রীয় পথে তৃষ্ণার্ত পথিকের মতো ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেহবুব হয়ে গেলেন । প্রেমিক হয়ে গেলেন । কার প্রেমিক হয়ে গেলেন? কে সেই মেহবুবা? কেমন তার চেহারা ? কেমন তার চোখ ? কেমন তার হাসি ? তিনি ইলাহি । তার হাসি তার আনন্দ তার উল্লাস, তরঙ্গে তরঙ্গে আলোকিত করে শিহরিত করে মেহবুবকে । তস্য ভাসা সর্ব মিদং বিভাতি । তিনি ঈশ্বরের প্রেমিক । মেহবুব এ ইলাহি ।
প্রতিদিন মুঠো মুঠো ভালোবাসার মোহর বিলি করেন । দলে দলে আর্ত অসহায় করুণার পাত্র নিয়ে তাঁর কাছে আসে । বিলিয়ে দাও বিলিয়ে দাও সব কিছু । বাকি সময় নির্জন সাধনা। মানুষের সেবা । সাদামাটা সরল জীবন,বিলাসিতা থেকে যোজন দূর ।
ইশক, ইবাদত , অকল, ইল্ম । ভালোবাসা প্রার্থনা বুদ্ধি প্রজ্ঞা। এই হল সুফি দরবেশের পথ।
সাত জন সুলতানের শাসন দেখেছেন তিনি । রাজদন্ডের কাছে মাথা নত করা তাদের ধর্ম বিরোধী । নানান ভাবে অপদস্থ করার চেষ্টা হয়েছিল । কতো কতো বার দরবারে ডাক পড়েছে । তিনি যান নি । তিনি বলে পাঠিয়েছেন একটা বাজ পাখি যখন ছোট্ট পাখির ওপর হামলা করে সেই ভিতু পাখিটাকে বাঁচানোই আমার কাজ । ছেঁড়া কম্বলে বসে থাকি, রাজপ্রাসাদে কী কাজ ? সুলতানেরা নিজেরা তাঁর কাছে আসতে চেয়েছেন । তিনি বলে পাঠিয়েছেন ওরা এলে আমি দিল্লি ছেড়ে চলে যাব । তাঁর জনপ্রিয়তাকে রাজশাসন সবসময় সু নজরে দেখেনি । তাঁর বিরোধিতা করার জন্য সুলতানের বরাদ্দ ছিল দৈব শাস্তি । তিনি শুধু মুখে বলেছিলেন হনুজ দিল্লি দূর অস্ত ।
দিল্লি এখনও বহু দূর । দিল্লি ঢোকার আগেই সুলতানের অপঘাতে মরণ ।

তিনি যে জলের ওপর হেঁটে যেতেন বা হাওয়ায় ভেসে বেড়াতেন তা নয় । তাঁর অলৌকিকত্ব হৃদয় উৎসারী। তিনি স্নিগ্ধ বাতাস হয়ে ,ঠান্ডা জল হয়ে আলো হয়ে ঢুকে যেতেন অনায়াসে অগুন্তি দুঃখী মানুষের মনের গভীরে । তাঁর অন্তর্ভেদী দৃষ্টি পড়ে ফেলত মনের যত কথা , ছুঁয়ে ফেলত যত বেদনা আর অশ্রু । ।
বিশাল লঙ্গর বসত । পাতের পর পাত খাওয়ানো চলত । সাধারণ খাওয়া । কিন্তু তিনি খাওয়াতে ভালোবাসতেন। দরবেশদের জন্যও তাঁর নির্দেশই ছিল আগে সবার সঙ্গে সৌজন্য বিনিময়, তারপর খাওয়া তারপর যা কিছু আলাপ আলোচনা ।
এই প্রবাদের মতো বদান্যতা , এই ঢালাও খাবারের ব্যাবস্থা সুলতানেরা সন্দেহের চোখে দেখতেন । আলাউদ্দিন খিলজি তো গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন একবার ।ওরা কি কি খায় দেখে এস তো। তাঁর রসবোধও ছিল তুখোড় । ব্যাপারটা আঁচ করেই দরবেশদের বললেন হালুয়া , সাম্বোসা ,সুস্বাদু ভাত আর পিঠে খাওয়ানো হবে আজকে । পৃথিবীর অন্যতম সেরা চিস্তিয়ানা সিলসিলার এই সুফি সাধক তার রসবোধ , মানবতা , উদারতা আর অত্যন্ত সাধারণ জীবনের জন্য বিশিষ্ট হয়ে আছেন । উপবাসে থাকতেন অনেক সময় , খেতেন খুব অল্প । ভাত আর তেতো সবজি । ইফতারের সময় সামান্য রুটি । একজন অতিথির ইচ্ছে হল ওনার সঙ্গে খাবেন । এদের খাওয়াদাওয়া বেশ সুন্দর , উনি নিশ্চয়ই আরো ভালো ভালো খাবেন । সবাই মানা করল ।কিন্তু সে শুনলো না। সবার শেষে যখন খেতে বসা হল সামনে রাখা হল এক গাদা তেতো সবজি । বহু চেষ্টা করেও সেই অতিথি গলা দিয়ে খাবার নামাতে পারল না । মাথা নুয়ে এল তাঁর পায়ে । তাঁর আকাশের মতো বিশাল হৃদয়ে কতো জনকে আশ্রয় দিয়েছিলেন । প্রচুর উপহার আসতো আবার সন্ধের আগেই সব বিলিয়ে দেওয়া হতো
 
সামা মেহফিল বা সঙ্গীত তাদের সাধনার অঙ্গ । কাওয়ালি । ভক্ত আমির খুসরো সেই সব গান বেঁধে গুরুকে শোনাতেন । এই সঙ্গীত ,নৃত্য ইসলাম প্রথানুগত নয় ।
অতীন্দ্রীয় রহস্য তাঁকে ঘিরে খেলা করত । দেহ হয়ে গিয়েছিল সুরভিত । অদ্ভুত সুগন্ধ বের হত । তাঁকে ছুঁয়ে এক কাজির গায়ে সেই সুগন্ধ লেগে গেলো । কাজি বারবার জল দিয়ে ধোবার চেষ্টা করছেন । তিনি বললেন ওহে । এযে ভালবাসার খুশবু । এ যে ঈশ্বর তাঁর আশিককে পাঠিয়েছেন ।
তাই তাঁর সমাধি নয় , তাঁর বাসস্থান ও সাধনার স্থলটি দেখার বড় ইচ্ছে হল । রইব তোমার ফসল-খেতের কাছে/ যেথায় তোমার পায়ের চিহ্ন আছে । সুফিরা বলেন খানকা বা চিল্লাহ । দিল্লিতে এককালে অগুন্তি খানকা আর চিল্লাহ ছিল সুফি সাধকদের । গাছে গাছে হজরত এ দিল্লি ছিল ভরপুর । আর তার মধ্যে মধ্যে দরগা আর খানকা । এখন দিল্লির নিজামুদ্দিন এলাকায় খুব নির্জন পরিবেশে এই খানকা । কোন ভিড় নেই । চিৎকার নেই । কোন দোকানপাট নেই ।দশ পনেরজনের বেশি লোকও বসে নেই । এখানে তিনি জীবনের পঁয়ষট্টি টা বছর কাটিয়েছেন । তাঁর আধ্যাত্মিক তরঙ্গের রেশ এখনো মিলিয়ে যায় নি ।
সমস্ত জায়গাটি জুড়ে শুধু শান্তি । স্থান মাহাত্ম্য কাকে বলে অনুভব করলাম । খুব পরিচ্ছন্ন আর হালকা সুগন্ধে ভরা । এখানে এক ফকির বাবা থাকেন , মহম্মদ আনোয়ার । সেদিন আবার এক শিখ এসে তাঁর সঙ্গে কিসব কথা বলছে দেখলাম । শান্ত খুব শান্ত চারদিক । শুধু পাতার সরসরানি । কোন এক মহিলা ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠছে । মেয়েরা ঢুকতে পারবে না এমন কোন নিয়ম নেই । মাথাও ঢাকতে হবে না । একটা ভেঙে পড়া বাড়ির দোতলার কোনের ঘরের এক চিলতে দেখা যাচ্ছে । ওখানে উনি থাকতেন । ভেতরে একটি তেলের প্রদীপ নিষ্কম্প জ্বলছে ।



 বাইরে হাওয়া দিচ্ছে খুব । অথচ পায়ের কাছে একটা গোলাপের বড় পাপড়ি পড়ে আছে । উড়ছে না । সেটা কি আমার জন্য ছিল? কেউ কি পাঠিয়েছিল? কেন কুড়িয়ে নিলাম না? মেহবুব এ ইলাহি , নিজামুদ্দিন আওলিয়া তুমি পাঠিয়েছিলে কি?

জেগে রব গভীর উপবাসে
অন্ন তোমার আপনি যেথায় আসে
যেথায় তুমি লুকিয়ে প্রদীপ জ্বালো
বসে রব সেথায় অন্ধকারে


ছবি সুপর্ণা এবং delhi  karavan 

1 comment: