Sunday 2 April 2017

মিয়াঁ বিবি


বিবির বয়স চোদ্দ আর মিয়াঁর বয়স তেত্তিরিশ । মিয়াঁ বিবি রাজি হলে কাজির কিছু করার থাকে না । কিন্তু এখানে ব্যাপারটা অত সোজা ছিল না । বিবির মন পেতে মিয়াঁ কে রীতিমত সাধ্য সাধনা করতে হয়েছিল । শের শাহ সুরির হাতে হেরে গিয়ে বাবার রাজত্ব হারিয়ে মিয়াঁ পালিয়ে পালিয়ে ঘুরছেন এখানে সেখানে । এমনই ঘুরতে ঘুরতে সিন্ধের থাট্টায় থিতু হলেন কিছুদিন । সেখানে এই কিশোরীর রূপ আর চঞ্চলতা তেত্তিরিশ বছরের বিদ্বান , প্রাজ্ঞ , কবি আবার রাজ্য থেকে উৎখাত পালিয়ে বেড়ানো সম্রাটকে একেবারে পাগল করে দিল । কিশোরীর মনে তখন তার স্বপ্নের রাজকুমার । ইয়া লম্বা চওড়া তায় আবার প্রায় বুড়োকে তার কিছুতে মনে ধরে না । তখন সে সুকুমার রায়ের লাইন গাইছিল বুড়ো তুমি লোকটি ভালো/চেহারাও নয়তো কালো /তবু কেন তোমায় ভালো বাসছিনে
বিবি হামিদা বানু আর মিয়াঁ হুমায়ুন । চেষ্টার কসুর করেন নি হুমায়ুন এই রূপসী কিশোরীর মন পেতে । আমি যার গলা জড়িয়ে ধরতে পারব না তাকে কি করে নিকাহ করব ? ওই অত উঁচু লম্বার গলার নাগালই তো পাব না । তার তো একটা সঙ্গী দরকার, সম্রাট নয় । হুমায়ুনের বোন গুলবদন বেগমও কিছু কিছু ঘটনা লিখে গেছেন হুমায়ুন নামায় । দিলদার বানো , হুমায়ুনের সৎ মা , হামিদাকে বিস্তর বোঝালেন যে বুড়োটা কিন্তু সত্যি সত্যি খারাপ লোক নয়। দুষ্টু নয় । মানুষ টা বেশ ভালো । শায়েরি ,সিরাজি আর আফিমে একটু বেশি ভালোবাসা । 

এতোটাই ভালো যে শের শাহ সুরি তার সেনাপতি আর ছেলেদের নির্দেশ দিয়েছিলেন যে ,তার শত্রুকে কোনোমতেই মেরে ফেলা যাবে না । শত্রু হলেও তিনি হুমায়ুনকে অসম্ভব শ্রদ্ধা করেন ।
হুমায়ুন নানা বিষয় পড়াশুনো করতেন । তার মধ্যে জ্যোতিষে তাঁর প্রবল আকর্ষণ । দিন ক্ষণ চুলচেরা হিশেব করে হামিদা বানুকে বিয়ে করলেন হুমায়ুন । তাদের ঘরকন্নার বয়স মাত্র পনের বছর । এই পনেরো বছর চূড়ান্ত অস্থিরতা তাদের কোথাও থিতু হতে দেয় নি । পালিয়ে পালিয়ে বেড়িয়েছেন হুমায়ুন , সঙ্গে হামিদা । আকবরের জন্মও হয়েছে এই অশান্ত সময়ে ।
সিন্ধ , কান্দাহার পারস্য সব জায়গায় সঙ্গে ছিলেন হামিদা । জঙ্গলে জঙ্গলে লুকিয়েছেন , মরুভূমির মধ্যে তেষ্টার জল পান নি , ভাল করে হাম্মাম করেন নি কতদিন । দিনের পর দিন কঠিন কষ্ট ভাগ করে নিয়েছেন হুমায়ুনের সঙ্গে । কোনো আরাম নেই , বিলাস নেই , স্বাচ্ছন্দ্য নেই । বাঁদি গোলাম নেই । সেই সব দিনে তিনি ছিলেন হুমায়ুনের আশার আলো , প্রেরণা । ভেবেছিলেন হারেমের এক কোনায় পড়ে থাকবেন । কিন্তু বাস্তবে হল ঠিক উলটো ।
 
পনেরো বছর পর মসনদ ফিরে পেলেন হুমায়ুন কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই দুনিয়া ছাড়তে হল তাকে । দুই হাতে ছিল ভারি ভারি বই , আজান শুরুর ডাক শুনতে পেলেন , সেই অবস্থায় হাঁটু গেড়ে বসতে গিয়ে টাল সামলাতে পারলেন না । লাইব্রেরির সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে মারা গেলেন । পুরানা কিলার শের মন্ডল সেই লাইব্রেরি ।
তাঁর উত্তরসূরি শাহজাহান সারা জীবন বিলাসে ডুবে ছিলেন , হারেমে সময় কাটত বেশি । বুরহানপুরের সমাধি থেকে মুমতাজ মহলের দেহ তুলে এনে বানালেন তাজমহল । তার অনেক অনেক বছর আগে এক ভাগ্যহত বেচারা স্বামীর জন্য মকবারা বানিয়েছিলেন হামিদা বানু, হুমায়ুনের তরুণী ভার্যা । কপালে সুখ ছিল না , কিন্তু ভালবাসা ছিল অঢেল ।





এই খানে আছে আরেক ভাগ্যহত মুঘলের সমাধি । দারা শিকোহ । তিনিও ছিলেন পন্ডিত , উদার হৃদয় এক সুফি সাধক ।
প্রতারণা ও দুর্ভাগ্যও সারাজীবন তাকেও তাড়িয়ে বেড়িয়েছে ।
১৮৫৭ সনে বিদ্রোহের সময় ইংরেজরা রক্তের যমুনা বইয়ে দিয়েছিল । শেষ মুঘল বাহাদুর শাহ জাফর এইখানেই পালিয়ে এসেছিলেন ,সঙ্গে ছিল আরো অনেকে । এখান থেকেই তাকে এবং শেষ মুঘলদের গ্রেপ্তার করে ইংরেজরা ।
হুমায়ুনের মকবারা নতুন সাজে ঝলমল । সবাই সেলফি তুলছে , হি হি করে হাসছে । অলিন্দের সূক্ষ্ম কাজ ক্যামেরায় তুলে রাখছে জাপানি মহিলা । অদ্ভুত আমেরিকান অ্যাকসেন্টে ইংরেজি বলে গাইড, বিদেশিদের এর মহিমা বোঝাচ্ছে ।
এরই মধ্যে দেখি উপরের জালির মধ্যে দুই পায়রা ঘন হয়ে বসে মজা দেখছে , যেন হামিদা আর হুমায়ুন ।



No comments:

Post a Comment